মতামত

মানসম্মত শিক্ষায় বাধা অনিয়ম-দুর্নীতি

দেশে এই মুহূর্তে ৫১টি সরকারি ও ১০৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্ষেত্রবিশেষে গুণগত শিক্ষা প্রদানের তারতম্য রয়েছে। গুটিকয়েক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসম্মত শিক্ষা প্রদান করা হলেও অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে মানহীন গ্রাজুয়েট তৈরির বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।

Advertisement

অনেক সময় কর্তৃপক্ষ তা দেখেও না দেখার ভান করে। এদিকে দীর্ঘ করোনা অতিমারি সারা বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থাকে অনেকটা স্থবির করে দিয়েছে। তবে আশার কথা হলো বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থা এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। আমরাও এ ক্ষেত্রে মোটেই পিছিয়ে নেই। দিন দিন দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি শিক্ষার গুণগত মান। গত দুই দশকে শিক্ষার গুণগত মানের নিম্নমুখীধারা দেশবাসীকে ভাবিয়ে তুলেছে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষমতা কিছুদিন আগে পর্যন্ত গভর্নিং বডি বা ম্যানেজিং কমিটির ওপর ন্যাস্ত ছিল।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্থানীয় সংসদ সদস্য বা তাদের মনোনীত ব্যক্তিরাই ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। যদিও এখন আর তা আইনসিদ্ধ নয়। রাজনৈতিক বিবেচনায় এমন ব্যক্তিরা শিক্ষার উন্নয়নে যতটা না আগ্রহী তার চেয়ে হাজারগুণ বেশি আগ্রহী অনিয়ম, দুর্নীতি ও সীমাহীন স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ প্রদানে। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে মেধাবী নয় বরং নিয়োগ পেয়েছেন মেধাহীন ব্যক্তিরা।

একজন শিক্ষক গড়ে ৩০-৪০ বছর শিক্ষক হিসেবে পাঠদান করেন। ফলে দীর্ঘদিন ধরে এমন মেধাহীন শিক্ষক জাতি গঠনে অবদান রাখা তো দূরের কথা বরং মেধাহীন উচ্চশিক্ষিত বেকার তৈরি করতে ভূমিকা রাখছে। আমাদের দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে গবেষণা ও প্রশিক্ষণ খাতে বরাদ্দ খুবই অপ্রতুল। ফলে জ্ঞান বিজ্ঞানের নতুন নতুন শাখা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে সংযুক্ত হলেও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যোগ্য শিক্ষক তৈরির ক্ষেত্রে বরাবরই আমরা অনীহা প্রকাশ করে আসছি। শহরের চেয়ে গ্রামীণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও তার শিক্ষকদের অবস্থা আরও শোচনীয়।

Advertisement

গত দুই দশকে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে রাজনৈতিক পরিচয়ে মেধাহীন ও অযোগ্য ব্যক্তিকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদানের একটা ধারা সৃষ্টি করা হয়েছে। বিভাগের প্রথম স্থান অধিকারীকে বাদ দিয়ে অনিয়ম, দুর্নীতি ও দলীয় রাজনৈতিক বিবেচনায় আবেদন করার যোগ্যতাই নেই এমন ব্যক্তিকেও শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে।

যে ছেলেটি মেধাতালিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে একদিন ভর্তি হতে পারেনি সে কি না কোনো এক আলাদিনের চেরাগের স্পর্শ পেয়ে আজ একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। অনেকের আবার আবেদন করার যোগ্যতাই ছিল না। তাতে কি? আত্মীয়স্বজন, ছেলে-মেয়ে, মেয়েজামাইকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগদানের জন্য অত্যন্ত দৃষ্টিকটু ভাবে কাঙ্ক্ষিত মার্কস বা সিজিপিএ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। বঞ্চিত করা হয়েছে মেধাবীদের। এখন তো আবার ফেল করা দ্বিতীয় শ্রেণি প্রাপ্তকেও একটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে রাতের আঁধারে মানবিক কারণে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। যে কি না ছাত্র জীবনে মেধারভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতাই অর্জন করতে পারেনি।

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে সরকারের পক্ষ থেকে যে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয় তার সিংহভাগই ব্যয় হয় শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা খাতে আর দালান-কোঠা নির্মাণে। গবেষণা খাতের বরাদ্দ শুধু কমই নয় অপ্রতুলও বটে। এবারের বাজেটেও শিক্ষাখাতের শুধু অপ্রতুলই নয় বরং তা জিডিপির ৩ শতাংশের নিচে। পাশের দেশসমূহে যেখানে শিক্ষাখাতের বরাদ্দ ৫ শতাংশ বা তার ওপরে। সরকারি ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মানোন্নয়নের জন্য কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। এক সময় বিদেশি স্কলারশিপ মেধারভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে বণ্টন করার প্রচলন থাকলেও এখন তা সরকারি আমলারা নিজেরাই ভাগবাটোয়ারা করে নেয়, যা তাদের পেশাগত উৎকর্ষ বৃদ্ধিতে তেমন কোনো কাজে আসে বলে মনে হয় না। উন্নত বিশ্বে গবেষণা খাতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করা হলেও আমাদের ক্ষেত্রে তা একেবারেই নগণ্য।

