রাজধানীর জলাধার ও জলাশয় সংরক্ষণে ঢাকা মহানগরীর মহাপরিকল্পনা, ঢাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) এবং জলাধার সংরক্ষণ আইনে বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। বলা হয়েছে, নগরে জলাবদ্ধতা নিরসনে এসব জলাশয় ও জলাধার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নগরীর সৌন্দর্যও বাড়ায়। এ কারণে এগুলো ভরাট করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।
Advertisement
দেশে প্রচলিত আইনে এমন নির্দেশনা থাকলেও খোদ সরকারের দুই সংস্থা, বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) তা মানছে না। নিজেদের বিভিন্ন জলাশয় ভরাট করছে তারা। এ নিয়ে সরকারের তদারক সংস্থাগুলোরও তেমন কোনো তৎপরতা নেই।
নগর পরিকল্পনাবিদরা জানান, নগর কর্তৃপক্ষের চোখের সামনেই জলাশয়-জলাধার ভরাট হচ্ছে। এতে টেকসই ও বাসযোগ্য নগর গড়তে ঢাকা কেন ব্যর্থ, সেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এখন ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) প্রতিপালনে ব্যর্থ হলে এবং জলাশয়-জলাধার রক্ষায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না করতে পারলে ঢাকাকে আর কোনোভাবেই বাঁচানো যাবে না।
এদিকে ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) গেজেট চূড়ান্ত হয়েছে। ছয়মাস আগে সেটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। কিন্তু তা এখনো অনুমোদন পায়নি। এরই মধ্যে ড্যাপে আপত্তি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বরাবর চিঠি দিয়েছেন আবাসন ব্যবসায়ীরা।
Advertisement
ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে জলাশয় বরাদ্দ দেয় বাংলাদেশ রেলওয়েরাজধানীর কুড়িল উড়াল সড়ক সংলগ্ন এলাকায় বাংলাদেশ রেলওয়ের ১ দশমিক ৮৪ একর আয়তনের একটি জলাধার রয়েছে। কয়েক বছর আগে এই জলাধারের জায়গাটি বহুতল হোটেল নির্মাণে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে বরাদ্দ দেয় সংস্থাটি। সে অনুযায়ী গত জানুয়ারিতে বালি-মাটি ফেলে ভরাট শুরু হয়। এর প্রতিবাদে ২৭ জানুয়ারি কুড়িলে মানববন্ধন করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম।
তার নির্দেশে ওই জায়গায় থাকা হোটেলের সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড অপসারণ করে ডিএনসিসি। পরে জলাশয়ের বরাদ্দ দেওয়া ভুল হয়েছে বলে স্বীকার করেন রেলওয়ে মহাপরিচালক ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদার।
তিনি বলেন, কুড়িলের ওই জায়গাটি রেলওয়ের নিজস্ব সম্পত্তি। কিন্তু এটি ঢাকা মহানগরীর মহাপরিকল্পনা, ঢাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ), জলাধার সংরক্ষণ আইনে জলাশয় হিসেবে উল্লেখ ছিল। এটা রেলওয়ের জানা ছিল না। বিষয়টি জানার পর সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে রেলওয়ে।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, কুড়িল উড়াল সেতু ঘিরে চারপাশে আট থেকে দশটি জলাশয় রয়েছে। ওই এলাকায় ভারি বর্ষণ হলে বৃষ্টির পানি গড়িয়ে সব জলাশয়ে গিয়ে জমে। ফলে সড়কে জলাবদ্ধতা হয় না। এসব জলাশয়ের কারণে ওই এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য শহরের অন্যান্য এলাকার চেয়ে অনেকগুণ বেশি।
Advertisement
কুড়িলের বাসিন্দা জসিম উদ্দিন বলেন, কুড়িলে জলাশয়গুলো থাকায় এই এলাকায় কখনোই জলাবদ্ধতা হয়নি। লেকের মতো দেখতে এসব জলাশয় এলাকায় সকাল-বিকেল মহল্লার অনেকেই হাঁটতে যায়। সবার মনে প্রশান্তি কাজ করে।
চলছে জলাশয় ভরাট
আশকোনায় জলাধার ভরাট করছে বেবিচক
কুড়িল থেকে তিন কিলোমিটার উত্তরে এগোলেই আশকোনা এলাকা। এই এলাকায় বেবিচকের অনেকগুলো জলাশয় ও জলাধার রয়েছে।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, এই জলাশয় ও জলাধারগুলো বালু ফেলে ভরাট করছে বেবিচক। কিন্তু জলাশয় ভরাট করে সেখানে কী করা হবে, তার কোনো তথ্য সম্বলিত ব্যানার দেখা যায়নি। এছাড়া হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে যে তিনটি জলাশয় ছিল সেগুলোও ভরাট করা হচ্ছে।
