মতামত

আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে সিলেটের বন্যা

বর্ষা আসে, সঙ্গে আসে বন্যা। বন্যা নিয়ে প্রায় প্রতি বছরই ভোগান্তির চিত্র চোখে পড়ে। বর্তমানে সিলেটসহ দেশের কয়েকটি জেলায় বন্যায় প্লাবিত হওয়ায় সেখানকার জনজীবন বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। বন্যায় মানুষ ও পশুপাখি ভয়াবহ দুর্গতির আশঙ্কায় রয়েছে। সিলেটে প্রথম দফা বন্যার ক্ষয়ক্ষতি ও দুর্ভোগ কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই দ্বিতীয় দফার বন্যায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সিলেট অঞ্চল।

Advertisement

টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে হুহু করে বাড়ছে পানি। প্লাবিত হয়েছে সিলেট নগরসহ বেশ কয়েকটি উপজেলা। বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে বন্যা ও বন্যা-পরবর্তী সময়ে নানা ধরনের রোগবালাই দেখা যায়। এর মধ্যে পানি ও কীটপতঙ্গবাহিত রোগের সংখ্যাই বেশি। বন্যার সময় ময়লা-আবর্জনা, মানুষ ও পশুপাখির মলমূত্র এবং পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা একাকার হয়ে এসব উৎস থেকে জীবাণু বন্যার পানিতে মিশে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে বন্যায় সংক্রামক ব্যাধির বিস্তার বেড়ে যায়।

বাংলাদেশে কয় রকমের বন্যা হয়?

বাংলাদেশ বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, দেশে চার ধরনের বন্যা হয়। এগুলো হচ্ছে-

Advertisement

> মৌসুমি জলবায়ুর প্রভাবে নদ-নদীর পানির উচ্চতা বৃদ্ধিজনিত বর্ষাকালীন বন্যা।

> আকস্মিক (পাহাড়ি ঢল) বন্যা। এই বন্যা বাংলাদেশের উত্তরের কিছু এলাকা, উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্বাংশের পাহাড়ি অঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে হয়। এই বন্যার পানি দ্রুত বাড়ে এবং দ্রুতই আবার কমেও যায়। একই সঙ্গে পানি প্রবাহের গতিবেগ বেশি হয় এবং বন্যা হয় স্বল্প মেয়াদি।

> অপ্রতুল নিষ্কাশন ব্যবস্থাজনিত বন্যা। এ ধরনের বন্যা সাধারণত পর্যাপ্ত পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকার কারণে মাঝারি বা ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে পানি জমে কোনো কোনো এলাকায় বন্যা দেখা দেয়। এই বন্যার পানি খুব ধীরে কমে এবং বন্যা দীর্ঘ মেয়াদি হয়।

> সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে ঝড়-সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস বা জোয়ারের উচ্চতাজনিত বন্যা।

Advertisement

বাংলাদেশের কোন কোন এলাকায় একাধিক কারণে বন্যা হতে পারে।

এরই মধ্যে ভয়াবহ বন্যায় সিলেট-সুনামগঞ্জে পানিবন্দি ৪০ লাখ মানুষ-সিলেট ও সুনামগঞ্জের বেশিরভাগ এলাকাই প্লাবিত হয়ে পড়েছে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় ভয়াবহ বন্যায় অন্তত ৪০ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানি বাড়তে থাকায় এখনো নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। বন্যাকবলিত এলাকায় দ্রুত উদ্ধার ও ত্রাণের জন্য হাহাকারও বাড়ছে।

বিভিন্ন উপজেলা ছাড়াও বন্যা পরিস্থিতিতে সুনামগঞ্জ শহরের প্রায় শতভাগ প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া সিলেট মহানগরীর সুরমা নদী-তীরবর্তী সবকটি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকায় বিদ্যুৎ-পানিসহ সব ধরনের নাগরিক সুবিধা বন্ধ থাকায় দুর্ভোগ বাড়ছে।

সিলেট জেলায় গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, কানাইঘাট, জৈন্তাপুর, সিলেট সদর, জকিগঞ্জ, বিশ্বনাথ, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার ও মহানগরী বন্যাকবলিত হয়েছে। সুনামগঞ্জে পৌর শহর, সদর উপজেলা, ছাতক, দোয়ারাবাজার, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, মধ্যনগর, ধর্মপাশা, জামালগঞ্জ, জগন্নাথপুর, দিরাই বন্যাকবলিত হয়েছে।