দেশের মাদরাসা শিক্ষার অবস্থা তো আরও শোচনীয়। যোগ্য ও মেধাবী আলেম শিক্ষকের অভাব দেশে এই মুহূর্তে প্রকট আকার ধারণ করেছে। সরকারি তিনটি মাদরাসার অবস্থা তো আরও সংকটাপন্ন। শিক্ষক স্বল্পতা ও কোন কোন ক্ষেত্রে অধ্যক্ষ হিসেবে আলেমদের পরিবর্তে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিদের নিয়োগ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।

Advertisement

সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে দেশের সব মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল-কলেজ পরিচালনার জন্য স্থাপিত শিক্ষা অধিদপ্তর পরিচালিত হয় কলেজের একজন সিনিয়র অধ্যাপক দ্বারা। বলতে গেলে মাউশির ছোটবড় সব কর্মকর্তা কলেজ শিক্ষক। অথচ মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ অধিকাংশ কর্মকর্তা সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত। ফলে মাদরাসা শিক্ষা আজ খেই হারিয়ে ফেলেছে। আমরা সবাই জানি যে, সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার প্রথম স্তর হলো প্রাথমিক শিক্ষা, যা সরকারের একটি অগ্রাধিকার খাত। মাদরাসা শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রাথমিক স্তর হলো এবতেদায়ি শিক্ষা, যা আজ চরমভাবে অবহেলিত ও উপেক্ষিত।

মাদরাসা শিক্ষাকে টিকিয়ে রাখতে হলে এবতেদায়ি শিক্ষার আধুনিকায়নের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। এবতেদায়ি শিক্ষকদের জাতীয় বেতনের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। না হলে মাদরাসা শিক্ষা অচিরেই ছাত্র সংকটে পতিত হবে। দেশে কওমি মাদরাসা বলে আরেক ধরনের ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থা চালু রয়েছে। বর্তমান সরকার কর্তৃক তাদের ‘দাওরায়ে হাদিস’কে মাস্টার্স সমতুল্য মান দেওয়া হয়েছে। ভালো কথা। কিন্তু তাদের কোন ডিগ্রিটি এসএসসি, এইচএসসি বা ডিগ্রির সমতুল্য তা কিন্তু কেউ জানে না। এ এক অদ্ভুত ধরনের স্বীকৃতি।

আগেই বলেছি যে, স্বাধীনতার পর দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে। সঙ্গতভাবেই শিক্ষার্থীদের সংখ্যাও বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রামের কলেজগুলোতে অপরিকল্পিত ভাবে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু করে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। কিন্তু শিক্ষার মানের কোনো উন্নয়ন হয়নি।

এবার আসা যাক দেশের শিক্ষা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্রমাবনতিশীল মানের দিকে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কোয়াককোয়ারেল সাইমন্ডস (কিউএস) ২০২২ সালের জন্য বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাংকিং প্রকাশ করেছে। তাতে প্রথম ৮০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালল বা বুয়েটের অবস্থান নেই। গত বছরের মতো এ বছরের তালিকায়ও দেশের শীর্ষ দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ৮০১ থেকে ১০০০ এর মধ্যে রয়েছে। কিউএস তাদের তালিকায় ৫০০ এর পরে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান সুনির্দিষ্ট করে উল্লেখ করে না। প্রতিষ্ঠানটি একাডেমিক খ্যাতি, চাকরির বাজারে সুনাম, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত, শিক্ষকপ্রতি গবেষণা-উদ্ধৃতি, আন্তর্জাতিক শিক্ষক অনুপাত ও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী অনুপাতের ভিত্তিতে বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাংকিং করে।

২০১২ সালে কিউএস’র তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল ৬০১ এর মধ্যে। ২০১৪ সালে তা পিছিয়ে ৭০১তম অবস্থানের পরে চলে যায়। ২০১৯ সালে তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান আরও পেছনের দিকে চলে যায়। দেশের শীর্ষ দুটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি ও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি কিউএস’র তালিকায় ১০০১ থেকে ১২০০তম অবস্থানের মধ্যে রয়েছে।