বিষয়টি জানতে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুল ইসলামের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। তার দপ্তরের অন্য কর্মকর্তারাও এ সংক্রান্ত তথ্য দিতে রাজি হননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেবিচকের এক কর্মকর্তা বলেন, এখন যেখানে বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল হচ্ছে, সেখানেও চার-পাঁচটি বড় জলাশয় ছিল। থার্ড টার্মিনাল নির্মাণের জন্য এগুলো ভরাট করা হয়েছে। আশকোনা এলাকায় যেসব জলাধার ভরাট করা হচ্ছে সেখানে বহুতল ভবন হবে। কিন্তু বেবিচকের কেউই ড্যাপ বা জলাধার সংরক্ষণ আইনের বিষয়টি মাথায় রাখছেন না।
আশকোনা ও কুড়িল উড়াল সড়ক- উভয় এলাকা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) অধীন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, আমরা নগরের জলাধারগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছি। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) বাইরে নগরে কাউকে জলাশয় ও জলাধার ভরাট করতে দেওয়া হবে না। সম্প্রতি কুড়িলে যেভাবে জলাশয় ভরাট বন্ধ করা হয়েছে, এভাবে শিগগির আশকোনার জলাশয় ভরাট বন্ধে অভিযান চালানো হবে।
তিনি বলেন, নগরের সড়কে জলাবদ্ধতা হলে সবাই সিটি করপোরেশনকে দোষ দেয়। কিন্তু কেউ বৃষ্টির পানি অপসারণের জন্য জায়গা রাখে না। জলাধারগুলো যে যার মতো ভরাট করছে। এমন অব্যবস্থাপনায় একটি নগর চলতে পারে না।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের তথ্য মতে, প্রতি বছর গড়ে ঢাকা শহরের দুই সিটি করপোরেশন এলাকা থেকে ৫ হাজার ৭৫৭ একর জলাভূমি হারিয়ে যাচ্ছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় ৯ হাজার ৫৫৬ একর জলাশয়ের মধ্যে ভরাট হয়েছে ৩ হাজার ৪৮৩ একর। এভাবে খাল, জলাশয় থেকে শুরু করে পুকুর পর্যন্ত প্রভাবশালী দখলদারদের কারণেই বিলীন হচ্ছে বেশি।
গত ২২ মে নগরবাসীকে জলাবদ্ধতা থেকে বাঁচাতে আশকোনার জলাশয়সহ ঢাকার সব জলাধার ভরাট বন্ধে আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি দেয় ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)।
বিবৃতিতে বলা হয়, আইন অমান্য করে জলাধার ভরাট করছে বেবিচক। সরকারি প্রতিষ্ঠানের দ্বারা এ ধরনের জলাশয়-জলাধার ভরাট অন্যায়। ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) প্রতিপালনে ব্যর্থ হলে এবং জলাশয়-জলাধার রক্ষায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না হলে ঢাকাকে কোনোভাবেই বাঁচানো যাবে না।
শহরের প্রাণ জলাশয়গুলো
আইপিডির নির্বাহী পরিচালক আদিল মোহাম্মদ খান। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগে শিক্ষকতা করছেন। ঢাকা শহরের পার্ক, মাঠ, উন্মুক্ত স্থান ও জলাভূমি নিয়ে গবেষণাও করছেন।
জানতে চাইলে আদিল মোহাম্মদ খান জাগো নিউজকে বলেন, জলাশয় ভরাটের ক্ষেত্রে প্রভাবশালী মহল কিংবা বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কিংবা প্রকল্পের নাম শোনা যায় প্রায়ই। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানের এ ধরনের জলাশয়-জলাধার ভরাটের উদ্যোগ বলে দেয়, আমরা টেকসই ও বাসযোগ্য নগর গড়তে কেন ব্যর্থ হচ্ছি। ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে কেন আমরা কার্যকর সমাধান তৈরি করতে পারছি না, সে বিষয়টি এ ধরনের অন্যায় উদ্যোগের ফলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
তিনি বলেন, ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। কিন্তু জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার কার্যকারিতা অনেকাংশে নির্ভর করে জলাশয়-জলাধারের পানি ধারণক্ষমতার ওপর। একটি নগর এলাকায় জলাশয় এলাকা ১২-১৫ শতাংশ থাকা দরকার হলেও ঢাকার জলাশয়-জলাধার এলাকা কমছে আশঙ্কাজনকভাবে। তাই ড্যাপে চিহ্নিত জলাশয়-জলাধার নির্বিচার দখলের শিকার হচ্ছে। এই দখল বা ভরাট বন্ধের জন্য রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, ঢাকা জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, যা অত্যন্ত উদ্বেগের।
এ নিয়ে জানতে চাইলে ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, নগর বিশেষজ্ঞ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, রিহ্যাবের যুক্তিসঙ্গত মতামতের ভিত্তিতে ড্যাপের খসড়া তৈরি। রিহ্যাবের যুক্তিসঙ্গত দাবি ড্যাপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ড্যাপে জলাশয় ও জলাধার সংরক্ষণে সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বেশি। এখন আশকোনায় যে জায়গাগুলো বেবিচক ভরাট করছে, সেগুলো ড্যাপে জলাশয় হিসেবে উল্লেখ রয়েছে। তাই ওই এলাকাকে জলাবদ্ধতা থেকে বাঁচাতে জলাশয়গুলো ভরাট বন্ধ করতে হবে।
এমএমএ/এমএইচআর/এএসএ/এএসএম