> বাংলাদেশে প্রলয়ঙ্করী কয়েকটি বন্যার চিত্র

বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে ছোটবড় প্রায় ২৩০টি নদী বয়ে গেছে। মূলত এজন্যই অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের তুলনায় বন্যা বেশি হয়। সাধারণত এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ দেশে বন্যার প্রকোপ দেখা দেয়। এই সময়ে দেশের প্রধান নদী ও উপনদীগুলো হিমালয়ের বরফগলা এবং উজানের দেশগুলো থেকে নেমে আসা বৃষ্টিতে পানির উচ্চ প্রবাহে প্রবাহিত হয় এবং বন্যায় প্লাবিত হয়। ভেসে যায় ফসল, পশু-পাখি। তৈরি হয় মানবিক বিপর্যয়ও। প্রতি বছরই আমাদের ছোট-বড় বন্যার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তবে কোনো কোনো বছরের বন্যার ভয়াবহতা ভুলবার নয়।

বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির প্রেক্ষাপটেও ছিল সত্তরের ঘূর্ণিঝড় ও ছেষট্টির বন্যার দুঃসহ স্মৃতি। ১৯৭০ সালের মহাপ্রলয়ঙ্করী বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসে শুধু লোকই মারা যায় সরকারি হিসাবে ৫ লাখ। ওই বন্যায় উপকূলের ১৬ হাজার বর্গমাইল এলাকা প্লাবিত হয়েছিল। খাদ্যশস্য নষ্ট হয় ১২ লাখ ৯৮ হাজার টন। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২, ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে বন্যায় বিপুল ক্ষতি হয়েছিল।

এরপরও বাংলাদেশে বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটেছে বহুবার। বিশেষ করে ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৮ এবং ২০১৭ সালে প্রায় বাংলাদেশজুড়ে বড় বন্যা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জেলায় বন্যা হয়েছে বহুবার।

১৯৮৭ সালের বন্যা

সাতাশির এপ্রিল থেকেই দেশে প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত হচ্ছিল। নদ-নদীগুলো ভরে উঠেছিল সেই পানিতে। জুলাইয়ের শুরুর দিকে ভারতের নদীগুলো থেকে পানি নামতে শুরু করলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ব্রহ্মপুত্রের পশ্চিমাঞ্চল, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রের নিচু অঞ্চলগুলো বিশেষ করে খুলনার উত্তরাংশ এবং মেঘালয় পাহাড়ের সংলগ্ন অঞ্চল বন্যাকবলিত হয়। ১৯৮৭ সালে বন্যা স্থায়ী হয়েছিল জুলাই থেকে আগস্ট মাসের প্রায় শেষভাগ পর্যন্ত। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল দেশের প্রায় ৫৭ হাজার ৩০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা।

১৯৮৮ সালের বন্যা

আটাশির বন্যা ছিল বাংলাদেশে বন্যার ইতিহাসে ল্যান্ডমার্ক। এখনো অনেকে কথা প্রসঙ্গে আটাশির ভয়ংকর বন্যার উদাহরণ টানেন। বর্ষার প্রায় শেষ ভাগে আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর মাস স্থায়ী এই বন্যায় দেশের প্রায় ৮২ হাজার বর্গকিলোমিটার অর্থাৎ ৬০ শতাংশ এলাকা ডুবে যায়। বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার কারণে প্রচণ্ড জনদুর্ভোগ হয়েছিল সেই বন্যায়। সেই জনদুর্ভোগ বিশ্ব গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ায় আটাশির বন্যা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

সাতাশি সালের মতো আটাশির প্রলয়ংকারী বন্যার মূল কারণও ছিল সারাদেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত ও ভারতের নদ-নদী থেকে নেমে আসা পানি। দেশের প্রধান তিনটি নদীর পানিপ্রবাহ বেড়ে রাজধানী ঢাকা শহরও বিপুলভাবে প্লাবিত হয়েছিল সেই বন্যায়। রাজধানীর ৬০ লাখ মানুষের মধ্যে প্রায় ৫০ লাখ হয়ে পড়েছিল ঘরবন্দি।

ধানমন্ডি, শেরেবাংলা নগর, গুলিস্তান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার কিছু অংশ ছাড়া রাজধানীর প্রায় সব এলাকাই জলমগ্ন হয়েছিল। সে বছর ঢাকায় প্রায় ৪০০ ত্রাণশিবির খোলা হয়েছিল। এসব ত্রাণশিবিরে আশ্রয় নিয়েছিল প্রায় ৫ লাখ বন্যার্ত। ওই বন্যায় মারা যায় প্রায় ২৩০ জন। এছাড়া কয়েক হাজার গবাদিপশুর মৃত্যু হয়েছিল। সেই সময়ের হিসাবে কয়েক হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।

