আর মাত্র ক’দিন বাকি, তারপর মাত্র ৪-৫ ঘণ্টার মধ্যে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে ঢাকা পৌঁছে যাবে যাত্রীবাহী বাস ও পণ্যবাহী ট্রাক। সারাদেশের সঙ্গে ওই অঞ্চলের মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বন্ধন সুদৃঢ় হবে। কৃষি, শিল্প ও পর্যটন খাতে সাধিত হবে ব্যাপক উন্নয়ন। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে খুলবে নতুন দুয়ার। মানুষের আয় বৃদ্ধি পাবে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উপকৃত হবে সারাদেশের মানুষ।
Advertisement
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের হিসাবে পদ্মা সেতুর ফলে দেশের জিডিপি ১ দশমিক ২ শতাংশ এবং আঞ্চলিক জিডিপি ২ দশমিক ৩ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাবে। অন্য এক হিসাবে সারাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে যাবে ২ দশমিক ২ শতাংশে। তাতে ব্যাপক কর্মসংস্থান হবে। দারিদ্র্যের হার হ্রাস পাবে প্রায় ১ শতাংশ করে। দেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ও অর্থায়ন ত্বরান্বিত হবে। উন্নয়নের মূল ধারায় যুক্ত হবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েক কোটি মানুষ। তাদের জীবন ধারায় ব্যাপক পরিবর্তন আনবে পদ্মা সেতু। এ সেতুটি আমাদের গর্বের স্থাপনা। সক্ষমতার প্রতীক।
পদ্মা সেতু বিশ্বের ১১তম দীর্ঘ সেতু। এশিয়ার দ্বিতীয় দীর্ঘতম সেতু এটি। দৈর্ঘ ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। সেতুর ওপর চলবে গাড়ি, নিচে চলবে রেল। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ যুক্ত হবে এশিয়ান হাইওয়েতে। এই সেতুর প্রি-ফিজিবিলিটি স্টাডি হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম দফায় (১৯৯৬-২০০১) রাষ্ট্র পরিচালনাকালে, ১৯৯৯ সালে। ২০০১ সালের ৪ জুলাই তিনি এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এরপর তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর পদ্মা সেতু নির্মাণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেন। এতে অর্থায়নের কথা ছিল এডিবি, জাইকা ও বিশ্বব্যাংকের। কিন্তু ২০১২ সালে দুর্নীতির চেষ্টার ভুয়া অভিযোগ তুলে প্রথমে বিশ্বব্যাংক এবং পরে অন্যরা অর্থায়ন থেকে সরে যায়।
২০১৩ সালের ৪ মে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইতোমধ্যে ২০১৪ সালে দুর্নীতির চেষ্টার অভিযোগকে মিথ্যা আখ্যা দিয়ে কানাডার আদালত থেকে রায় দেওয়া হয়। অতঃপর বিশ্বব্যাংক সেতুটির অর্থায়নে ফিরে আসতে চাইলেও শেখ হাসিনার সরকার সে প্রস্তাবে সম্মত হয়নি। ওই বছর ১৭ জুন বাংলাদেশ সরকার এবং চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানির মধ্যে সেতু নির্মাণের আনুষ্ঠানিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
Advertisement
২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুন্সিগঞ্জের মাওয়াপ্রান্তে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের মূল পাইলিং কাজের উদ্বোধন করেন। এরপর অনেক সমালোচনা ও অবজ্ঞা উপেক্ষা করে ২০২২ সালের জুন মাসে পদ্মা সেতুর ওপরের তলার কাজ শেষ হয়। নিচতলায় রেললাইন স্থাপনের কাজ চলছে। শুরুতে সেতুটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। এখন তা বাস্তবায়নে লেগেছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। এর সঙ্গে যুক্ত আছে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের খরচ ১১ হাজার কোটি টাকা।
তাছাড়া রয়েছে রেললাইন নির্মাণের খরচ প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। সব মিলে মোট খরচ হবে ৮০ হাজার কোটি টাকার কিছু ওপর। এ পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশের এখনকার এক বছরের মোট বাজটের মাত্র ১২ শতাংশ। এর বিপরীতে দেশের মানুষের যে উপকার হবে তা সীমাহীন।
বাংলাদেশের সংবিধানের ১৬ অনুচ্ছেদে কৃষি বিপ্লব বিকাশের কথা বলা হয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশের অন্য অঞ্চলে কৃষি বিপ্লব অনেকটাই সফল হয়েছে। পিছিয়ে আছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল। এর প্রধান কারণ হলো যোগাযোগের অসুবিধা। উপকরণ পরিবহনে দীর্ঘসূত্রতা।
