খেলাধুলা

নানা সমস্যায় ১৫ বছর ধরে বন্ধ রাজবাড়ী সুইমিংপুল

খাল-বিল, নদী-নালার দেশে ভালোমানের সাঁতারু বের করে আনার লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকা, বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহর এবং বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ জেলায় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অর্থায়নে নির্মাণ করা হয়েছে সুইমিংপুল। যে সব সাঁতারুরা শুধুমাত্র এসএ গেমস নয়, দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে এশিয়ান গেমস, এমনকি অলিম্পিক গেমসেও।

Advertisement

শুধু সাঁতারু বের করে আনাই নয়, বিভিন্ন ক্রীড়া ডিসিপ্লিনে খেলোয়াড়দের শরীরচর্চার অন্যতম অনুসঙ্গ হিসেবেও খুব প্রয়োজন সাঁতার। সাধারণ মানুষের সাঁতার শেখাটাও জীবনের অন্যতম প্রয়োজনীয় বিষয়।

সবকিছুকে সামনে রেখে সারা দেশে অন্তত ২৩টি সুইমিংপুল নির্মাণ করা হয়। কিন্তু নির্মাণের পর অধিকাংশ পুলই পড়ে রয়েছে জরাজীর্ণ অবস্থায়। কোনো কোনো পুলে তো একদিনের জন্যও কেউ নামতে পারেনি। কোথাও পানি নেই, কোথাও পাম্প নষ্ট, কোথাও নোংরা পানি- নানা অব্যবস্থায় পড়ে রয়েছে কোটি কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মিত সুইমিংপুলগুলো।

অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত এসব সুইমিংপুল নিয়েই জাগোনিউজের ধারাবাহিক আয়োজন। ৮ম পর্বে আজ থাকছে রাজবাড়ী সুইমিং পুলের চালচিত্র...

Advertisement

* রাজবাড়ীতে জন্ম নিয়েছেন স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত সাঁতারু ডলি আক্তার, লায়লা নুর, মিতা নুর, পুতুল ঘোষ, নিবেদিতা দাসসহ অনেকে।* ২০০৩ সালে ৩ একর জমির ওপর ৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় এই সুইমিং পুলটি। চালু ছিল ২০০৭ সাল পর্যন্ত।* সরজ‌মি‌নে গি‌য়ে দেখা যায়, সুইমিং পুল‌টির মূল ফটক বন্ধ এবং সামনে র‌য়ে‌ছে মা‌টির স্তুপ।* পু‌লে পা‌নি না থাকায় শু‌কি‌য়ে চৌ‌চির চৌবাচ্চা। বেশকিছু জায়গা থে‌কে উ‌ঠে গে‌ছে টাইলস।* বিগত ক‌মি‌টির এখনও ৪ লাখ টাকার বিদ‌্যুৎ বিল ব‌কেয়া র‌য়ে‌ছে। পা‌নির পাম্প নষ্ট।

সাঁতারে রাজবাড়ীর রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। জাতীয় পর্যায়ে সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে স্বর্ণপদক পেয়েছেন রাজবাড়ীর ডলি আক্তার, লায়লা নুর, মিতা নুর, পুতুল ঘোষ, নিবেদিতা দাসসহ অনেকেই।

এদের মধ্যে অন্তার্জাতিক পর্যায়ের সাঁতার প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের হ‌য়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন ডলি আক্তার ও পুতুল ঘোষসহ আরও ক‌য়েকজন।

বর্তমা‌নে পানির পাম্প ও নিষ্কাশন, বিদ্যুৎ বিল বাকীসহ নানা সমস্যায় বন্ধ রয়েছে রাজবাড়ী সুইমিং পুলটির সব ধরনের কার্যক্রম। পু‌লের চৌবাচ্চায় পা‌নি না থাকায় নষ্ট হ‌চ্ছে টাইলস। ফ‌লে সাঁতার শেখা থে‌কে ব‌ঞ্চিত হ‌চ্ছে বর্তমান প্রজন্মসহ আগ্রহী সাঁতারুরা।