১৯৯৮ সালের বন্যা

’৯৮ এর বন্যা ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী বন্যা। আড়াই মাসেরও বেশি সময়জুড়ে চলা এ বন্যায় দেশের প্রায় ৬৮ শতাংশ এলাকার ১ লাখ ২৫০ বর্গকিলোমিটার প্লাবিত হয়। অর্থাৎ দেশের ৫২টি জেলাসহ মোট আয়তনের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা ডুবে যায়। ওইসব এলাকার অসংখ্য মানুষ হয়ে পড়েন ঘরবন্দি। সেবারের বন্যার কারণও ছিল একই— সারাদেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে আসা পানির ঢল।

প্রায় ৮০ দিন স্থায়ী এই বন্যায় সাড়ে ৩ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। প্রায় ৬৫ হাজার হেক্টর ফসলি জমি পানিতে ডুবে ছিল দীর্ঘদিন। ফলে ওই বছর খাদ্য ঘাটতি হয় প্রায় ২১৮ লাখ মেট্রিক টন। ’৯৮ এর বন্যার শেষ দিকে ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়েছিল। ওই বছর শিশুসহ মারা যায় ১৫ শতাধিক মানুষ।

২০০০ সালের বন্যা

অনেকটা আকস্মিকভাবেই এসেছিল ২০০০ সালের বন্যা। ওই বছরের আগস্টে ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ সীমান্তবর্তী কয়েকটি জেলায় বন্যার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। আগস্টের শেষ সপ্তাহে পশ্চিমবঙ্গের একটি বড় মাটির বাঁধ ভেঙে যায়। এতেই হুড়মুড় করে পানি ঢুকতে থাকে বাংলাদেশে। বন্যায় রাতারাতি বিধ্বস্ত হয় ভারতের সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পাঁচটি জেলা।

আগস্ট-সেপ্টেম্বরব্যাপী ওই বন্যায় বাংলাদেশের ৯টি জেলার প্রায় ৪১টি উপজেলার ২৮০টি ইউনিয়নের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফসলের ক্ষতি হয়েছিল ব্যাপক। ৮ লাখের বেশি মানুষ ঘরবাড়ি হারায়। প্রায় ৩০ লাখ লোক এ বন্যায় প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

২০০৭ সালের বন্যা

এই বছরটি ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগের বছর। একই বছর বন্যা, খরা, নদীভাঙন, ভূমিধস, অতিবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস সামাল দিতে হয়েছিল বাংলাদেশকে। ২০০৭ সালের বন্যাও ছিল ‘৯৮ এর বন্যার মতো দীর্ঘস্থায়ী ও সর্বব্যাপী। সেপ্টেম্বর মাসের এ বন্যায় দেশের মোট আয়তনের ৬২ হাজার ৩০০ বর্গকিলোমিটার অর্থাৎ ৪২ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছিল।

জুলাইতে প্রথম ধাপে এক বন্যার পর সেপ্টেম্বরে দেশে আকস্মিকভাবে আবারও অস্বাভাবিক বন্যা হয়। ডুবে যায় ৪২ হাজার হেক্টর ফসলি জমি। পরপর দুবারের বন্যায় প্রায় ১৪ লাখ টন খাদ্যশস্য নষ্ট হয়। ওই বছর খাদ্য ঘাটতি হয়েছিল প্রায় ১৯ লাখ টন।

২০১৭ সালের বন্যা

এলাকাভিত্তিক ‘অতি ভয়াবহ’ এই বন্যায় দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলো ভয়ংকর ক্ষতির মুখে পড়ে। জুলাই-আগস্ট মাসের এই বন্যায় দেশের প্রায় ৩৭ হাজার হেক্টর ফসলি জমি ডুবে যায়। বিশেষ করে রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, বগুড়া, গাইবান্ধা, জয়পুরহাট, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় ও নীলফামারী এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট ও সুনামগঞ্জ অতি ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে।