গত ১০ বছরের মতো এবারও তালিকায় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি)। এছাড়া ২০২২ সালের তালিকায় শীর্ষ পাঁচে রয়েছে ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড, স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব ক্যামব্রিজ ও হার্ভাড ইউনিভার্সিটি। গত বছরের মতো এবারও বিশ্বের ১০০টি সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় এশিয়ার ২৬টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেয়েছে। এশিয়ার শীর্ষ দুটি বিশ্ববিদ্যালয় হলো-সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর ও নানিয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটি। তালিকায় এদের অবস্থান যথাক্রমে ১১তম ও ১২তম।

এছাড়া শীর্ষ ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ভারতের আটটি ও পাকিস্তানের তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ চিত্র হতাশাজনক। দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মানের এই ক্রমাবনতি আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় ভিসি নিয়োগ, মেধার পরিবর্তে অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগই এমন ক্রমাবনতিশীল পরিস্থিতির জন্য অনেকাংশে দায়ী। এছাড়া গবেষণা খাতে অপ্রতুল অর্থ বরাদ্দ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।

এছাড়া শিক্ষা প্রশাসনের দুর্নীতি আজ অনেকটা ওপেন সিক্রেট। সম্প্রতি মাধ্যমিক পর্যায়ের এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষক নিয়োগে সাড়ে তিন লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ‘আর্থিক লেনদেনের’ তথ্য উঠেছে টিআইবির এক গবেষণায়। এর বাইরে অন্যান্য নিয়োগ, বদলি, নতুন পাঠদান, শ্রেণি শাখা, বিভাগ ও বিষয় অনুমোদন এবং শিক্ষকদের উচ্চতর স্কেল অনুমোদনেও অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে।

সম্প্রতি টিআইবি ‘মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশকালে এসব তথ্য তুলে ধরে। টিআইবি বলছে, এসব অনিয়মে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির সদস্য, প্রধান শিক্ষক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) কর্মকর্তা-কর্মচারী, বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছে সংস্থাটি।

মাউশি ও এর অধিনস্ত কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী, শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মচারী, পরিচালনা কমিটি, অন্যান্য অংশীজন, শিক্ষা বিশেষজ্ঞ এবং গণমাধ্যমকর্মীসহ ৩২৫ জন ‘মুখ্য তথ্যদাতার’ সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে টিআইবি। এছাড়া মাউশির বিভিন্ন কার্যালয় এবং ৫৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছে সংস্থাটি। এছাড়া নীতিমালা লঙ্ঘন করে অনিয়মের মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি হচ্ছে বলেও প্রতিবেদনে জানানো হয়।

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, এখনো এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রধান শিক্ষকসহ কয়েকটি পদে নিয়োগ প্রদান করে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটি। বিষয়ভিত্তিক সহকারী শিক্ষক ও প্রভাষক নিয়োগ দেয় এনটিআরসি। এসব নিয়োগে পরিচালনা কমিটির রাজনৈতিক প্রভাব, স্বজনপ্রীতি ও অর্থ আদায়ের তথ্য এসেছে প্রতিবেদনে।

এক্ষেত্রে এনটিআরসিএ এর সুপারিশ করা সহকারী শিক্ষকের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগদানে ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয় বলে টিআইবি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। সহকারী গ্রন্থাগারিক নিয়োগে দুই থেকে সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয় বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এছাড়া শিক্ষক এমপিওভুক্তিতে ৫ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা এবং শিক্ষক বদলিতে এক থেকে দুই লাখ টাকা লেনদেনে মাউশির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জড়িত বলে গবেষণার তথ্যে উঠে এসেছে বলে জানিয়েছে টিআইবি। অর্থ না দিলে শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্তি ঝুলে যায় বলেও অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও নিরীক্ষায় ৫০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা লেনদেন করেন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের অনেক কর্মকর্তা।

প্রতিবেদনে বলা হয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নতুন পাঠদান অনুমোদনে তদবির করতে হয়। শ্রেণি শাখা, বিভাগ, বিষয় অনুমোদন এবং শিক্ষকদের উচ্চতর স্কেল অনুমোদনে অর্থ আদায়ের অভিযোগও রয়েছে। পাঠদান অনুমোদনের ক্ষেত্রে ১ থেকে ৫ লাখ টাকা লেনদেন করছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠদান ও একাডেমিক স্বীকৃতি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বোর্ডের মাধ্যমে হয়। টিআইবি জানিয়েছে, প্রাপ্যতা না থাকলেও রাজনৈতিক সুপারিশে পরিদর্শন ছাড়াই অনেক ক্ষেত্রে অনুমোদন দেওয়া হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণেও অর্থ আদায়ের অভিযোগও রয়েছে। স্বীকৃতি নবায়নের ক্ষেত্রে ৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করেন শিক্ষা বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী।

