ঢাকায় আমার কোনো ফ্ল্যাট নেই। ঢাকায় আমি আছি ৩৩ বছর ধরে। যাত্রাবাড়ীর নোংরা ড্রেনের ওপরের মেস থেকে বর্তমানে শান্তা প্রপার্টিজের আধুনিক ফ্ল্যাট- আমার ঢাকাবাসের ৩৩ বছরই কাটছে ভাড়া বাসায়। এই ৩৩ বছরে আমি ১৬ বার বাসা বদল করেছি। বাসা বদল সাংঘাতিক ঝক্কি এবং খরচেরও ব্যাপার। কিন্তু আমার স্ত্রী মুক্তি বলেন, আমার নাকি বাসা বদলানোর নেশা আছে।
Advertisement
একটু কিছু মনের মতো না হলেই আমি বাসা বদলাতে উঠে পড়ে লাগি। মুক্তি প্রথমে রাজি না থাকলেও শেষ পর্যন্ত তাকে পটাই এবং বাসা বদলে ফেলি। আমি এবং মুক্তি দুজনই সামর্থ্যের সর্বোচ্চ দিয়ে ভালো বাসায় থাকার পক্ষে। তাই সামর্থ্য অনুযায়ী যখন যেখানে ছিলাম, গুছিয়ে ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখতে চেয়েছি ভালো বাসাটুকু।
৩৩ বছরে বাড়িওয়ালাদের যত টাকা দিয়েছি, তাতে একটা ফ্ল্যাট কেনাই যেতো। সমস্যা হলো, আমরা যেমন ফ্ল্যাটে থাকতে চাই, তেমন ফ্ল্যাট কেনার সামর্থ্য আমার নেই। আবার যেমন ফ্ল্যাট কেনার সামর্থ্য আছে, তেমন ফ্ল্যাটে থাকতে চাই না। ঢাকায় আমার ফ্ল্যাট নেই মানে আমার ফ্ল্যাট কেনার সামর্থ্য নেই, তা কিন্তু নয়। আমার বন্ধু, সমসাময়িক অনেকেই ঢাকায় ফ্ল্যাট কিনেছেন।
কীভাবে কিনেছেন আমি জানি। তাদের অনেকের ফ্ল্যাট কেনার প্রত্যেকটি পয়সার হিসাব আমি জানি। সেখানে কোনো কালো টাকা নেই। আমিও চাইলে ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে ভাড়ার টাকায় লোন শোধ করে সাদা টাকা দিয়েই একটি ফ্ল্যাট কিনতে পারতাম। কিন্তু ফ্ল্যাট কিনে ব্যাংকের ঋণের জালে নিজেকে আটকাতে চাইনি।
Advertisement
তারচেয়ে বড় কথা, ফ্ল্যাট একটি নির্দিষ্ট বাসায় আটকে থাকাটাও আমার পছন্দ নয়। তারচেয়ে বড় কথা, আমাদের যে পেশা, তারচেয়ে অনিশ্চিত বাংলাদেশে আর কিছু নেই। আয় কমে গেলে বা বেকার হয়ে গেলে চট করে বাসা বদলে ফেলা সম্ভব। কিন্তু ফ্ল্যাট কিনে ব্যাংকের ঋণের ফাঁদে পড়ে গেলে, তা থেকে উদ্ধারের উপায় নেই। বেশিরভাগই আমার নীতির সাথে একমত নন। অনেকেই মনে করেন, বাড়িওয়ালাকে মাসে মাসে টাকা দেওয়ার চেয়ে কষ্টে-সৃষ্টে একটা ফ্ল্যাট কিনে ফেলতে পারলে নিশ্চিন্ত।
ছোট হোক, দূরে হোক তবু তো নিজের বাসা। তারচেয়ে বড় কথা ভাড়া বাসায় থাকার গ্লানিও কম নয়। বাড়িওয়ালার হাজারটা বায়নাক্কা মানতে হয়। এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না, গাছ লাগানো যাবে না, এত গেস্ট কেন- নিষেধাজ্ঞার অন্ত নেই। এই ঝামেলা থেকে বাঁচতে আমার বন্ধুদের যারা ফ্ল্যাট কিনেছেন, তাদের চেষ্টাটা আমি দেখেছি।