Advertisement

অথচ ক্রীড়া মন্ত্রণাল‌য় সং‌শ্লিষ্ট‌ কর্মকর্তা‌ ও প্রকৌশলী‌দের প‌রিদর্শন এবং প্রতিশ্রু‌তির পরও চালু হয়‌নি সুইমিং পুল‌টি।

জানা যায়, জাতীয় মা‌নের সাঁতারু তৈ‌রির উদ্দেশ্যে সরকার ২০০৩ সালে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের তত্ত্বাবধানে রাজবাড়ী-কু‌ষ্টিয়া আঞ্চ‌লিক মহাসড়‌কের পাশে ভবানীপু‌রে প্রায় ৩ একর জমির ওপর ৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করে জাতীয় মানের রাজবাড়ী সুইমিং পুল।

নির্মাণের পর ওই বছরই পুলটি জেলা ক্রীড়া সংস্থার কাছে হস্তান্তর করে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ এবং একই বছরের শেষ দিকে পুলটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনের পর থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত চালু ছিল সুইমিং পুলটি।

পরবর্তীতে এখানে কোনো লোকবল পদায়ন না করা, গভীর নলকূপটি অকেজো হয়ে পড়া, পা‌নিতে আয়রন সমস‌্যা, ব‌কেয়া বিদ‌্যুৎ বিল প‌রি‌শোধ না করা, পা‌নি নিষ্কাশন না হওয়াসহ নানা কার‌ণে বন্ধ হয়ে যায় পুলটি।

এখন মা‌ঝে ম‌ধ্যে ইঞ্জিন চা‌লিত স‌্যা‌লো মে‌শিনের পা‌নি দি‌য়ে প্রশিক্ষণ বা প্রতি‌যো‌গিতার আ‌য়োজন করা হ‌লেও তা মাত্র ক‌য়েক‌দি‌নের জন‌্য।

বর্তমা‌নে সুইমিং পুল‌টি দেখাশুনার জন‌্য র‌য়ে‌ছে একজন নাইট গার্ড ও একজন কেয়ারটেকার। সরজ‌মি‌নে গি‌য়ে দেখা যায়, সুইমিং পুল‌টির মূল ফটক বন্ধ এবং সামনে র‌য়ে‌ছে মা‌টির স্তুপ। মূল ফটকের ছোট প‌কেট খু‌লে ভেত‌রে ঢুক‌তে চো‌খে প‌ড়ে বিশাল এক‌টি মাঠ।

দেখা গেলো মা‌ঠে কিছু গরুর বিচরণ এবং একপাশে সুইমিং কম‌প্লেক্স। ঘা‌সের কার‌ণে ক‌মপ্লে‌ক্সে যাওয়ার ইটের রাস্তা‌টির অবস্থান বোঝার উপায় নাই। নষ্ট হ‌য়ে পড়ে আছে পা‌নির পাম্প। পু‌লে পা‌নি না থাকায় শু‌কি‌য়ে চৌ‌চির চৌবাচ্চা এবং সেখানে র‌য়ে‌ছে আয়র‌ণের বড় বড় কণা। বেশকিছু জায়গা থে‌কে উ‌ঠে গে‌ছে টাইলস, আয়র‌নে কা‌লো ও হলুদ বর্ণ ধারণ ক‌রে‌ছে বাকি টাইলসগুলো।

ব‌্যবহার না হওয়ায় ক‌মপ্লে‌ক্সের পা‌শের সিঁড়ি‌তে জ‌ন্মে‌ছে আগাছা, পা‌নি নিষ্কাশ‌নের ড্রেনে‌জ ব‌্যবস্থা থাক‌লেও মহাসড়‌ক উন্নয়ন কা‌জে সে‌টি বন্ধ হ‌য়ে এখন বন্ধ। মা‌ঝে-ম‌ধ্যে প্রশিক্ষণ ও প্রতি‌যো‌গিতার আ‌য়োজ‌নে পা‌নি উত্তোল‌নের জন‌্য কমপ্লে‌ক্সের ডান পা‌শে বসা‌নো হ‌য়ে‌ছে স‌্যা‌লো মে‌শি‌ন। পা‌নির আয়র‌নের প্রভাব পড়েছে ওয়াশ এবং চেঞ্জ রুমেও।

