দেশজুড়ে

বানে ভাসছে সিলেট: এত ভয়াবহতা আগে দেখেনি কেউ

সিলেটে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই বাসা-বাড়ি ভাসিয়ে নেয় উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানি। একদিনে বন্যার এমন ভয়াবহ রূপ আগে দেখেনি সিলেটের মানুষজন। বন্যার পানির এমন আকস্মিক বৃদ্ধিতে হতভম্ব ক্ষতিগ্রস্ত লাখ লাখ মানুষ। অবাক হয়েছেন সিলেট সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারাও।

Advertisement

ভয়াবহ বন্যার শিকার লোকজন আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়েও জায়গা পাচ্ছেন না। শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে রয়েছেন সিলেটের বানভাসি মানুষ। এছাড়া জেলার কৃষকরা তাদের গৃহপালিত পশু নিয়ে পড়েছেন বিপাকে। এমন পরিস্থিতিতে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠকরা মানবিক সংকট মোকাবিলায় সবাইকে সাধ্য অনুযায়ী এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।

বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় সিলেট বিভাগের বেশিরভাগ এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। টেলিফোন নেটওয়ার্ক অকার্যকর হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে নিরাপত্তার স্বার্থে ও দুর্ঘটনা এড়াতে সিলেট নগরের কিছু উঁচু অংশ ছাড়া পুরো জেলার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। বলা যায় সিলেট বিভাগ কার্যত সারাদেশ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

শুক্রবার (১৭ জুন) দুপুরে নগরের ঘাসিটুলা এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ আলী জাগো নিউজকে বলেন, বৃহস্পতিবার সকালেও লামাপাড়া-ঘাসিটুলা সড়কসহ এলাকা শুকনো ছিলো। শুক্রবার এই সড়কে এখন কমরপানি। বাসা-বাড়িতে খাটের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এত দ্রুত সময়ের মধ্যে এমন ভয়াবহ বন্যা আমি কোনোদিন দেখিনি। এভাবে পানি বাড়তে থাকলে তো সিলেট নগরসহ জেলার কোনো জায়গা তলাতে বাকি থাকবে না।

Advertisement

শুধু সিলেট নগর নয়, সিলেটজুড়েই দ্রুত পানি বাড়ছে। জেলার বেশিরভাগ এলাকায়ই পানিতে তলিয়ে গেছে। বন্যাদুর্গতদের উদ্ধারে শুক্রবার দুপুর থেকে মাঠে নেমেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। কোনো কোনো জায়গায় বিজিবি সদস্যরাও বন্যায় আটকে পড়াদের উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাচ্ছেন।

বুধবার (১৫ জুন) থেকে সিলেটের নিচু এলাকায় পানি জমে যায়। তবে বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে তা ভয়াবহ রূপ নেয়। দুপুর ১২টা থেকে বৃহস্পতিবার দিনগত রাতের মধ্যেই সিলেট নগরের বেশির ভাগ এলাকা তলিয়ে যায় বন্যার পানিতে।

গত ১৫ মে এ বর্ষায় প্রথম দফায় বন্যা হয় সিলেটে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাবে, মে মাসের বন্যায় গত ১৮ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পানি হয় সিলেটে। তবে চলমান বন্যা গত মাসের রেকর্ডও ছাড়িয়ে গেছে।

নগরের নবাবরোড এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী তালেব হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, মে মাসের মাঝামাঝিতে আসা বন্যার পানি নবাবরোডে ওঠেনি। কিন্তু এবার সেই সড়কে এখন হাঁটুর উপরে পানি। এলাকার দোকানপাট, প্রাইভেট ক্লিনিক, এলজিইআরডি অফিস, বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রাতিষ্ঠানসহ সবগুলো স্থাপনা এখন পানির নিচে। লোকজন আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে গিয়েও জায়গা পাচ্ছে না। বন্যায় আগে একসঙ্গে এত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।

Advertisement

নগরের অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত শাহজালাল উপশহর এলাকার বাসিন্দা কয়সর আহমদ বলেন, গত মাসের বন্যায় এতো পানি হয়নি। মে মাসের বন্যায় উপশহরের মোড়ে পানি ওঠেনি। এবার উপশহরের মোড়ও তলিয়ে গেছে।

এবারের বন্যায় সিলেট নগরের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সিলেট জেলার ভারতের সীমান্তঘেঁষা উপজেলা গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট এবং সিলেট সদর। এই পাঁচ উপজেলার প্রায় পুরোটাই পানিতে তলিয়ে গেছে। সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়ক, গোয়াইনঘাট-সালুটিকর-সিলেট সড়কও পানির নিচে। ফলে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সিলেটের সীমান্তবর্তী এ উপজেলাগুলোর সড়ক যোগাযোগ।

বাহনের অভাবে প্লাবিত এলাকার মানুষজন আশ্রয়কেন্দ্রেও আসতে পারছে না। তাদের উদ্ধারে শুক্রবার থেকে নেমেছে সেনাবাহিনী। ইতোমধ্যে গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও সিলেট সদর উপজেলায় বন্যার্তদের সহযোগিতায় সেনাবাহিনী কাজ করছে বলে জানিয়েছেন সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার ড. মুহাম্মদ মোশাররফ হোসনে।