প্রতিবেদনে জানানো হয়, একই প্রতিষ্ঠানে চাকরির তিন বছর পর শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বদলির বিধান থাকলেও তা করা হয় না। কোচিং বাণিজ্যসহ অন্যান্য সুবিধা নিতে তদবির করে বদলি বা একই স্থানে অবস্থান করছেন অনেকে। এছাড়া কেনাকাটায় অতিরিক্ত বিল তৈরি, পছন্দের ব্যক্তিকে কাজ দেওয়া, প্রশিক্ষণে অনিয়মসহ নানা অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়নে প্রয়োজনীয়তা যাচাই না করেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সুপারিশে বরাদ্দ দেওয়া হয়। পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের নিরীক্ষায় জাল সনদ, নিয়োগে অনিয়ম, অর্থ আত্মসাৎসহ অন্যান্য অনিয়ম থাকার কথা জানিয়ে টিআইবি।

অনিয়ম থাকার পরও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুকূলে প্রতিবেদন দিতে উপরের মহলের প্রভাব খাটানো হয়। পাশাপাশি দুর্বলতা ঢাকতে পরিদর্শককে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেমন অর্থ প্রদান করে, তেমনি পরিদর্শকও নানা উপায়ে অর্থ আদায় করেন। একই সঙ্গে প্রধান শিক্ষক পরিদর্শকের ভয় দেখিয়ে অন্য শিক্ষকদের থেকে অর্থ আদায় করেন।

টিআইবি বলছে, ‘অনেক অশিক্ষিত লোক’ ম্যানেজিং কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় শিক্ষকদের সঙ্গে কমিটির সমস্যা ও দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হচ্ছে বলেও দাবি টিআইবির। প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে পদক্ষেপের ঘাটতিতে অনিয়ম-দুর্নীতির বিস্তার হচ্ছে। শিক্ষা কার্যক্রম প্রক্রিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক প্রভাব, অনিয়ম ও আর্থিক দুর্নীতির যে অভিযোগ তাতে অনেকক্ষেত্রে দুর্নীতির প্রতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে। অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে এমপিওভুক্তির অনলাইন সফটওয়্যার আরও সহজ করা এবং ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করা, এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যায়ক্রমে জাতীয়করণ করা, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও সদস্যদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করার সুপারিশ করেছে টিআইবি।

সুপারিশে দরপত্র, কার্যাদেশ, প্রকল্পের ক্রয় ও নিরীক্ষা সংক্রান্ত হালনাগাদ তথ্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে বলা হয়েছে। এছাড়া শিক্ষানীতি-২০১০ অনুযায়ী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের খসড়া নিয়োগবিধি চূড়ান্ত করতে বলেছে টিআইবি।পাশাপাশি বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়ানো, এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের আর্থিক সুবিধা সামাজিক বাস্তবতায় বৃদ্ধি করা, দ্রুত অবসর ভাতা প্রদানে বাজেটে বরাদ্দ রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। টিআইবি নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষকদের অধিকতর দক্ষ করে তোলা এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতে বৈষম্য দূর করতে ব্যবস্থা নিতে বলেছে। টিআইবি জানিয়েছে, করোনাভাইরাসের কারণে ধনী-গরিব এবং শহর-গ্রামের মধ্যে শিক্ষা পাওয়ার বৈষম্য প্রকট হয়েছে, অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে।

এজন্য ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনা, শেখার ঘাটতি পূরণে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা জরুরি বলে মনে করে সংগঠনটি। দুঃখের সাথে বলতে হয় স্বাধীনতার পঞ্চম বছর পার হলেও আমরা আজও সর্বজনীন শিক্ষানীতি তৈরি করতে পারিনি। দেশে বহুধারার শিক্ষাক্রম চালু থাকার কারণে শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। ক্যাডেট ও ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাব্যবস্থা সমাজে শ্রেণি বৈষম্য সৃষ্টি করছে। ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়ছে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ।

একটা কথা আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে যে, শিক্ষা বাঁচলে দেশ বাঁচবে। দেশ বাঁচলে জাতি হিসেবে আমরা বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে সামনে এগিয়ে যেতে পারবো। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে সব অনিয়ম দুর্নীতি কঠোরহস্তে দমন করা জরুরি। শিক্ষার গুণগতমানের ক্রমাবনতি ঠেকাতে শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতিতে রাজনৈতিক বিবেচনা নয় বরং মেধা ও যোগ্যতাকে গুরুত্ব দিতে হবে। গবেষণা ও শিক্ষক প্রশিক্ষণে বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। অন্যথায় দেশের শিক্ষার মানের ক্রমাবনতি ঠেকানো যাবে না।

লেখক: প্রফেসর, আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। drhasnat77@gmail.com

এইচআর/ফারুক/জিকেএস