সারাজীবনের সব সঞ্চয় একত্র করা, বাবার পেনশনের টাকা ধার নেয়া, গ্রামের জমি বিক্রি করা, ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া- সক্ষমতার সর্বোচ্চ প্রয়োগ করেই মিলে একটি ফ্ল্যাট। তারপর রেজিস্ট্রেশন, এই বিল, সেই বিল, এই ঝামেলা, সেই ঝামেলা তো আছেই। আমার চেনা ফ্ল্যাট মালিকদের প্রায় সবাই সাদা টাকা দিয়েই ফ্ল্যাট কিনেছেন, তাদের কারও কালো টাকা নেই।
গুলশান, বারিধারা, বনানী, ধানমন্ডির অভিজাত এলাকার অভিজাত মালিকদের কথা জানি না, আমার চারপাশে সাদা টাকায় ফ্ল্যাট কেনা মানুষের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ঢালাওভাবে ঢাকায় ফ্ল্যাট বা জমি আছে এমন সবাইকে ‘কালো টাকার মালিক’ বলে দিলেন। অর্থমন্ত্রী তাদের আবেগটা, বাস্তবটা একটুও বোঝার চেষ্টা করলেন না। বাংলাদেশে কালো টাকা নেই, সে দাবি কেউ করবে না। চারদিকে কালো টাকার ছড়াছড়ি। টাকার আসলে কোনো রঙ নেই।
Advertisement
যখনই আপনার আয় কালো পথে হবে, তখনই আপনার টাকার রঙ বদলে যাবে। যে টাকা আপনি আয়কর ফাইলে দেখাতে পারবেন না, মানে যে টাকার হিসাব দিতে পারবেন না, সেটাই কালো টাকা। আপনি বেতন পান ৭০ হাজার টাকা, ছেলের স্কুলের বেতন ৩০ হাজার টাকা। কীভাবে সম্ভব? জবাব দিতে না পারলেই আপনার টাকা কালো।
প্রতি বছর আয়কর রিটার্ন জমা দিতে গিয়ে গলদঘর্ম হয়ে যাই। কোনো কিছু বাদ পড়লো না তো! কিন্তু ঢাকায় আকাশ ছোঁয়া ভবন, আলিশান ফ্ল্যাট আর কোটি টাকার গাড়ির বহর দেখে ভাবি, এর মালিকরা কীভাবে আয়করের হিসাব মেলান। মন্ত্রী-এমপিরা নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনে হিসাব দেন।
পাঁচ বছর পর দেখা যায় একেকজনের আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে। কীভাবে তারা হিসাব মেলান। পাঁচ বছরে আয় কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ার মতো কী এমন ব্যবসা আছে দেশে। হঠাৎ দেখি রাজনীতিবিদদের মধ্যে কৃষক বা মৎস্য চাষীর সংখ্যা বেড়ে যায়, তখন বুঝি ওখানে নিশ্চয়ই কোনো ফাঁকির ব্যবস্থা আছে।
সরকার নানা সময় কালো টাকা সাদা করার বিভিন্ন লোভনীয় সুযোগ দেয়। কিন্তু কালো টাকার মালিকরা ভুলেও সে লোভের ফাঁদে পা দেন না। কালো টাকাও আর সাদা হয় না। সুইস ব্যাংকে যেন বাংলাদেশের টাকার খনি আছে। কানাডায় শুনি বাংলাদেশের বেগমদের জন্য আলাদা বেগমপাড়া আছে।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ায়ও শুনি বাংলাদেশিদের বিত্তের পাহাড়। দেশে অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জন করে তারা সে অর্থ বিদেশে পাচার করেন। আমার মাথায় ঢোকে না, কোটি কোটি টাকা তো ব্যাগে ভরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাহলে কীভাবে সেই টাকা পাচার হয়? অর্থমন্ত্রী প্রক্রিয়াটা জানেন না?
