জাতীয়

ঢাকার আশপাশও খরার ঝুঁকিতে

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন ধরনের বিরূপ প্রভাব দেখছে বিশ্ববাসী। এর মধ্যে ক্রমবর্ধমান মরুকরণ একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা। কোনো একটি জায়গায় যদি টানা ১৫ দিন অন্তত ১০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত না হয়, তাহলে তাকে খরা বলেন বিশেষজ্ঞরা। দ্বিতীয় ধাপে টানা এক মাস কোনো বৃষ্টিপাত না হলে তাকেও খরা বলা হয়। খরার কারণে জমিতে ফাটল দেখা দেয়। ফসলি জমি পুড়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় শস্য উৎপাদন ব্যবস্থা। অন্যদিকে বাতাসে প্রচুর ধুলাবালি জমে হয় বায়ূদুষণও, যা জনস্বাস্থ্যেরও ক্ষতি করে। এতদিন দেশের উত্তরাঞ্চলের কথা শোনা গেলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন ঢাকার আশপাশও আছে খরার ঝুঁকিতে।

Advertisement

জনসচেতনতা তৈরি এবং সংশ্লিষ্টদের করণীয় নজরে আনতে বিশ্বজুড়ে ১৭ জুন পালিত হয় বিশ্ব খরা ও মরুকরণ প্রতিরোধ দিবস। বাংলাদেশে প্রথম ১৯৯৫ সালে দিবসটি পালিত হয়। দেশের উত্তরাঞ্চলের রাজশাহীকে কেন্দ্রবিন্দু ধরে নগর থেকে ৪০ কিলোমিটার পশ্চিমে কাঁকনহাটে জাতীয়ভাবে প্রথমবারের মতো এই দিবস পালিত হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উত্তরাঞ্চলের মধ্যে খরাপ্রবণ অঞ্চল হিসেবে রাজশাহী বিগত কয়েক দশক ধরে সবচেয়ে বেশি খরা মোকাবিলা করে আসছে। অন্যদিকে রংপুর অঞ্চলও রয়েছে এ ঝুঁকিতে। ভবিষ্যতে হয়তো ঢাকার আশপাশের অঞ্চলেও খরা দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে মাটি ও পানি রক্ষা করতে হলে এখনই প্রয়োজন যথাযথ পদক্ষেপ।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. নুরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘খরাকে আমরা একাধিক ধাপে নির্ণয় করি। কোনো একটা জায়গায় যদি টানা ১৫ দিন ১০ মিলিমিটারের নিচে বৃষ্টিপাত না হয়, তাহলেই আমরা তাকে খরা বলি। অন্যদিকে দ্বিতীয় ধাপে টানা একমাস বৃষ্টিপাত না হলেও আমরা তাকে খরা বলি। এই খরা আমরা যখন পরিমার্জন করি, তখন বায়ুমণ্ডল ও মৃত্তিকার আর্দ্রতার অভাব দেখা দেয়। এই আর্দ্রতা তখনই পূরণ হয়, যখন পর্যাপ্ত পানি প্রবাহমান থাকে, নিয়মিত বৃষ্টিপাত হয়। খাঁটি বাংলায় যদি আমরা বলি, নদীনালা কমে গিয়ে পানির ঘাটতি কিংবা বৃষ্টির অভাব দেখা দিলেই সেটি খরা। এটা প্রাকৃতিক একটা দুর্যোগ।’

Advertisement

ছবি: সংগৃহীত

‘কোনো কোনো সময় দেখা যায়, ১৫ দিন কিংবা একমাস নয়, একেকটা ঋতুতেই কোনো বৃষ্টিপাত নেই। এজন্য প্রয়োজন প্রবাহমান জলাধার। আমাদের দেশের উত্তরাঞ্চলে যে ধরনের অবস্থা তৈরি হয়েছিল, ফারাক্কা বাঁধের কারণে শুষ্ক মৌসুমে নদী-নালার পানিপ্রবাহটা কমে গেলো। এতে বৃষ্টিপাত ও বায়ুমণ্ডলে বাষ্পের পরিমাণও কমে যায়। একদিকে গাছপালা কম, অন্যদিকে বৃষ্টিপাতও কম আবার নদীনালার পানিও কম। এই তিনটার সংমিশ্রণে হলো আমাদের উত্তরাঞ্চলের খরা। একটা অঞ্চলে যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত দরকার, তার চেয়ে ২৫ শতাংশ কম হলেই তাকে আমরা বলবো আবহাওয়াজনিত খরা।’