উৎপাদিত পণ্য বিপণনের দুর্ভোগ। এসব কারণে ওই অঞ্চলে শস্য নিবিড়তা অপেক্ষাকৃত কম। পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে এ অঞ্চলে কৃষি বিপ্লবের অভিপ্রায় সফল হবে। নতুন প্রযুক্তি ধারণ ত্বরান্বিত হবে। দ্রুত বেড়ে যাবে শস্যের উৎপাদন। গড়ে উঠবে কৃষিভিত্তিক শিল্পকারখানা। তাতে মানুষের কর্মসংস্থান হবে, বাড়বে আয়।
Advertisement
পদ্মা সেতুর ওপাড়ে শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও ফরিদপুরে রয়েছে ফসল চাষের বিস্তীর্ণ জমি। শাকসবজি ও মসলাজাতীয় ফসল উৎপাদনের জন্য এসব জমি খুব উপযোগী। ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ উন্নত হওয়ায় এখানে ফসলের পচনশীলতা কমবে। বিভিন্ন শাকসবজি এবং মসলা ফসলের, বিশেষ করে পেঁয়াজ ও রসুনের উৎপাদন বাড়বে। এই তিন জেলার চরাঞ্চলের বাদাম ও পাটচাষে কৃষকদের আগ্রহ বাড়বে। বাড়বে উৎপাদন। গড়ে উঠবে পাটভিত্তিক শিল্প।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে বলা হয় শস্যভান্ডার। কিন্তু এই ভান্ডারকে এতদিন পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি। এখন যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের ফলে সেখানে সবুজ বিপ্লব ত্বরান্বিত হবে। ধানের ঘাত সহিষ্ণু ও উচ্চ ফলনশীল নতুন জাতসমূহের বিস্তার ঘটবে। এতে চাল উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।
বরিশাল ও পটুয়াখালীতে তরমুজের চাষ হয়। কিন্তু রাজধানীর দুই কোটি মানুষের বাজারে তা আসতে পারে না। ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় এবং রক্ষণাবেক্ষণের অসুবিধাসহ বিপণন সমস্যার কারণে কৃষক তরমুজ চাষে তেমন লাভবান হন না।
এখন এ সমস্যা দূর হবে এবং ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দ্রুত তরমুজ প্রেরণ করা সম্ভব হবে। তাতে কৃষকদের তরমুজ বিক্রি করে ন্যায্যমূল্য পাওয়া নিশ্চিত হবে। দক্ষিণাঞ্চলের বিস্তীর্ণ চরে নারিকেল ও সুপারির চাষ হয়। সমতলে হয় পান ও তেজপাতার চাষ। পটুয়াখালীতে মুগ ডালের চাষ হয় বাণিজ্যিকভাবে। পদ্মা সেতুর ফলে এসব কৃষিপণ্যের চাষ উৎসাহিত হবে ব্যাপকভাবে।
পদ্মা সেতুর কারণে জায়গা-জমির দাম অনেক বেড়ে গেছে। সেতুর এপাশে মুন্সিগঞ্জ এবং ওপাশে শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও ফরিদপুরে বহু মানুষ এখন নতুন স্বপ্ন দেখছে। লেবুখালী সেতু উদ্বোধনের পর বরিশালের সঙ্গে পটুয়াখালী জেলার আর কোনো ফেরি চলাচলের প্রয়োজন হচ্ছে না।
এখন ঢাকার সঙ্গেও যান চলাচল সহজ হয়েছে। তাতে ফেরি পারাপারের ও লঞ্চে চলাচলের দুর্ভোগ ঘোচানো সম্ভব হয়েছে। ওই অঞ্চলে দ্রুত বেড়েছে জমির দাম। তাছাড়াও পদ্মা সেতুর সঙ্গে সংযুক্ত এলাকায় নদীশাসনের ফলে অনেক কৃষিজমি নদীভাঙন থেকে রেহাই পেয়েছে।
দেশের দক্ষিণাঞ্চল মৎস্য চাষ ও আহরণের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। চিংড়ি ও সামুদ্রিক মাছের সরবরাহ আসে মূলত দক্ষিণাঞ্চল থেকে। সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও খুলনা অঞ্চলে আছে অসংখ্য মাছের ঘের। সেখানে গড়ে উঠেছে অনেক প্রক্রিয়াকরণ শিল্প। তাতে কাজ করছে অসংখ্য গরিব মানুষ।
পদ্মা সেতুর ফলে নিবিড় মৎস্য চাষ উৎসাহিত হবে। রেণুপোনাসহ মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ও বিদেশে মৎস্য প্রেরণ সহজ ও ঝুঁকিমুক্ত হবে। তাতে মাছের অপচয় হ্রাস পাবে। আয় বাড়বে ক্ষুদ্র মৎস্য চাষীদের। তাছাড়া সুনীল অর্থনীতি হবে গতিশীল। সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।
পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের কাজের ক্ষেত্র অনেক সম্প্রসারিত হবে। উপযুক্ত কাজ ও আয়ের অভাবে যারা নিজের এলাকা ছেড়ে ঢাকা বা অন্য কোনো এলাকায় চলে গিয়েছিলেন, তারা নিজ ঘরবাড়িতে ফিরে আসবেন। আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ নেবেন।
ইপিজেড, পাটকল, চালকল পুরো মাত্রায় বিকশিত হবে। মোংলা, পায়রা বন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। তাতে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। সুন্দরবন ও সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটায় পর্যটন শিল্প বিকশিত হবে। ফলে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল। এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
লেখক: সাংবাদিক।
এইচআর/ফারুক/এএসএম