জাতীয় ও আন্তর্জা‌তিক পর্যা‌য়ে রাজবাড়ী থে‌কে দে‌শের হ‌য়ে প্রতি‌নি‌ধিত্ব করা পুতুল রানী ঘোষ জানান, ছোট বয়স থে‌কেই তি‌নি সাঁতার পছন্দ ও বিভিন্ন প্রতি‌যো‌গিতায় অংশগ্রহণ কর‌তেন। জাতীয় পর্যা‌য়ে সাঁতারে অংশ নি‌য়ে তি‌নি ৩৪টি পদক পান। এরম‌ধ্যে স্বর্ণ ২০টি। বাকিগুলো সিলভার এবং ব্রোঞ্জ পদক। সাফ গেমসসহ দে‌শের বাই‌রে শ্রীলঙ্কা, হংকং, মাদরাজ, নেপালও গিয়ে‌ছেন সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে। এখন তিনি খেলোয়াড় হিসা‌বে আনসা‌রে আছেন। ১৯৯৫ থে‌কে ৯৮’তে তিনি বে‌শি পদক লাভ করেন।

পুতুল রানী আরও জানান, তা‌দের সাফল‌্য দে‌খে ওই সময় রাজবাড়ীতে সুইমিং পুল তৈ‌রি হয়। কিন্তু এখন সুইমিং পুল‌টি ব‌্যবহার অনু‌পযো‌গি হ‌য়ে প‌ড়ে‌ছে। পু‌লে পা‌নি দেওয়ার মে‌শিন নাই। জাতীয় পর্যা‌য়ে রাজবাড়ীর সাঁতারু‌দের চা‌হিদা থাক‌লেও সুইমিংয়ের অভা‌বে সেটা এখন আর পূরণ হ‌চ্ছে না।

সব ঠিকঠাক থাক‌লে তা‌দের মত এখনও আন্তর্জা‌তিক মা‌নের সাঁতারু তৈ‌রি হ‌তো। শুধু প্রতি‌যোগিতার জন‌্যই নয়, এখন জীবনরক্ষার জন‌্যও সাঁতার শেখা প্রয়োজন। ১৪ বছর তি‌নি ধানমন্ডি ম‌হিলা ক্রীড়া কমপ্লে‌ক্সে কো‌চের দ্বা‌য়িত্ব পালন ক‌রে‌ছেন। রাজবাড়ীর সুইমিং পুল‌টি সচল করা হ‌লে ছোট বাচ্চাসহ সক‌লেই তিনি সুইমিং করা‌তে পার‌তেন। কিন্তু পুল থাক‌লেও এখন আর সে‌টি সম্ভব হ‌চ্ছে না।

অভিভাবক শ‌হিদুল ইসলাম ও আলেয়া বেগম ব‌লেন, ‘শহ‌রের মধ্যে কোন পুকুর বা জলাশয় নাই। যেখা‌নে সাঁতার শেখা যায়। কিন্তু এই শহ‌রেই এক সময় বড় বড় সাঁতারু ছি‌লো। এখন সাঁতার না জানার কার‌ণে অনেক দূর্ঘটনা ঘট‌ছে। তাই দ্রুত বন্ধ সুইমিং পুল‌টি চালু ও রক্ষণা‌বেক্ষ‌ণের দা‌বি জানান।

