নারী ও শিশু

মহামারির বড় অভিঘাতের শিকার শিশুরা বাজেটে উপেক্ষিত

দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বড় আঘাত হেনেছে করোনাভাইরাস। বলা যায়, ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শীর্ষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দীর্ঘদিন পড়াশোনা, ক্লাস, পরীক্ষার বাইরে থাকায় নানামুখী ক্ষতির পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মনোজগতেও পড়েছে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব। সংক্রমণ কিছুটা কমায় শিক্ষাখাতের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে সরকার। সে হিসেবে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষার্থী, বিশেষ করে শিশু শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পাবে বলেই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে উপেক্ষিতই থেকে গেছে দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধাররা।

Advertisement

‘দুই বছর আগে পড়ালেখার প্রতি ছেলে-মেয়েদের যে আগ্রহ ছিল, এখন আর তা নেই। নোট করে পড়ার প্রবণতা কমেছে তাদের। পরীক্ষা নিয়েও তাদের পরিকল্পনা একেবারে অগোছালো।’

আক্ষেপের সুরে কথাগুলো বলেন রাজধানী ঢাকার বাসিন্দা মোহাম্মাদ আবদুল মজিদ সুজন।

বেসরকারি চাকরিজীবি সুজনের দুই মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ে মমতাজ এবার মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। মেঝ মেয়ে পায়েল ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড থেকে এবছর এসএসসি পরীক্ষার্থী দেবে। আর ছোট ছেলে নাবিল আইডিয়াল স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র।

Advertisement

তিনি জাগো নিউজকে বলেন, করোনার কারণে ছেলে-মেয়েদের অনলাইনে ক্লাস করতে হয়েছে। অল্প বয়সেই তাদের মোবাইল, ইন্টারনেটের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। একে তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল, অন্যদিকে সন্তানরা প্রযুক্তিতে আসক্ত হয়েছে। এটা তাদের মেধা ও মননের বিকাশকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

করোনার থাবায় দুই বছরেরও বেশি সময় বন্ধ ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এতে শিক্ষার গুণগত মানের পরিবর্তনের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ প্রতিষ্ঠান ছেড়েছে।

ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং জার্মান উন্নয়ন সংস্থার (জিআইজেড) রুল অব ল’ প্রোগ্রামের ‘অ্যাডোলেসেন্ট গার্লস ভালনারাবিলিটিজ অ্যান্ড ট্রানজিশন ইন দ্য কনটেক্সট অফ কোভিড-১৯’ শীর্ষক গবেষণায় জানানো হয়েছে, মহামারির দুই বছরে স্কুল ছেড়েছে অন্তত ৩৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। পরিবারের অর্থনৈতিক সংগতি না থাকায় ১৬ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়াশোনার খরচ চালাতে পারছে না।

২০২২-২০২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করছেন অর্থমন্ত্রী

Advertisement

শিক্ষার এমন বেহাল অবস্থার পাশাপাশি করোনাকালে শিশুর প্রতি সহিংসতা, বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রমের হারও বেড়েছে। এমন অবস্থায় শিশুদের জন্য আলাদা বাজেট ও বিশেষ বরাদ্দ চেয়েছিলেন শিক্ষক, অভিবাবক ও বিশেষজ্ঞরা।

গত ৯ জুন ‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় পরিবর্তন’ শীর্ষক বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তবে গত দুই অর্থবছরের মতো এবছরও শিশু বাজেট প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি। করোনা অভিঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশনাও ছিল না ঘোষিত প্রস্তাবিত বাজেটে

সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে শিশু বাজেট প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। যার শিরোনাম ছিল ‘বিকশিত শিশু: সমৃদ্ধ বাংলাদেশ’। সেই অর্থবছরে শিশুদের জন্য কাজ করা মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সম্মিলিত বাজেট বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ৬৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। যার মধ্যে কেবল শিশুকেন্দ্রিক বাজেট ছিল ৮০ হাজার ১০০ কোটি টাকা।

২০১৩ সালের শিশু আইন অনুযায়ী, ১৮ বছর পর্যন্ত জনগোষ্ঠীর সবাই শিশু হিসেবে বিবেচিত হবে। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৪০ শতাংশ এই বয়সভিত্তিক গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। শিশুদের জন্য বাজেটের ২০ শতাংশ ব্যয় করার প্রতিশ্রুতি রয়েছে সরকারের। তবে শিশুদের জন্য পৃথক বাজেট প্রতিবেদন প্রকাশ না করায় শিশুকেন্দ্রিক কী পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা হচ্ছে, তার সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি।