এদিকে উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী বিগত কয়েক দশক খরা মোকাবিলা করে এলেও তার সঙ্গে রংপুর অঞ্চলেও খরা ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান রিপন জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘রংপুর অঞ্চলে খরা তৈরি হচ্ছে, কিন্তু বন্যার প্রবণতাও বাড়ছে। বর্ষার সময় পাচ্ছেন বন্যা। বর্ষা শেষ হলেই খরা। রংপুর অঞ্চলে খরার ইনডেক্স যেভাবে বাড়ছে, যদি এর প্রবণতা আরও বাড়তে থাকে, তবে রাজশাহী অঞ্চলের চেয়েও ওই এলাকায় ভবিষ্যতে আরও খারাপ পরিস্থিতি দেখা দেবে। একই দেশ, একই গ্রাম অথচ বছরে একটা সময় খরায় মরছে, আবার আরেক সময় পানিতে ডুবে মরছে। এবছরও আমরা খবরে দেখেছি, যখন ধান লাগানো ছিল, তখন ধানগুলো রোদে পুড়ে গেলো। আবার বর্ষা আসার সঙ্গে সঙ্গে পানিতে ডুবে গেলো।’

‘রংপুরে খরার অন্যতম কারণ, তিস্তায় বাঁধ দেওয়া। আমাদের দেশের অভ্যন্তরে একটা ব্যারেজ বানিয়ে মূল প্রবাহ থেকে পানি বিভিন্ন দিকে নিয়ে গেছে। ফলে ‘ওয়াটার টেবিল’ যেটা আছে অর্থাৎ ‘গ্রাউন্ড ওয়াটার টেবিল’ এটা অনেক নিচে নেমে যাচ্ছে। মাটির দানা আমরা যেটাকে বলি, এটা নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে বৃষ্টির পানি এলে ওভার ফ্লো হয়ে যাচ্ছে, পানি মাটির নিচে প্রবেশ করতে পারছে না। পানি মাটির নিচে প্রবেশ না করার কারণে যখন শুষ্কতা বা প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ আসছে তখন মাটির নিচে পানি না থাকার কারণে ফসল পুড়ে যাচ্ছে। দুই দিক থেকেই সমস্যাটা হচ্ছে।’

Advertisement

আধুনিক নগরায়ণ ও শিল্পায়নভিত্তিক উন্নয়নের দিকে নজর দিতে গিয়ে দেশে পরিবেশের যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে, তা একটা সময় ঢাকার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলকেও খরার দিকে ঠেলে দেবে বলে আশঙ্কা করছেন বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান ও স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, আমাদের বিভিন্ন জেলায় খরাপ্রবণ জমি রয়েছে ৫৫ লাখ হেক্টরের মতো। এই জমিগুলো সাধারণত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলে রয়েছে। মোটামুটি ১৩-১৪টি জেলায় খরা দেখা যায়। এর ভেতরে নওগাঁ, রাজশাহী, দিনাজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট, ঠাকুরগাঁও- এসব অঞ্চলে খরাঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। খরা বাংলাদেশের জন্য নতুন কিছু নয়। ১৯৭৮ সালের দিকে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি খরা মোকাবিলা করেছে। ওই সময় আমাদের দেশে প্রায় ৪০ শতাংশের বেশি জমিতে খরা দেখা যায়।

