ক্যাম্পাস

‘না এমনি আপনাগো ট্যাকা আমি নিমু ক্যা’

বিকেল ৩টার একটু বেশি হবে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছুটছে বাসার রুটে বাসে সিট রাখতে। এমন সময় এই প্রতিবেদকসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী রিফাত রাজ আর শাহ আলম ব্যাপারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য চত্বরের উত্তর-পূর্ব দিকে বসে বাদাম খাচ্ছিলেন। এমন সময় ছোট্ট একটি শিশুর কণ্ঠের আওয়াজ তাদের কানে ভেসে আসে, ‘এই চা, চা খাবেন মিয়া ভাইরা।’ শিশুর কণ্ঠের আওয়াজটি পশ্চিম দিক থেকে আসছিল।শাহ আলম রাজকে জিজ্ঞাসা করলো চা খাবে? উত্তর নেতিবাচক হওয়ায় শাহ আলম ওই শিশুটিকে ১০ টাকার একটি নোট দিয়ে বললো ভাই, তুই এ টাকা নিয়ে চলে যা ভাই। তখন শিশুটি বললো, ‘আপনাদের টাকা আমি ক্যান নিমু।’ শাহ আলম বললো নে ভাই আমরা চা খাই না, তুই এমনি টাকা নিয়ে চলে যা। তখন ওই শিশুটি বললো, না এমনি আপনাগো ট্যাকা আমি নিমু ক্যা।  তখন এই প্রতিবেদকের নজর পুরোপুরি শিশুটির উপর। একজন বললো, কেন নেবে না? শিশুটি বললো, ‘আমি কাজ করে খাই, আমি শুধু শুধু কেন আপনাগো ট্যাকা নিমু।’ তখন রাজ বললো, দে আমাদের তিন কাপ চা দে।হ্যাঁ এমন অনেক ঘটনা ঢাকা শহরে অহরহ না ঘটলেও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় সোমবার ৩টা ১৫ মিনিটের দিকে এ ঘটনা ঘটেছে। রিয়াজ নামের ওই শিশুর চা বিক্রি করার এমন ঘটনায় উপস্থিত সবাইকে অবাক করেছে।পরে চা বিক্রেতা শিশুর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তার নাম রিয়াজ। গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। রিয়াজের দুই ভাই এক বোন। তারা সবাই পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের ডালপট্টি মোড়ে থাকেন। রিয়াজের মা শাহানার সঙ্গে বোনেরা মেস বাড়িতে রান্না করেন। আর রিয়াজেরর বাবাও চা বিক্রি করেন। রিয়াজ তার পরিবার-পরিজন নিয়ে একটি ছোট্ট ঘরে থাকে।গ্রামের বাড়িতে অভাব-অনটনে পড়ে রিয়াজের বাবা পাড়ি জমান ঢাকায়। এক সময় রিয়াজের খালা রেহেনার কাছ থেকে রিয়াজের বাবা ১০ হাজার টাকা ধার নেন। রিয়াজের বাবা ধারের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় তাকে দিয়ে চা বিক্রি করাচ্ছেন তার খালা।রিয়াজের সঙ্গে আলাপকালে আরো জানা গেল, রিয়াজ প্রতিদিন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে চা নিয়ে বের হয়। বিক্রি করে সন্ধ্যায় বাসায় ফেরে। গড়ে টাকা কম আয় হলে রিয়াজের উপর চলে নির্যাতন।এ প্রতিবেদকের মোবাইল ফোন সেট দেখে রিয়াজ বলে ওঠে, ‘‘আঙ্কেল দেন একটু গেম খেলি। গেম খেলতে মজা লাগে।’’ চার্জ নাই বললেও করুণ চাহনির কারণে এ প্রতিবেদক তার মোবাইল রিয়াজকে দিতে বাধ্য হয়। মোবাইল খেলার সময় রিয়াজের নাম এ প্রতিবেদক লিখতে চাইলে বলে, ‘‘আঙ্কেল দেন আমি আমার নাম লিখে দেই। আমি ক্লাসে ১ম হয়েছিলাম ওয়ানে ভর্তি পরীক্ষায়। রিয়াজ তার নাম লিখে দেয়।রিয়াজের মনের ইচ্ছা কী জানতে চাইলে বলে, ‘‘আঙ্কেল আমার হকল (সব) সময় গেম খেলতে মন চায়।’’ পড়ালেখা করতে চায় কি না এমন প্রশ্নের জবাবে বলে ‘‘হ, কে ট্যাকা দিব পড়ার। আমি পড়লে খালার ট্যাকা শোধ দিব কোনজন?’’ এসময় এ প্রতিবেদকের নোটবুকে নিজের নাম লেখে রিয়াজ।এমন সময় শাহ আলম চায়ের বিল হিসেবে ৫০ টাকার একটি নোট দিয়ে বলে তোর কত টাকা বিল হয়েছে? উত্তরে রিয়াজ কড় গুণে গুণে বলে ‘‘বিশ ট্যাকা।’’ শাহ আলম বলে ওই নোট বিশ টাকা। পাশের একজনকে নোট দেখিয়ে রিয়াজ জানতে পারে এটা পঞ্চাশ টাকা। এসময় বাকি ৩০ টাকা শাহ আলমকে ফেরত দিলে উপস্থিত সবাইকে মুগ্ধ করে ছোট্ট রিয়াজের আচরণ।এক প্রশ্নের জবাবে রিয়াজ বলে, আঙ্কেল আমার ট্যাকা অনেকে দেয় না। আবার অনেকে ট্যাকা না দিয়ে চা খেয়ে কাপটি নিয়ে যায়। রিয়াজের ছয়টি কাপ ছিল, তিনটি কে যেন গতকাল চা খেয়ে বিল ও কাপ আর ফেরত দেয়নি। রিয়াজের এমন আচরণে রিফাত রাজ, রাকিবুল ইসলাম, শাহ আলম ও এ প্রতিবেদকসহ উপস্থিত ছাত্রজনতা হতবাক হয়ে যায়।বিএ

Advertisement