মতামত

দুর্যোগ ও গুজব নিয়ন্ত্রণে সক্ষমতা বাড়ানোর বিকল্প নেই

বাংলাদেশে বিপদ অকস্মাৎই আসে। দেশের সীমান্তবর্তী জেলা সুনামগঞ্জে এক রাতের মধ্যেই যে ভয়ংকর বন্যাটি ধেয়ে এলো এবং মানুষকে প্রস্তুতির সুযোগ না দিয়েই প্রকৃতি যে ভয়াল রূপ ধারণ করলো তা ওখানকার সবচেয়ে বয়স্ক বাসিন্দাও একবাক্যে স্বীকার করেন যে, এরকমটি আগে কখনোই দেখা যায়নি। সুনামগঞ্জের পর সিলেটে এবং বাকি বন্যা উপদ্রুত এলাকায় এখন মানুষ এক অসম্ভব বাস্তবতার সঙ্গে লড়ছে। পানি নামা শুরু করেছে বটে কিন্তু মানুষ যা হারিয়েছে তা আসলে অপূরণীয়।

Advertisement

আমরা জানি বিশ্ব এখন এক চরম পরিস্থিতির সঙ্গে লড়ছে। একটি মহামারি মাত্র কাটিয়ে উঠেছে, এখন নতুন করে আবার শুরু হয়েছে সংক্রমণ। ওদিকে মহাশক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে যে অন্যায্য ও শক্তিপরীক্ষার যুদ্ধ চলছে তাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশের মতো দেশসমূহ। ফলে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের রয়েছে একটি বিশাল ও নাজুক পরিণতি। আমরা আশা করি যে, বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ ও সরকার এ বিষয়ে সতর্ক রয়েছে। তবুও প্রশ্ন হলো, প্রতিটি দুর্যোগই আমাদের কিছু না কিছু শিক্ষা দিয়ে যায়। সুনামগঞ্জ ও সিলেটসহ দেশে চলমান বন্যা থেকেও আমাদের শেখার এবং ভবিষ্যতে তা প্রয়োগের জন্য অনেক কিছুই শিক্ষণীয় রয়েছে।

প্রথমত সিলেট ও সুনামগঞ্জে যে অকস্মাৎ ও প্রলয়ংকরী বন্যা দেখা দিল তা নিয়ে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা হলো, দুর্যোগ মোকাবিলা ও ব্যবস্থাপনায় যে সক্ষমতার কথা আমরা ফলাও করে বলি তা আসলে ঠিক ততোটা কার্যকর নয়। সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার পরও দেশের জনসংখ্যার ঘনত্ব বিচারে যে কোনো সাহায্য, সহযোগিতা এবং পদক্ষেপই অপ্রতুল হতে বাধ্য।

এক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে। মাত্র কিছুদিন আগেই একবার এসব এলাকায়ই বন্যা হয়েছে এবং সেখানে সরকারি সাহায্য-ব্যবস্থা আসলে ‘স্ট্যান্ডবাই’ থাকার কথা ছিল। কিন্তু কার্যত দেখা গেল যে, সুনামগঞ্জ শহর যখন পানিত তলায় ডুবে যাচ্ছে তখনও সরকারি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আসলে কাজ করছে না। সরকার তাৎক্ষণিকভাবে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিজিবিকে কাজে লাগিয়েছে বটে, তবে সেটা উদ্ধার তৎপরতায়।

Advertisement

আশ্রয়কেন্দ্রগুলো ও উপদ্রুত এলাকায় খাদ্য এবং সুপেয় পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে সরকারের যতোটা ত্বরিত ও কার্যকর অংশগ্রহণ প্রয়োজন ছিল তার সিকিভাগও হয়নি বলে পত্রপত্রিকার রিপোর্ট থেকেই জানা যায়। ওদিকে পুরো জেলা বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্কবিহীন থাকায় মূল ঘটনা আসলেই কি ঘটছে সে বিষয়ে গণমাধ্যম নিশ্চিত হতে পারেনি। এমতাবস্থায় অসহায় ও দুর্গত মানুষগুলোকে প্রথম দু’রাত ও দু’দিন কাটাতে হয়েছে দৈবের ভরসায়।