২০১৯ সালেও ৬০ বছরের রেকর্ড ভেঙে অক্টোবরেও বন্যা হয়েছিল।

২০২০ সালেও বাংলাদেশের উত্তর, উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাংশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এ বন্যায় ৩০টির বেশি জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুহারা হয়েছে। প্রায় ৮ লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় খুবই মানবেতর জীবনযাপন করেছে। মৃত্যুর সংখ্যা হিসাব করলে দেখা যায়, শতাধিক মানুষ মারা গেছে। দেশে একদিকে কোভিড-১৯, অন্যদিকে ভয়াবহ বন্যার প্রাদুর্ভাবে অসংখ্য মানুষ কর্মহীন হওয়ায় অর্থনীতি ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। আজকের বিষয় নিয়ে কলাম লিখেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট গবেষক ও জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা ডা. এম এম মাজেদ। তার কলামে লেখেন... বন্যায় যোগাযোগব্যবস্থা, ঘরবাড়ি, শস্যক্ষেত্র, গবাদিপশুর ক্ষতির সাথে সাথে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির আশংকাও থাকে। বন্যার সময় বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। কখনো কখনো রোগগুলো মহামারি আকারও ধারন করতে পারে।

প্রিয় পাঠক, চলুন জেনে নেওয়া যাক বন্যায় পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ার কারণ ও প্রতিকারের উপায়গুলো।

বন্যার সময় যেসব রোগ হতে পারে সেগুলো হচ্ছে:

১. পেটের পীড়া: পেটের পীড়া নানা রকম হয় যেমন-

ক. ডায়রিয়া, কলেরা

খ. ডিসেন্ট্রি (আমাশয় ও রক্ত আমাশয়)

গ. টাইফয়েড

ঘ. ভাইরাল হেপাটাইটিস

২. বুকের প্রদাহ: কফ, কাশি, শ্বাসকষ্ট নিয়ে নিউমোনিয়া, ব্রংকাইটিস প্রভৃতি হয়। এক্ষেত্রে শিশুরাই বেশি আক্রান্ত হয়।

৩. জ্বর: নানা রকম ভাইরাল বা ব্যাকটেরিয়াল জ্বর হয়।

৪. চর্মরোগ: যেমন- খোস পাঁচড়া, ছত্রাকঘটিত সংক্রমণ প্রভৃতি চর্মরোগ হয়।

৫. চোখের প্রদাহ: যেমন- কনজাংটিভাইটিস, আইরাইটিস ইত্যাদি।

৬. সর্প দংশন: নানা রকম সর্প দংশনের ঘটনাও ঘটে থাকে।

৭. বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়া: বন্যার সময় শিশুরা অনেক সময় সাঁতার না জানার দরুন পানিতে ডুবে মারা যায়।

বন্যার সময় যেসব কারণে রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে, চলুন জেনে নিই-

অনিরাপদ খাদ্যদ্রব্য:

বন্যার পানিতে থাকে বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, মানুষ ও গবাদিপশুর বর্জ্যপদার্থ এবং বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ। খাদ্যদ্রব্যের সাথে এ পানির সংমিশ্রণ খাবারকে অনিরাপদ এবং স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর করে তোলে।

বন্যার সময় ইলেক্ট্রিসিটি সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, ফলে স্টোরড খাবারও নষ্ট হয়ে যায়। যেকোনো খাবার যদি বন্যার পানির সংস্পর্শে আসে, তাহলে তা খাবার অযোগ্য হয়ে পড়ে।

> দূষিত খাবার পানি

বন্যার সময় নিরাপদ পানির উৎসসমূহ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ফলে নিরাপদ এবং পানযোগ্য পানির মারাত্মক সংকট দেখা যায়। বন্যার পানির সাথে পানিবাহিত রোগেরও তখন আগমন ঘটে। ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফয়েড, চর্মরোগ, চোখের অসুখ প্রভৃতি সমস্যা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে।

> যথাযথ স্যানিটেশন ব্যবস্থার অভাব

বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় টিউবওয়েল এবং টয়লেট মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে বানের পানিতেই প্রাকৃতিক কর্ম সারতে হয় অধিকাংশ মানুষকে। আবার এই পানিতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজ করতে হয়। এভাবে স্যানিটেশন ব্যবস্থার মারাত্মক বিপর্যয় ঘটে।

> মশার প্রাদুর্ভাব

অবিরাম বর্ষণ ও বন্যায় মশার বংশবৃদ্ধির হার বেড়ে যায় এবং মশাবাহিত রোগসমূহ যেমন- ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু ইত্যাদি ছড়িয়ে পড়ে।

> মোল্ড

বন্যাদুর্গত মানুষজন যাদের এলার্জি অথবা হাঁপানি আছে, তাদের জন্য মোল্ডের (জীবাণুর বিশেষ অবস্থা) সংস্পর্শ বিপদ ডেকে আনতে পারে। বিভিন্ন ধরনের শ্বাসনালীর জটিলতা যেমন- গলা ব্যথা, চোখ ও নাক দিয়ে পানি পড়া, সর্দি ইত্যাদি হতে পারে। মোল্ড সংক্রান্ত স্বাস্থ্যঝুঁকিতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় শিশু, বৃদ্ধ এবং গর্ভবতী নারীরা।

