মীম নোশিন নাওয়াল খান
Advertisement
ছোট থেকেই গুহা এক দারুণ বিস্ময় আমার কাছে। পরিবারের সঙ্গে সাজেক ভ্যালি ঘুরতে গিয়ে ফেরার পথে আলুটিলা গুহা ছিল আমার কাছে বিশাল এক অ্যাডভেঞ্চার। আমেরিকায় যেহেতু নানা ধরনের প্রাকৃতিক বিস্ময় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সব জায়গায়, বিস্ময়কর গুহার সংখ্যা এখানে কম নয়।
আমি পেনসিলভানিয়ার সীমান্তের কাছে থাকি। এখান থেকে ম্যারিল্যান্ড, ডেলাওয়্যার, নিউ জার্সি, ভার্জিনিয়া- এসব স্টেট খুব কাছে। তবে সবচেয়ে কাছে ম্যারিল্যান্ড। সেখানকার বুনসবরো শহরে আছে এক প্রাকৃতিক বিস্ময়ে ভরপুর গুহা, যার নাম ক্রিস্টাল গ্রটোজ।
এই গুহার কথা আমি প্রথম শুনি আমার বন্ধু ব্রেইডেনের কাছ থেকে। সে এর আগে ওখানে গেছে। টেনেসির দ্য লস্ট সি নামক গুহার ভেতরে বিশাল এক হ্রদ দেখে আমি যখন মুগ্ধ হেই। তখন ব্রেইডেনই বলেছিল, আমার নাকি অবশ্যই ক্রিস্টাল গ্রটোজে যাওয়া উচিত। সেখানে অতো বড় হ্রদ না থাকলেও গুহার ভেতরটা অনেক বেশি সুন্দর। প্রতি স্কয়ার ফুট অনুযায়ী ঘনত্বের দিক দিয়ে মানুষের জানা সবচেয়ে বেশি ক্রিস্টাল ফর্মেশন থাকা গুহা এই ক্রিস্টাল গ্রটোজ।
Advertisement
তাই শনিবারে টিপ টিপ বৃষ্টি থাকলেও রওনা হয়ে গেলাম ক্রিস্টাল গ্রটোজ কেইভার্নের উদ্দেশ্যে। গুহার ভেতরে যাব যেহেতু, বৃষ্টি তো আর কোনো সমস্যা করবে না। আমাদের ক্যাম্পাস থেকে এই গুহার দূরত্ব গাড়িতে এক ঘণ্টা।
গুগল ম্যাপ অনুযায়ী গাড়ি থামল যেখানে- সেটা আসলে আমি আশা করিনি। রাস্তার দু’ধারে শস্যক্ষেত। কিছু গরু চড়ে বেড়াচ্ছে মাঠে। ছোট একটা নালা চলে গেছে মাঠের পাশ দিয়ে। তারই পাশে পার্কিং লট।
পার্কিং লটের অন্যপাশে একটা টিলা। সামনে একটা ছোট পাথরের দালান, তার গায়ে লাল-সাদা রঙে বড় বড় করে লেখা ক্রিস্টাল গ্রটোজ কেইভার্ন। ভেতর থেকে একজন প্রবীণ নারী বেরিয়ে এসে আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানালেন।
তিনি বললেন, প্রতি আধা ঘণ্টায় গুহার ট্যুর আছে। একটা ট্যুরই এখনই শুরু হবে। আমরা চাইলে সেই ট্যুরে যেতে পারি। ভেতরে ঢুকে টিকিট কাটতে হলো। টিকিটের মূল্য জনপ্রতি ২০ ডলার। বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা আমাদের টিকিট দিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন ট্যুর গাইডের সঙ্গে।
Advertisement
ট্যুর গাইড এক হাসিখুশি তরুণ। ছেলেটা আমাদেরকে পথ দেখিয়ে দিল গুহায় ঢোকার। টিকিট কাউন্টারের পাশ দিয়েই একটা সিঁড়ি নেমে গেছে। সেখান দিয়েই আমরা নামলাম। সিঁড়ি দিয়ে নেমেই আমরা যেন চলে এলাম এক অন্য জগতে!
হুট করেই নিজেদেরকে আবিষ্কার করলাম একটা গুহার ভেতর। আমাদের চারপাশে, মাথার উপর বিভিন্ন ধরনের মিনারেলের ফরমেশন। এই ফরমেশনগুলোর জন্যই গুহাটার এমন নাম। হালকা ঘিয়েরঙা থেকে শুরু করে গাঢ় বাদামি রঙের নানা রকম ফরমেশন।
দেখে মনে হয় যেন তরলজাতীয় কিছু উপর থেকে পড়তে পড়তে হঠাৎ জমে বরফ হয়ে গেছে। শীতকালে ঠান্ডার দেশগুলোতে যেমন পানির ফোঁটা পড়তে পড়তে বরফ হয়ে যায়, তেমন আকার ফরমেশনগুলোর। তবে এই ফরমেশনগুলো কিন্তু একদিনে তৈরি হয়নি।
এই গুহার কিছু কিছু ফরমেশন তৈরি হয়েছে ১০০ মিলিয়ন বছরেরও বেশি সময় ধরে। এই ফরমেশনগুলো তৈরি হয়েছে ক্যালশিয়াম কার্বোনেট থেকে। ক্যালশিয়াম কার্বোনেটকে এই গুহায় প্রবেশ করে এ ধরনের পাথুরে ফরমেশন তৈরি করতে প্রথমে কার্বোনেশন ওএরপর ডিকার্বোনেশন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।
বৃষ্টির পানির সাথে বাতাসে থাকা কার্বন ডাইঅক্সাইডের রাসায়নিক বিক্রিয়া হয়ে তৈরি হয় কার্বনিক অ্যাসিড। ক্যালশিয়াম কার্বোনেট এই কার্বনিক অ্যাসিডের সাথে মিশে কঠিন থেকে তরল ক্যালশিয়াম বাইকার্বোনেট তৈরি করে। পানির ফোঁটার সাথে ক্যালশিয়াম বাইকার্বোনেট যখন গুহায় প্রবেশ করে, পানির ফোঁটা থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড বেরিয়ে যায়।
যেহেতু কার্বন ডাইঅক্সাইড আর নেই পানিতে, তাই পানিতে মিশে থাকা ক্যালশিয়াম কার্বোনেট তখন পানি থেকে বেরিয়ে ক্রিস্টাল তৈরি করে। ক্যালশিয়াম কার্বনেটে তৈরি এই ক্রিস্টাল ফরমেশনগুলোকে ক্যালশাইট বলা হয়। এ ধরনের ক্রিস্টাল তৈরি হতে অনেক সময় লাগে। এক কিউবিক ইঞ্চি ক্রিস্টাল তৈরি হতে ১০০-১৫০ বছর লাগে!