বাংলাদেশ একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ- এই সত্য আজকের নয়। খরা, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস এসব নিয়েই আমাদের বসবাস করতে হবে, এই সত্যও প্রতিষ্ঠিত। ফলে যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের সংস্থাগুলোর সর্বাত্মক প্রস্তুতি সার্বক্ষণিক ভাবেই থাকতে হবে। এর বিকল্প কিছুই নেই। কিন্তু আমরা বার বারই দেখতে পাই যে, এ ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে এবং প্রয়োজনের সময় জনগণের দুর্ভোগ কমাতে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণে সক্ষম হচ্ছে না দুর্যোগ ব্যবস্থাপক কর্তৃপক্ষ। ফলে জনঅসন্তোষ এবং অতৃপ্তি থেকেই যাচ্ছে।

কিন্তু এই অপ্রাপ্তি ও অযোগ্যতা হাজারগুণ বেড়ে যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া গুজবের কারণে। সুনামগঞ্জে বন্যা শুরু হওয়ার পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রথমে যে গুজব ছড়ানো হয়েছিল তা হলো ভারত ফারাক্কা বাঁধ খুলে দেওয়ায় বাংলাদেশ ডুবে যাচ্ছে। ভূগোল বিষয়ে সামান্য জ্ঞান যাদের রয়েছে তারাই জানেন যে, ফারাক্কা বাঁধ খুলে দেওয়ার কারণে বাংলাদেশের অন্য যে এলাকাই ডুবে যাক না কেন সিলেট বা সুনামগঞ্জে তার প্রভাব পড়বে না।

ভারত ফারাক্কা নিয়ে এরকম নিষ্ঠুর খেলা খেলে না এরকম দাবি করার সুযোগ নেই। কিন্তু এবারের বন্যা উজানে তথা ভারতের আসাম ও তৎসংলগ্ন এলাকায় ভারী বৃষ্টিপাত এবং পুরো আসামকে ডুবিয়ে পানি বাংলাদেশে নেমে আসার ফলে সৃষ্টি হয়েছে বন্যা। বাংলাদেশ ভৌগোলিক ভাবেই এই বন্যা থেকে মুক্ত নয়, ফলে দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা এবং ব্যবস্থাপনাই এক্ষেত্রে জরুরি। বিশেষ করে টেকসই বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনাই এর থেকে পরিত্রাণের উপায়।

Advertisement

বন্যা শুরু হওয়ার পরদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সয়লাব হয়ে গেল বন্যায় কল্পিত মৃতের সংখ্যা দিয়ে প্রচারণায়। প্রথমে বিবিসি’র একটি প্রতিবেদন উল্লেখ করা হলো যেখানে বাংলাদেশ ও ভারতে মিলিয়ে মৃতের সংখ্যা চল্লিশের ওপরে বলা হয়েছে। যদিও অপপ্রচারকারীরা কেবল বাংলাদেশে এই মৃতের সংখ্যা তুলে ধরে কেন বাংলাদেশের গণমাধ্যমে এই মৃতদের খবর আসেনি সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলে ‘দালাল মিডিয়া’ বলে যথেচ্ছ গালাগাল করা হলো।

দুঃখজনক সত্য হলো, বিলেতের দ্য গার্ডিয়ানসহ অন্যান্য সংবাদ মাধ্যমে ভারত ও বাংলাদেশে সৃষ্ট এ বন্যায় নিহতদের যে সংখ্যা দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে ভারতে মৃতের সংখ্যা জানানো হয়েছে ১৮ জন এবং তারা মূলত বন্যার কারণেই মৃত্যুবরণ করেছেন। অন্যদিকে কয়েকদিন ধরে চলা দুর্যোপূর্ণ আবহাওয়ায় বাংলাদেশে মৃতের যে সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে তাদের সবাই বজ্রপাতে মৃত্যুবরণ করেছেন বলে খবরে বলা হয়েছে। কিন্তু এই তথ্য বিভ্রাট হয়ে বন্যায় শত শত মানুষ নিহত হয়েছে বলে খবর প্রচার করা হয়েছে এবং মানুষকে ক্রমাগত উসকানি দেওয়া হয়েছে। একদিকে মানুষের বাড়িঘর ভেসে যাচ্ছে আরেকদিকে আরেক দল মানুষ কম্পিউটার/মোবাইলের সামনে বসে মৃতের সংখ্যা বাড়িয়ে চলছেন, এর চেয়ে অমানবিক কোনো কাজ আর হতে পারে কিনা আমার অন্তত জানা নেই।