কোম্পানীগঞ্জের ১ নম্বর ইসলামপুর পশ্চিম ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, কোম্পানীগঞ্জ সদরসহ উপজেলার সবগুলো এলাকা এখন পানির নিচে। এ অবস্থায় পানিবন্দি লোকজন চরম দুর্ভোগে রয়েছেন। উদ্ধার হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন অনেকেই।

এছাড়া জেলার দক্ষিণ সুরমা, জকিগঞ্জ, বিশ্বনাথ, বালাগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ উপজেলার বেশিরভাগ এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়েছে। সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক উপচে পানি তীব্র বেগে প্রবাহিত হচ্ছে। সিলেট-ছাতক রেললাইনের বিশ্বনাথ অংশ পানির নিচে ডুবে গেছে। এ কারণে ওই রুটে ট্রেন চলাচলও বন্ধ হয়ে গেছে।

এদিকে গত তিন দিনে সিলেটের উজানে ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে প্রায় আড়াই হাজার মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ১২২ বছরে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছে। আর এ কারণে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢালে সিলেটে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়েছে।

গত তিন দিনে বাংলাদেশের উজানে ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে প্রায় আড়াই হাজার মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। ওই বৃষ্টির পানি ঢল হয়ে বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ ও সিলেট জেলায় প্রবেশ করেছে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পূর্বাভাস বলছে, আগামী তিন দিন উজানে ভারতীয় অংশে ও বাংলাদেশ অংশে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি অব্যাহত থাকতে পারে। ফলে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার আশঙ্কা আছে।

ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তরের (আইএমডি) বরাত দিয়ে হিন্দুস্তান টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের চেরাপুঞ্জি বিশ্বের সবচেয়ে বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা। গত ২৪ ঘণ্টায় সেখানে ৯৭২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, যা জুন মাসে ১২২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আর গত তিন দিনে সেখানে প্রায় আড়াই হাজার মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এটিও গত ২৭ বছরের মধ্যে তিন দিনে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের রেকর্ড।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেট কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমদ বলেন, যেভাবে ঢল নামছে, তাতে পানি আটকানোর কোনো উপায় নেই। আগামী দুই দিন বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

বিদ্যুৎ বিভাগ সিলেটের প্রধান প্রকৌশলী মো. আব্দুল কাদির জাগো নিউজকে বলেন, নগর ও জেলার যেসব এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে, নিরাপত্তার স্বার্থেই ওই এলাকাগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে কুমারগাঁও উপকেন্দ্র তলিয়ে গেলে দুই জেলার ৯০ শতাংশ সরবরাহ বন্ধ হয়ে পড়বে।

সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান বলেন, কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রশাসনের ভবনও পানিতে তলিয়ে গেছে। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় জেলা ও উপজেলা প্রশাসন আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে। যাদের বাড়িঘরে পানি উঠেছে, তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে নতুবা নিরাপদ স্থানে চলে আসতে বলা হচ্ছে। তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসতে সেনাবাহিনী তাদের বিশেষ ধরনের নৌকা নিয়ে উদ্ধার কাজ চালাচ্ছে।

সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, বন্যাদুর্গত মানুষের পাশে সিটি করপোরেশন রয়েছে। ভয়াবহ এই বন্যা মোকাবিলায় বিত্তবানসহ সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলররা নিজ নিজ এলাকায় তৎপরতা চালাচ্ছেন।

মেয়র বলেন, কুমারগাওয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র রক্ষায় আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছি। সেনাবাহিনীও এখানে কাজ করছে। সেনাবাহিনী বিদ্যুৎকেন্দ্রের চারপাশে বালির বস্তা দিয়ে বাঁধ নির্মাণের চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে কেন্দ্রে ঢুকে পড়া পানি সিটি করপোরেশনের সাকার মেশিন দিয়ে শুকানোর কাজ করা হচ্ছে।

অপরদিকে বন্যা পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ বিভাগের জরুরি সর্তক বার্তা জারি করা হয়েছে। এতে বলা হয়, আকস্মিক বন্যার কারণে শাহজালাল উপশহর, সোবহানীঘাট, মেন্দিবাগ, মুরাদপুর, ঘাসিটুলা এবং আশপাশ প্লাবিত হওয়ায় জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে পানিতে কোনো বৈদ্যুতিক তার, খুঁটি বা অন্যান্য বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি পড়ে থাকলে অথবা গাছপালা বৈদ্যুতিক লাইনে পড়লে, স্পর্শ না করে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে দ্রুত অত্র দপ্তরের ০১৬২৫০৩৮৭৮৪ এবং ০২৯৯৬৬৩৩১৭৩ নম্বরে ফোনে জানানোর জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের বিক্রয় বিতরণ বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী শামছ-ই আরেফিন বলেন, বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই এ ব্যাপারে সকলে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করলে এই বন্যার সময় সব ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হবে।

এফএ/এমএস