মতামত

কুমিল্লা সিটি নির্বাচন যে বার্তা দিল

২০২৩ সালের সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতির মারপ্যাঁচ পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং জোট আগামী নির্বাচন সামনে রেখে তাদের নির্বাচনী পরিকল্পনা প্রণয়নে ব্যস্ত। সরকারি দলের পক্ষ থেকে সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা হলেও, বিরোধী দলের পক্ষ থেকে বর্তমান সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ব্যাপারে অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। যদিও দেশবাসীর ধারণা, এটি বিরোধী রাজনৈতিক জোটের একটি কৌশলমাত্র। ফলে সবাই বিশ্বাস করে যে সব দলের অংশগ্রহণে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

Advertisement

কয়েক মাস আগে দেশে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে। নির্বাচন কমিশন গঠন হওয়ার পর থেকেই বিরোধী দলগুলো এই কমিশনকে প্রত্যাখ্যান করলেও সুশীল সমাজ এবং জনগণের বেশিরভাগ অংশ এই নির্বাচন কমিশনকে গ্রহণ করে নিয়েছে। এর কারণ হলো যাদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে, তাদের কারও বিরুদ্ধে দলীয় আনুগত্যের তেমন কোনো অভিযোগ নেই। ফলে দায়িত্ব নেওয়ার পরে নতুন কমিশনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা ছিল কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন, যা অনুষ্ঠিত হয়েছে গত ১৫ জুন জুন।

এই কমিশনের অধীনে কয়েকটি ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা এবং পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও দেশবাসী তাকিয়ে ছিল কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের দিকে। নির্বাচন কমিশন কুমিল্লা সিটি করপোরেশ নির্বাচনকে কতটা অংশগ্রহণমূলক এবং গ্রহণযোগ্য করতে পারে-তার ওপর আগামী দিনের রাজনীতির অনেক কিছু নির্ভর করবে।

ফলে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে গত ১৫ জুনের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করলে সার্বিকভাবে এ কথা বলা যায় যে, নির্বাচন কমিশন অনেকটাই সফল হয়েছে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে। সাধারণ ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে, যা প্রমাণ করেছে নির্বাচন কতটা অংশগ্রহণমূলক এবং গ্রহণযোগ্য ছিল।

Advertisement

যে কোনো নির্বাচনের ফলাফলে একপক্ষ খুশি হয় এবং অন্যপক্ষ অখুশি হয়- এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় যে পক্ষ হেরে যায় সে পক্ষ থেকে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। গত ১৫ তারিখের নির্বাচনে ভোট গণনা শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত সব প্রার্থী নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে মর্মে মত দিয়েছিলেন। যদিও একজন প্রার্থীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যে ইভিএমের গতি কিছুটা ধীর হওয়ার কারণে ভোটারদের সমস্যা হচ্ছে। বিষয়টির সত্যতা থাকতেই পারে। তাছাড়া বাংলাদেশের বাস্তবতায় বেশিরভাগ মানুষের ইভিএমে ভোট প্রদানের অভিজ্ঞতা ছিল না। তাছাড়া ইন্টারনেটের গতির ওপর নির্ভর করে ইভিএমের গতি।

ইভিএমের গতি সংক্রান্ত কিছু সমস্যা থাকলেও ইভিএমের মাধ্যমে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে সাধুবাদ জানাতেই হবে। ইভিএম নিয়ে বিরোধী দলের বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ থাকলেও এর সপক্ষে তারা তেমন সুনির্দিষ্ট যুক্তি উপস্থাপন করতে পারেনি।

ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশনের তরফ থেকে ইভিএম ব্যবহারের খুটিনাটি বিষয় বিশেষজ্ঞ দলসহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে। তাদের উপস্থাপনার ওপর ভিত্তি করে বিশেষজ্ঞ দলের সদস্যরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, ইভিএমে কারচুপি করা অসম্ভব। যদিও তাদের এই যুক্তি বিরোধী দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি।

১৫ জুন অর্থাৎ ভোটের দিনের আগেও কুমিল্লার নির্বাচনের পরিস্থিতি অত্যন্ত ভালো ছিল। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের একে অপরের বিরুদ্ধে নিয়মভঙ্গের ছোটখাটো অভিযোগ ছাড়া তেমন কোনো সমস্যা তৈরি হতে দেখা যায়নি ভোটের আগে। এমনকি ইভিএমের ধীরগতির অভিযোগ ছাড়া ভোটের দিনের অন্য কোনো অভিযোগ কোন প্রার্থী উপস্থাপন করেননি। এর অর্থ হলো ভোটের পরিবেশ অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ ছিল।

Advertisement

আমরা সবাই জানি যে, বিরোধী দলের পক্ষ থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ফলে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার একটি প্রবণতা তৈরি হয়েছে। কিন্তু কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেই রকম ঘটনা ঘটেনি কারণ প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ নির্বাচনে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন।

কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে মেয়র পদে মূলত তিনজন প্রার্থীর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। এদের একজন ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আহসানুল হক রিফাত এবং অন্যজন বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত স্বতন্ত্র প্রার্থী বর্তমান সর্বশেষ মেয়র মনিরুল হক সাক্কু। এছাড়া বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত নিজাম উদ্দিন কায়সার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নির্বাচনের ফল ঘোষণার প্রথম দিক থেকেই আওয়ামী লীগ প্রার্থী রিফাতের সাথে স্বতন্ত্র প্রার্থী সাক্কুর তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা লক্ষ্য করা যায়। আমরা দেখেছি কখনো বা রিফাতকে অতিক্রম করেছিলেন সাক্কু, আবার পরক্ষণেই সাক্কুকে অতিক্রম করেছিলেন রিফাত। ফলে এক ধরনের শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা তৈরি হয়েছিল শেষদিকে।