পাচারের পথ বন্ধ না করে এখন পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনার জন্য বাজেটে বিশেষ সুবিধাও ঘোষণা করেছেন। কিন্তু নানান সুবিধা দিয়েও যেমন দেশের কালো টাকা সাদা করা যায়নি। আমি নিশ্চিত, যতই লোভ দেখান, পাচার করা টাকাও আর ফিরে আসবে না। যারা অনেক কৌশল করে টাকা পাচার করেছেন, বিদেশে সম্পদ করেছেন; তারা এখন কোন ভরসায় টাকা দেশে ফেরাবেন।
পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় অর্থমন্ত্রী ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছেন। বলা যায়, এবারের বাজেটের সবকিছু আড়াল হয়ে গেছে পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগে। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, সমালোচনাটাই অর্থমন্ত্রীর প্রাপ্তি, কোনো টাকাই ফিরে আসবে না।
দেশে-বিদেশে যখন বাংলাদেশের লুটেরাদের, ঋণখেলাপিদের, দুর্নীতিবাজদের, কালো টাকার মালিকদের জয়জয়কার; তখন অর্থমন্ত্রী তাদের টিকিটিও ছুঁতে পারছেন না। টাকা পাচারের ব্যাপারে তো অর্থমন্ত্রী তার অজ্ঞতার কথা স্বীকার করেছেন সংসদে দাঁড়িয়েই। রাঘববোয়ালদের ছোঁয়ার জো নেই, অর্থমন্ত্রী আসছেন চুনোপুঁটিদের মর্যাদা নিয়ে খেলতে।
অর্থমন্ত্রী তার বক্তব্যে এবং পরে বিভ্রান্তি দূর করতে দেওয়া ব্যাখ্যায় কীভাবে জমি বা ফ্ল্যাটের মালিকরা কালো টাকার মালিক বনে যান, তার বর্ণনা দিয়েছেন। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘ঢাকায় যাদের জায়গা-জমি বা ফ্ল্যাট আছে তারা সবাই কালো টাকার মালিক। এজন্য সরকার দায়ী, আমাদের সিস্টেম দায়ী।
গুলশান এলাকায় কেনা কোনো জমির যে দাম দেখিয়ে রেজিস্ট্রি করা হয় জমির প্রকৃত দাম তারচেয়েও বেশি। কিন্তু বেশি দামে তো রেজিস্ট্রি করতে পারবেন না। প্রত্যেকটা মৌজার জন্য দাম ঠিক করে দেওয়া আছে, এর বেশি দামে রেজিস্ট্রি করা যাবে না।
সুতরাং যেটি পারা যাবে না, কালো টাকা তো সেখানেই হয়ে আছে। কে কালো টাকার বাইরে আছে? সরকার এজন্য দায়ী। আমিও একসময় দায়িত্বে ছিলাম। ঢাকা শহরে জমির দাম বাড়ানো যায় কি না সেটা নিয়ে চিন্তা করলেও শেষ পর্যন্ত দাম বাড়াতে পারিনি। যে দাম ছিল সে দামই আছে।‘অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, ‘বাস্তবতা হচ্ছে, যে ফ্ল্যাট দুই কোটি টাকায় রেজিস্ট্রি হচ্ছে সেই ফ্ল্যাটের প্রকৃত দাম ১০ কোটি টাকা। ফলে সরকার বাড়তি রেজিস্ট্রেশন ফি পাচ্ছে না। এখানেই কালো টাকার উত্থান হচ্ছে। এ বিষয়গুলো সবাইকে বুঝতে হবে। ঢাকা শহরে যার জায়গা আছে কিংবা যে ব্যক্তি জায়গা কিনেছেন তিনিই শুধু বলতে পারবেন, কত টাকায় রেজিস্ট্রি হয়েছে এবং জায়গার প্রকৃত বাজার দর কত।’
মানলাম অর্থমন্ত্রী ভুল বলেননি। তিনি এজন্য সরকার এবং সিস্টেমকে দায়ী করেছেন। কিন্তু অর্থমন্ত্রী যদি সিস্টেমকে দায়ী করেন, তবে সিস্টেম বদলাবে কে? ‘কালো টাকার মালিক’ বাংলাদেশে একটা গালি হিসেবে পরিচিত। সরকার তাদের ধরতে পারুক আর না পারুক, আমরা তো অন্তত তাদের ঘৃণা করতে পারবো।
কিন্তু মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপার্জিত ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট বা এক টুকরো জমি কেনা সৎ মধ্যবিত্তদেরও যদি অর্থমন্ত্রী ‘কালো টাকার মালিক’ বানিয়ে দেন, তাহলে সেটা বড্ড অন্যায় হয়। আমি এমন অনেক মানুষকে চিনি, যারা ব্যাংক থেকে সুদও নেন না। তেমন মানুষও হয়তো সিস্টেমের দোষে ‘কালো টাকার মালিক’ বনে যান।
ঢালাওভাবে সবাইকে কালো টাকার মালিক বানিয়ে দিলে সত্যিকারের দুর্নীতিবাজ ও কালো টাকার মালিকদের এক ধরনের ছাড় দেওয়া হয়। সব কালো টাকার মালিকরা এক কাতারে চলে এলে সামাজিকভাবে প্রকৃত কালো টাকার মালিকরা একধরনের গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যান। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যটি যুক্তির খাতিরে সত্য হলেও তাতে মমতার ছোঁয়া নেই। মধ্যবিত্তদের সততার গর্বে তা আঘাত করবে। অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব হলো প্রয়োজনে জমির দাম বাড়ানো, সিস্টেম বদলানো।১৯ জুন, ২০২২
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/ফারুক/জিকেএস