ক্রিস্টাল গ্রটোজ গুহায় যে ক্রিস্টাল ফরমেশন দেখা যায়, সেগুলো এক ইঞ্চির চেয়ে ছোট থেকে শুরু করে কয়েক ফুট লম্বা ওমোটা সব রকমের। এতে করে বোঝা যায়, এই ক্রিস্টালগুলো তৈরি হয়েছে শত মিলিয়ন বছর ধরে।
পাথুরে গুহাটায় কয়েকটা ঘর আছে। ঘরগুলো খুব বড় নয়। সবচেয়ে বড় যে ঘরটা, যার নাম ব্ল্যাঙ্কেট রুম- সেটি ৩০ ফুট লম্বা ও ২০ ফুট চওড়া। পুরো গুহাটাই ভর্তি ক্রিস্টাল দিয়ে। মনে হয় যেন কোনো ভাস্কর অনেক সময় ধরে গুহাটা কেটে কেটে ভাস্কর্য বানিয়েছেন।
মাথার উপর ক্রিস্টালের কারুকাজ যে প্রাকৃতিক ঘটনা, তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। আমাদের ট্যুর গাইড আমাদেরকে দেখাল বিভিন্ন আকৃতির ক্রিস্টাল- যেগুলোকে বিভিন্ন প্রাণীর আকৃতির সঙ্গে মেলানো যায়।
সাথে আমরা দেখলাম বিশাল বড় ও লম্বা কিছু ক্রিস্টাল যেগুলো উপর থেকে ঝুলে আছে সেগুলো কতটা পাতলা। গুহার ভেতরের বৈদ্যুতিক আলো সেই ক্রিস্টালগুলোর এপাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত যেতে পারে।
গুহার ভেতর একটা ছোট্ট হ্রদ বা পুকুর আছে। এটাকে ট্যুর গাইড হ্রদ বললেও এটা আসলে খুবই ছোট- একটা ডোবার চেয়েও ছোট ও অগভীর। এই পানি সর্বোচ্চ একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের হাঁটু পর্যন্ত উঠবে বা তার চেয়েও কম।
এই পানি আসে মূলত ক্রিস্টাল থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় পড়তে থাকা পানি থেকে। এই পানিতে স্যালাম্যান্ডার নামে এক ধরনের টিকটিকির মতো দেখতে উভচর প্রাণী বাস করে। আমাদের ট্যুর গাইড টর্চের আলোয় কয়েকটা বাচ্চা স্যালাম্যান্ডার দেখালো আমাদেরকে।
ক্রিস্টাল গ্রটোজ কেইভার্ন পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করা বাণিজ্যিক গুহা। অর্থাৎ মানুষের নিয়মিত যাতায়াত ও রক্ষণাবেক্ষণ সত্ত্বেও এই গুহাটি যতটা সম্ভব প্রাকৃতিক অবস্থায় সংরক্ষণ করা হয়েছে। সেজন্য গুহার যে কোনো কিছু ছোঁয়া নিষেধ, বিশেষত যে কোনো ক্রিস্টাল।
আমাদের ট্যুর গাইড ছেলেটি আমাদেরকে বললো কীভাবে ১৯২০ সালে রাস্তা তৈরি করতে গিয়ে গুহাটি প্রথম আবিষ্কৃত হয়। রাস্তা তৈরির জন্য খননকাজের সময়ে ড্রিল মেশিনের একটা বিট মাটির নিচে হারিয়ে যায়। এমন অদ্ভুত ঘটনা কেন ঘটল সেটা খুঁজে বের করতে গিয়েই আবিষ্কৃত হয় নিচে লুকিয়ে থাকা এই গুহা।
ডিনামাইট দিয়ে সেই ড্রিল হারিয়ে যাওয়ার জায়গাটাকে ভেঙে এই গুহার প্রথম প্রবেশ পথ তৈরি করা হয়। ১৯২২ সালে এই গুহাটি একটি বাণিজ্যিক গুহা হিসেবে যাত্রা শুরু করে। মাত্র ৭ সেন্ট ছিল তখন এখানে ঢোকার টিকিটের মূল্য!
এখন যদিও সেই টিকিটের মূল্য প্রায় ৩০০ গুণ হয়ে গেছে। এই গুহায় ঢুকে যে প্রাকৃতিক আশ্চর্য আপনি দেখবেন, তার কাছে ২০ ডলার কোনো ব্যাপার না। ক্রিস্টাল গ্রটোজ গুহা শুধু প্রাকৃতিক বিস্ময় নয়, পৃথিবীর ভেতরে অন্য এ জগত!
জেএমএস/এমএস