১০৫টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ১০১টি কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণার পরে দুই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা পরিলক্ষিত হয়। পরিস্থিতি এমন হয় যে, নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ করতে হয় রিটার্নিং কর্মকর্তাকে শিল্পকলা একাডেমিতে স্থাপিত নিয়ন্ত্রণ কক্ষে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পরে ১০৫টি কেন্দ্রের ফলাফল প্রকাশ করা হয়, যেখানে দেখা যায় যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আহসানুল হক রিফাত ৩৪৩ ভোটের ব্যবধানে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কুকে পরাজিত করেন। রিফাত পান ৫০৩১০ ভোট আর সাক্কু ৪৯৯৬৭। বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত স্বতন্ত্র প্রার্থী নিজাম উদ্দিন কায়সার পেয়েছেন ২৯৯৯৯ ভোট।

নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পরে সাক্কু নির্বাচনের ফলাফল অস্বীকার করেছেন এই বলে যে, তাকে ইচ্ছাকৃতভাবে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে এ প্রসঙ্গে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ইভিএমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পরে খুব অল্প সময় পর থেকেই প্রতিটি কেন্দ্রে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা হওয়ার পরে সেটি কন্ট্রোল রুমে ঘোষণা করা হয়।

প্রতিটি কেন্দ্রের ফলাফল বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর এজেন্টদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এই প্রেক্ষাপট থেকে বিচার করলে সাক্কুর কাছে ১০৫টি কেন্দ্রের ফলাফলের কপি থাকার কথা। তার কাছে যদি সুনির্দিষ্ট প্রমাণ থাকে যে তার সর্বমোট ভোট রিফাতের ভোটের চেয়ে বেশি, তবে তিনি মিডিয়ার সামনে সেগুলো উপস্থাপন করতে পারতেন।

কিন্তু তিনি সেটি না করে নির্বাচন কমিশনের ওপর এক ধরনের দায় চাপানোর চেষ্টা করেছেন- যা খুব গ্রহণযোগ্য হয়েছে বলে আমি মনে করি না। নির্বাচনের ফলাফলকে কেন্দ্র করে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল, সেই টুকু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলে এই নির্বাচনকে কালিমালিপ্ত করার কোনো উপায় ছিল না কারও পক্ষেই। যাই হোক জনগণের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে সবার নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেওয়া উচিত।

কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সফলতা ছিল প্রতিটি কেন্দ্রে সিসি টিভি স্থাপন এবং তা দিয়ে ঢাকা থেকে নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট ভাবে বলা হয়েছে যে, তারা কোন ধরনের অনিয়ম কিংবা নির্বাচনকালীন সময়ে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীর সমর্থকদের পেশিশক্তি প্রদর্শনের ঘটনা ঘটতে দেখেননি। ফলে সার্বিক দিক থেকে বিচার করলে এই নির্বাচন অত্যন্ত সফল হয়েছে-একথা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়।

নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে এই নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য বিভিন্ন ধরনের ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও কুমিল্লার সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার সম্পর্কে তাদের অবস্থান কিছুটা হলেও জনগণকে হতাশা করেছে। তাকে এলাকা ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হলেও তিনি এলাকা ছেড়ে না গিয়ে আদৌ নির্বাচনী আইন লংঘন করেছেন কি না-সে বিষয়টি পরিষ্কার করা উচিত ছিল নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে। তার ক্ষেত্রে কমিশনের আরও একটু কঠোর অবস্থান কমিশনকে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করতো।

তবে আমাদের মাথায় রাখতে হবে পৃথিবীতে কোন সৃষ্টিই পূর্ণাঙ্গ নয়। অতএব সব ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ সফলতা আসবে- এটি সব সময় কাম্য নয়। বেশিরভাগ সফলতার মধ্যে কোথাও কোথাও কোনো ধরনের দুর্বলতা থেকে যায়। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতির বিচারে সফলতার সাথে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন ইয়েস কার্ড পেয়েছেন- এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। যে প্রক্রিয়ায় তারা নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে সক্ষম হয়েছেন, দেশবাসী তার প্রশংসা করেছেন। কমিশন এ বিষয়টি প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে যে সব রাজনৈতিক দল এবং প্রার্থীর সমর্থনে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক এবং স্বচ্ছ করা সম্ভব।

ফলে সরকার এবং বিরোধীদলীয় সব রাজনৈতিক দল এবং জোটের উচিত বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে আস্থায় নিয়ে কীভাবে আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক এবং স্বচ্ছ করা যায়-সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করা। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে যেমন সব দলের সঙ্গে আলোচনায় বসার অভিপ্রায় ব্যক্ত করা হয়েছে, তেমনি সব রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনের সাথে খোলা মনে আলোচনায় বসতে হবে।

আমাদের মনে রাখতে হবে যে কোন না কোন ব্যক্তির ওপর নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব অর্পিত হবে। সব রাজনৈতিক দলের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া কঠিন। যাদের নিয়ে বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে, তারা সবাই অপেক্ষাকৃতভাবে অনেক ক্লিন ইমেজের। ফলে তাদের ওপর আস্থা রেখে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে গণতন্ত্রকে সুসংহত করা হবে সব রাজনৈতিক দলের মূল দায়িত্ব।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের প্রফেসর।

এইচআর/ফারুক/এমএস