ছবি: সংগৃহীত

‘বর্তমানে নগরায়ণ ও শিল্পায়নের কারণে আমরা প্রাকৃতিক জলাধারগুলো সংরক্ষণ করতে পারি না। এজন্য হঠাৎ করে যখন তাপমাত্রা বেড়ে যায়, তখন জমিতে ফাটলের সৃষ্টি হয়। বলা যায়, এটা খরার একেবারে সবশেষ রূপ। এই খরায় দুটি ঘটনা ঘটে। একদিকে যেমন শুকনা খরা হয়ে যাওয়ার কারণে গরমের পরিমাণ বেড়ে যায়, অন্যদিকে শুষ্ক হয়ে যাওয়ার কারণে বাতাসে প্রচুর ধুলাবালি জমে। বায়ূদুষণও হয় খরার কারণে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে খরাটা মানুষও সৃষ্টি করে।’

ঢাকা অঞ্চলে কয়েক দশকের মধ্যে খরা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, উত্তরবঙ্গের যেসব এলাকায় বেশি চাষাবাদ হতো, সেসব এলাকায় মানুষ একটু সচেতন হওয়ার কারণে আগের তুলনায় এখন ভালো চাষাবাদ হচ্ছে। কিন্তু আমাদের ঢাকার আশপাশের অঞ্চলে যেটি ঘটছে, আমরা ভূগর্ভস্থ পানি অত্যধিক মাত্রায় আহরণ করছি। আবার ভূপৃষ্ঠের পানি সংরক্ষণের জন্য কোনো জলাধারও রাখিনি। এজন্য ঢাকার আশপাশের এলাকাগুলোতে এক ধরনের খরা ধীরে ধীরে সৃষ্টি হচ্ছে। আমরা এখনো এটিকে খরা নাম দেইনি, তবে এটি যে বৈশিষ্ট্য ধারণ করেছে, সেটি খরার বৈশিষ্ট্যই। অর্থাৎ এ অঞ্চলে ঝুঁকি বাড়ছে, যা ভবিষ্যতে খরায় রূপ নেবে।

এই শিক্ষক আরও বলেন, আমি কয়েকদিন আগেই জয়পুরহাট গিয়েছিলাম। সেখানে লক্ষ্য করেছি, বিভিন্ন রকমের সবজি চাষ হচ্ছে। বিশেষ করে রাস্তার পাশের জমিগুলোতে ছোট ছোট করে জলাধার সৃষ্টি করা আছে, সেখান থেকে মানুষ সেচ ব্যবস্থা নিচ্ছে। কিন্তু যখন টাঙ্গাইলের দিকে চলে এলাম, তখন দেখলাম রাস্তার দুই পাশেই কৃষির প্রতি মানুষের আগ্রহ কম। পানি স্বল্পতা আছে, শিল্পায়ন হচ্ছে, সেগুলোর জন্য ভূগর্ভস্থ থেকে পানি উত্তোলন করা হচ্ছে। দূষিত হচ্ছে প্রাকৃতিক জলাধার। বিশেষ করে সিরাজগঞ্জের পর থেকে ঢাকা অংশের কথা বলা যায়। এই অংশে গাছ-গাছালির পরিমাণ কম। কৃষিজমি ও উৎপাদন কম। যেহেতু গাছের পরিমাণ কমে যাচ্ছে, আমি এই অঞ্চলটি নিয়ে আতঙ্কিত যে, অদূর ভবিষ্যতে এখানে এক ধরনের খরার সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।

ঢাকা অঞ্চলকে এমন পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করতে পরামর্শ দিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. নুরুল ইসলাম বলেন, ঢাকা অঞ্চলের কথা যদি বলতে হয়, এ অঞ্চলে নদীগুলোর পানিপ্রবাহ কমে গেছে। যমুনা ও পদ্মা নদীর পানি যেসব শাখা নদীর মাধ্যমে আসবে, সে শাখা নদীর মুখগুলো তো বন্ধ হয়ে গেছে। ছোট ছোট খাল ভরাট করে ফেলার কারণে এখন আর পানি নেই। পানির প্রবাহ না থাকায় যত বর্জ্য আছে, তা যখন বুড়িগঙ্গায় পড়ছে, সেখানে ময়লা জমে নদী নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পানির প্রবাহ রাখতে হলে মূল নদীর সঙ্গে যে শাখা আছে, সে শাখার মুখগুলো দখলমুক্ত রাখতে হবে।

এমআইএস/এএসএ/জিকেএস