>মানসিক চাপ এবং অবসাদ

এবার চলুন জেনে নিই বন্যার সময় সবধরনের প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবিলা করে সুস্থ থাকার পদ্ধতি এবং আক্রান্ত হলে আমাদের করণীয় কী:

বন্যা শুধু শারীরিক ক্ষতিই করে না বরং মানসিক চাপও তৈরি করে। প্রলয়ংকরী বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজন ভীষণভাবে দীর্ঘকালীন মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়। বন্যা-পরবর্তী ক্ষতিগ্রস্ত বাসস্থান ঠিক করা, অর্থনৈতিক সমস্যা মোকাবিলা করা ইত্যাদি বিষয়সমূহ মানসিক বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। বন্যা-পরবর্তী সময়ে যেসব মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে তাদের মধ্যে দুশ্চিন্তা, রাগ, হতাশা, অস্বাভাবিক নিদ্রালুতা, হাইপার অ্যাক্টিভিটি, ইনসোমনিয়া এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে আত্মহত্যার চেষ্টায়ও রূপ নিতে পারে।

°বন্যা মোকাবিলায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য ব্যবহার করা। আমরা এর আগে জেনেছি যে, প্রায় অধিকাংশ রোগই পানি ও খাদ্যবাহিত। তাই বিশুদ্ধ পানি ও টাটকা খাবারই এসব রোগ থেকে রক্ষা করতে পারে। পানিকে ছেঁকে কমপক্ষে আধাঘণ্টা ফোটাতে হবে। তাছাড়া, ফিটকিরি, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দিয়েও পানি বিশুদ্ধ করা যায়। প্লেট, গ্লাস, হাত ভালো করে বিশুদ্ধ পানি দিয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে। বাসি, নষ্ট খাবার পরিহার করতে হবে।

°বন্যার পানিতে বেশি হাঁটাচলা, গোসল করা পরিহার করতে হবে। এতে জ্বর, বুকের প্রদাহ, চর্মরোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।

°শিশুদের বিশেষ যত্ন নিতে হবে। অসাবধানতার কারণে পানিতে যাতে পড়ে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। শিশুদের শুষ্ক পরিবেশে এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন অবস্থায় রাখতে হবে।

°ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলে খাবার স্যালাইন খেতে হবে। ডায়রিয়া বা বমি বেশি হলে শিরায় স্যালাইন দিতে হবে। অতিমাত্রায় পাতলা পায়খানা, বমি হলে, রক্ত গেলে, জ্বর থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

°বৃষ্টি, ঝড়, বন্যার কারণে ঠান্ডা লেগে অনেক সময় কফ-কাশি, শ্বাসকষ্ট, জ্বর হয়। এক্ষেত্রে কিছু উপসর্গ নিরাময়ের ওষুধ সেবনের পরও উপকার না পেলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।

- বন্যার সময় চর্মরোগ দেখা দিলে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসকের সহযোগিতা নিতে হবে।

°সাপে কামড়ালে আক্রান্ত স্থানের ওপর মোটা কাপড় দিয়ে হালকা করে বেঁধে ক্ষতস্থান ভালো করে পরিষ্কার করে নিতে হবে। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। আক্রান্ত স্থানের নড়াচড়া যাতে কম হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

বন্যা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অসহনীয় এক অভিশাপ। একেকটা বন্যা আমাদের কয়েক বছরের জন্য পঙ্গু করে দিয়ে যায়। বন্যা প্রতিরোধে সার্বিক ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি জনসচেতনতাই পারে বন্যাকবলিত মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে দিতে।

পরিশেষে, মানুষের ঘরবাড়ি, সম্পদ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি বন্যা-পরবর্তী নানা ধরনের রোগব্যাধি দেখা দেয়। সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিলে ক্ষতি কমানো সম্ভব। সাধারণত পরিষ্কার পানির অভাবে ডায়রিয়া-কলেরাসহ পানিবাহিত রোগ দেখা দেয়। প্রয়োজনীয় ওষুধ ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের মাধ্যমে এসব পীড়া লাঘব করা যায়। এ সময় মানুষের জন্য পুনর্বাসন কার্যক্রম ও খাদ্য সরবরাহ জরুরি হয়ে পড়ে। আগে থেকে প্রস্তুত থাকলে পরিস্থিতি মোকাবিলা সহজ হয়।

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি। drmazed96@gmail.com

এইচআর/ফারুক/এমএস