স্থানীয় প্রশিক্ষক র‌ফিকুজ্জামান রফিক জানান, নিজস্ব ব‌্যবস্থায় পা‌নি দি‌য়ে সুইমিং পু‌লে মা‌ঝে ম‌ধ্যে বয়স ভি‌ত্তিক সাঁতার প্রশিক্ষণ ও ক‌্যাম্প হয়। সেখা‌নে জাতীয় ক্রীড়া প‌রিষ‌দের কো‌চের পাশাপা‌শি তিনি স্থানীয় ভা‌বে প্রশিক্ষণ দেন। বর্তমা‌নে সুইমিং পু‌লের অবস্থা খুবই খারাপ। পা‌নির ব্যবস্থা নেই। হলেও নিষ্কাশন হয় না পা‌নি। সাঁতার শিখ‌তে না পে‌রে অনেকে খারাপ প‌থে যা‌চ্ছে। দ্রুত পু‌লের সব সমস‌্যা সমাধান ক‌রে পুল‌টি চালুর অনু‌রোধ জানান তি‌নি।

রাজবাড়ী জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারন সম্পাদক স‌ফিকুল ইসলাম স‌ফি ব‌লেন, ‘জাতীয় ক্রীড়া প‌রিষদ থে‌কে সুইমিং পু‌লে কোনো বরাদ্দ হয় না। বিগত ক‌মি‌টির এখনও ৪ লাখ টাকার বিদ‌্যুৎ বিল ব‌কেয়া র‌য়ে‌ছে। পা‌নির পাম্প নষ্ট, আয়র‌নের কারণে এখন পুল‌টির টাইলস নষ্ট হ‌য়ে গে‌ছে। ফ‌লে পু‌লের সংস্কার প্রয়োজন। ফিল্টার আয়রন মে‌শিনের ব‌্যবস্থা হ‌লে পু‌লের কার্যক্রম রক্ষণা‌বেক্ষণ কর‌তে পার‌বেন। এছাড়া পা‌নি নিষ্কাশ‌নের ড্রেনেজ ব‌্যবস্থা ভালো নাই। ড্রেনেজ ব‌্যবস্থা ভালো না কর‌লে পু‌লের পা‌নি ছাড়‌লে আশপা‌শের মানুষের কথা শুন‌তে হয়।’

তি‌নি আরও ব‌লেন, রাজবাড়ী জেলার ক্রীড়া ও সাংস্কৃ‌তিক অঙ্গ‌নে ইতিহাস ও ঐতিহ‌্য র‌য়ে‌ছে। সে ধারাবা‌হিকতায় ২০০৩ সা‌লে রাজবাড়ী‌তে এক‌টি আন্তর্জাতিক মা‌নের সুইমিং পুল তৈরি হ‌লেও ২০০৭ সা‌লের পর থে‌কে ডিপ টিউবওয়েল ও আয়রন সমস‌্যায় পুল‌টি নষ্ট হ‌তে থা‌কে। পরবর্তী‌তে বি‌ভিন্ন সম‌য়ে তি‌নি স‌্যা‌লো মে‌শি‌নে পা‌নি দি‌য়ে সাঁতার প্রশিক্ষণসহ বি‌ভিন্ন কর্মসূ‌চি পালন ক‌রে‌ছেন।

বর্তমান পুল‌টি‌তে সাঁতার শেখার কোনো অবস্থা নাই। যুব ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ও জাতীয় ক্রীড়া প‌রিষ‌দের টিম এসে সংস্কা‌রের আশ্বাস দি‌লেও কোন কাজ হ‌চ্ছে না। ড‌লি আক্তার, লয়লা নূর, নি‌বে‌দিতা তাস, পুতুল ঘোষের মত রাজবাড়ীর অনেক সাঁতারু এশিয়ান গেমস ও জাতীয় পর্যা‌য়ে স্বর্ণ পদক পে‌য়ে‌ছে। ‌

অথচ এখন সেই জেলা‌তেই সাঁতার শেখার ব‌্যবস্থা নাই। দ্রুত পু‌লটি সংস্কার হ‌লে আবারও রাজবাড়ী থে‌কে জাতীয় মা‌নের নতুন নতুন সাঁতারু তৈ‌রি হ‌তো। এছাড়া সাঁতার শেখার মাধ‌মে ছে‌লে মে‌য়ে‌দের শরীর ও মনের বিকাশ ঘটবে ব‌লে ব‌লে তি‌নি ম‌নে ক‌রেন।

রু‌বেলুর রহমান/আইএইচএস