জাতীয় বাজেটে সর্বপ্রথম ‘বাজেট থটস ফর চিলড্রেন’ শীর্ষক প্রতিবেদন তুলে ধরা হয় ২০১৫-১৬ অর্থবছরে। ২০১৭-১৮, ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত এই বাজেট প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল। এরপর থেকে অজানা কারণে বাজেটে শিশুবিষয়ক আলাদা প্রতিবেদন প্রকাশ করা বন্ধ হয়ে যায়। কী কারণে শিশু বাজেট প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় না সে সম্পর্কেও অর্থমন্ত্রণালয়ের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে এক অনুষ্ঠানে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কয়েক বছর ধরে শিশু বাজেট প্রতিবেদন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। অথচ সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল যে, ২০২০ সালের মধ্যে তারা বাজেটের অন্তত ২০ শতাংশ বরাদ্দ নিশ্চিত করবে। যা ব্যবহার হবে শিশুদের কল্যাণার্থে। কিন্তু বর্তমানে শিশুকেন্দ্রিক কী পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই।

আইন ও শালিস কেন্দ্রের তথ্যমতে, ২০২১ সালে জানুয়ারী থেকে জুলাই পর্যন্ত ১ হাজার ১৯৯টি শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। ৭ মাসে খুন হয়েছে ৩৬৫ শিশু। ২০২০ সালে একই সময়ে শিশুর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ছিল ৯৮৬টি। করোনাকালে শিশুধর্ষণ, যৌন হয়রানি, নির্যাতন, গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা ও এর ভয়াবহতা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিশুরা। কিন্তু শিশুদের জন্য বরাদ্দ সম্পর্কে সম্যক ধারণা না পাওয়া শিশুদের প্রতি সরকারের বৈরী আচরণই প্রকাশ পাচ্ছে। সরকারের ১৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ শিশুকেন্দ্রিক নানা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে। এমন অবস্থায় চূড়ান্ত বাজেট ঘোষণার আগে কিংবা পরে প্রতিবেদন প্রকাশ করার তাগিদ দিয়েছেন তারা।

এ প্রসঙ্গে নারী ও শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু জাগো নিউজকে বলেন, অনেক আলাপ-আলোচনার পরই শিশুদের জন্য পৃথক প্রতিবেদন প্রকাশ করার সংস্কৃতি চালু হয়। বাজেটে যদি বরাদ্দের বিষয়টি উল্লেখ না থাকে, অংশীদারত্ব না থাকে তাহলে তো বাজেট ফলপ্রসূ হলো না। এটা কেন বাদ দেওয়া হলো সেটাও কিন্তু আমরা জানি না। আমাদের দাবি থাকবে যেন আলাদা করে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

মহামারির দুই বছরে স্কুল ছেড়েছে অন্তত ৩৫ শতাংশ শিক্ষার্থী/সূত্র: গবেষণা

করোনা অভিঘাতে শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, শিশুরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়ছে। বাল্যবিবাহ হচ্ছে, সহিংসতার শিকার হচ্ছে। তারা দারিদ্র্যের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। শিশুদের নিয়ে যতগুলো উন্নয়নমূলক সূচকে আমরা এগিয়েছিলাম, আবার কিন্তু পিছিয়ে পড়েছি। শিশুদের জন্য বাজেটে বরাদ্দ অবশ্যই জরুরি। আমাদেরও বরাদ্দের বিষয়টি জানা দরকার।

‘তারা বলছে, কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় পরিবর্তনের বাজেট, কিন্তু যে অভিঘাত শিশুদের ওপর পড়েছে সেটা কীভাবে মোকাবিলা করা হবে? শিক্ষার ক্ষেত্রে সরকার কী ধরনের প্রণোদনা দেবে, স্কুলে তাদের ফিরিয়ে আনা, বাল্যবিবাহ বন্ধ করা, সহিংসতা কমাবে- এসব বিষয়ে তো সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ রাখতে হবে। যথেষ্ঠ তথ্য-উপাত্ত দিয়ে এই প্রতিবেদনটা প্রকাশ করা উচিত।’ যোগ করেন তিনি।

বাংলাদেশ বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. মামুনুর রশিদ খোকন জাগো নিউজকে বলেন, করোনাকালে উচ্চবিত্তের সন্তানরা অনলাইনে পড়াশোনা চালিয়ে গেলেও নিম্নআয়ের পরিবারের সন্তানদের একেবারেই হয়নি। এই গ্যাপ পূরণ করতে সরকারের আলাদা প্রকল্প কিংবা আলাদা চিন্তা করা উচিত। তা না হলে গত দুই বছরে শিক্ষায় যে ঘাটতি হয়েছে, তা থেকেই যাবে। এজন্য সরকারের উচিৎ শিশুদের জন্য আলাদা কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা ও তা প্রকাশ করা।

এসএম/ইএ/এএসএম