এরপরই এই বন্যাকে কেন্দ্র করে দেশের বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষ ঢাকার রাস্তা আর টক শো’র টেবিলে দাবি তোলা হলো যে, এই বন্যার জন্য পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী আয়োজন বন্ধ করা হোক। আপাতদৃষ্টিতে এই আবেদন বা দাবি সঙ্গত মনে হতে পারে কিন্তু পদ্মা সেতু দেশকে যে উচ্চতায় এবং দেশের জন্য যে ইতিবাচক সংযোজন হতে যাচ্ছে তাতে এর উদ্বোধনকে বন্ধ করা কিংবা একে উৎসব হিসেবে না দেখতে চাওয়ার যুক্তিটি ঠিক খাপ খায় নয়।

এটা সহজেই বোধগম্য যে, পদ্মার ওপাড়ে যাদের বসবাস তারা ছাড়া আর কারও পক্ষেই পদ্মা সেতুর বিশেষত্ব, উপযোগিতা এবং প্রয়োজন সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা সম্ভব নয়। যে কারণে খুব সহজেই এই সেতু নিয়ে হাসাহাসি করা যায় কিংবা এই সেতু বিষয়ে নেতিবাচক প্রচারণায় অংশগ্রহণ করা যায়। অথচ একথা বিশেষজ্ঞরাই মনে করেন যে, মেঘনা-গোমতি কিংবা বঙ্গবন্ধু সেতু অথবা সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতুর যে প্রয়োজনীয়তা পদ্মা সেতুর প্রয়োজনীয়তা তার চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়, বরং অনেক বেশি।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে এসে এই সেতু হওয়াটা বাংলাদেশের জন্য দুঃখজনক। একটি খরস্রোতা এবং বিপৎসংকুল নদী পার হয়ে দেশের একটি বৃহৎ এলাকার মানুষকে এতোদিন ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয়েছে। অসংখ্য মৃত্যু, দুর্ঘটনা আর অব্যবস্থাপনার শিকার হয়ে ওই অঞ্চলবাসী নিজেদের ভাগ্যের সঙ্গে এতোদিন যুদ্ধ করে টিকে ছিল। এই মুহূর্তে যখন তাদের সামনে একটি বিরাট সুযোগ ও সম্ভাবনার সংযোগ হিসেবে পদ্মা সেতু দাঁড়িয়ে আছে বাস্তব হয়ে ঠিক সেই সময় দেশের আরেকটি অঞ্চলে বন্যার কারণে এই সেতুর উদ্বোধনী আয়োজন বন্ধ করতে বলার অর্থই হচ্ছে দেশের একটি বিরাট অংশের জনগণকে বঞ্চনা করা।

সিলেট/সুনামগঞ্জের বন্যার্তদের প্রতি সহমর্মিতা পোষণ করে না বাংলাদেশে এমন মানুষ পাওয়া যাবে না। কিন্তু ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থকে বাস্তবায়ন করতে যারা পদ্মা সেতুর উদ্বোধনকে এর সঙ্গে মিলিয়ে রাজনীতি করতে চাইছেন তারা আর যাই হোন বাংলাদেশের জনগণের বন্ধু নন। তারা ‘বিভক্তি ও শাসন’ (ডিভাইড অ্যান্ড রুল)-এ বিশ্বাসী রাজনীতি করেন এবং এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ব্রিটিশ আমল থেকে তাদের আমরা চিনি এবং তারা এখনও সেই কুৎসিত রাজনীতিই করে চলেছেন।

মোটকথা দেশের দিকে ধেয়ে আসা প্রাকৃতিক দুর্যোগকালে আমরা যেমন রাষ্ট্রের সক্ষমতাকে যাচাই করতে পারি তেমনই জানি যে, বাংলাদেশের ভেতরই বাংলাদেশবিরোধী এক বা একাধিক রাজনৈতিক পক্ষ আছে, যারা গুজবকে হাতিয়ার করে তুলেছেন তাদের রাজনীতির। সুনামগঞ্জ ও সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি আমাদের আবার সেই শিক্ষা দিয়েই যাচ্ছে যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের সমর্থ ও ব্যবস্থাপনা-কৌশল আরও অনেক বেশি কার্যকর হওয়া প্রয়োজন। অন্যদিকে গুজবনির্ভর রাজনীতি ও তাদের পরিচালকদেরও আমাদের সামনে আবার হাজির করে দিয়েছে এই বন্যা। বাংলাদেশের মানুষ এদের চেনে কিন্তু দুর্যোগকালেই এদের হাতে দেশের জনগণ জিম্মি হয়ে পড়ে সবচেয়ে বেশি, এটাই দুঃখজনক।

ঢাকা ২১ জুন, মঙ্গলবার ২০২২

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট। masuda.bhatti@gmail.com

এইচআর/ফারুক/এমএস