খেলাধুলা

নানা সংকট নিয়ে চলছে যশোর সুইমিংপুল

খাল-বিল, নদী-নালার দেশে ভালোমানের সাঁতারু বের করে আনার লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকা, বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহর এবং বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ জেলায় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অর্থায়নে নির্মাণ করা হয়েছে সুইমিংপুল। যে সব সাঁতারুরা শুধুমাত্র এসএ গেমস নয়, দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে এশিয়ান গেমস, এমনকি অলিম্পিক গেমসেও।

Advertisement

শুধু সাঁতারু বের করে আনাই নয়, বিভিন্ন ক্রীড়া ডিসিপ্লিনে খেলোয়াড়দের শরীরচর্চার অন্যতম অনুসঙ্গ হিসেবেও খুব প্রয়োজন সাঁতার। সাধারণ মানুষের সাঁতার শেখাটাও জীবনের অন্যতম প্রয়োজনীয় বিষয়।

সবকিছুকে সামনে রেখে সারা দেশে অন্তত ২৩টি সুইমিংপুল নির্মাণ করা হয়। কিন্তু নির্মাণের পর অধিকাংশ পুলই পড়ে রয়েছে জরাজীর্ণ অবস্থায়। কোনো কোনো পুলে তো একদিনের জন্যও কেউ নামতে পারেনি। কোথাও পানি নেই, কোথাও পাম্প নষ্ট, কোথাও নোংরা পানি- নানা অব্যবস্থায় পড়ে রয়েছে কোটি কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মিত সুইমিংপুলগুলো।

অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত এসব সুইমিংপুল নিয়েই জাগোনিউজের ধারাবাহিক আয়োজন। ষষ্ঠ পর্বে আজ থাকছে যশোর সুইমিং পুলের চালচিত্র...

Advertisement

* ২০০৫ সালে এনএসসির অর্থায়নে যশোরে আন্তর্জাতিকমানের সুইমিংপুল নিমার্ণ শুরুর পর উদ্বোধন করা হয় ২০০৮ সালে।* ২০১১ সালে প্রায় চার লাখ টাকা বিল বকেয়া থাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়।* ২০১৭ সালে জেলা ক্রীড়া সংস্থার পক্ষ থেকে দায়িত্ব পাওয়ার পর একে সংস্কার করে ফের ২০১৮ সালে চালু করে পৌরসভা। * সুইমিংপুলে লেন নেই। নেই ময়লা পরিষ্কারের জন্য নেট ও ভ্যাকুয়াম মেশিন। সুইমিংপুলটি জাতীয় মানের নয়।* প্রতি সপ্তাহে পানি পরিবর্তন করতে হয়। এজন্য সপ্তাহে দু’দিন পুলটি বন্ধ রাখতে হয়।* বড় সঙ্কট হচ্ছে, এটি রক্ষণাবেক্ষণ বা সংস্কারের জন্য কোনো অর্থ বরাদ্দ নেই।

করোনাকাল পেরিয়ে ফের ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে যশোর জেলা ক্রীড়া সংস্থার সুইমিংপুলটি। এই পুলটিকে ঘিরে যশোর থেকে জাতীয় মানের সাঁতারু তুলে আনার পরিকল্পনা করছেন জেলা ক্রীড়া সংস্থার কর্মকর্তারা।

যদিও কিছু সমস্যা এবং সংকটের কারণে পুলটিকে চালু রাখাই একটি চ্যালেঞ্জ বলে মানছেন সংশ্লিষ্টরা। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় স্থানীয় উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারেরও পদক্ষেপও দাবি করেছেন তারা।

যশোর জেলা ক্রীড়া সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, ২০০৫ সালে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের (এনএসসি) অর্থায়নে যশোরে আন্তর্জাতিকমানের সুইমিংপুল নিমার্ণের কাজ শুরু হয়। চার কোটি টাকা ব্যয়ে নিমিত সুইমিংপুলটি ২০০৮ সালের মাঝামাঝিতে উদ্বোধন করা হয়।

Advertisement

এরপর থেকে চার বছর ভালোই চলছিল জেলার সাঁতারুদের প্রশিক্ষণ। সে সময় কয়েকটি টুর্নামেন্টেরও আয়োজন করা হয়। ফলে সুইমিংপুল ঘিরে সাতাঁরুদের আনাগোন ছিলো; কিন্তু ২০১১ সালের মাঝামাঝি প্রায় চার লাখ টাকা বিল বকেয়া থাকায় সুইমিংপুলের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় বিদ্যুৎ বিভাগ।

সেই থেকে গত আট বছর রক্ষণাবেক্ষণের অভাব সুইমিংপুলটি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। ২০১৭ সালে জেলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি তৎকালীন জেলা প্রশাসক হুমায়ুন কবির পুলটির রক্ষাণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেন পৌরসভাকে। দায়িত্ব পেয়ে সুইমিংপুলটিকে সংস্কার করে পৌরসভা। সংস্কার শেষে ২০১৮ সালের শেষদিকে পুলটি উন্মুক্ত করা হয়।

পরবর্তীতে করোনাকাল পেরিয়ে আবারও সচল করা হয়েছে যশোর জেলা ক্রীড়া সংস্থার সুইমিংপুলটি। গত মার্চ থেকে সাঁতারুদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে সুইমিংপুল। পুলে সাঁতার শিখতে আসা তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র অরণ্য দেবনাথ অর্ক জানায়, পুকুর, নদী, সাগরে নেমে যেন ডুবে না যায়, সেজন্য সে সাঁতার শিখছে। আর ভালোভাবে সাঁতার শিখে সে প্রতিযোগিতায় পুরস্কারও জিততে চায়।

সন্তানকে সাঁতার শেখাতে নিয়ে আসে মা অ্যাড. স্বপ্না তরফদার বলেন, ‘সাঁতার শেখাটা প্রত্যেক মানুষের জন্যই জরুরি। এজন্য তিনি তার মেয়ে ও ভাইপোকে সাঁতার শেখাতে নিয়ে এসেছেন। সুইমিংপুলটি সাঁতার শেখার জন্য মোটামুটি ভাল।’ তবে তিনি প্রশিক্ষক বৃদ্ধি প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন।

সাঁতার প্রশিক্ষক মো. গোলাম মোস্তফা জানান, ‘সুইমিংপুলে লেন নেই। নেই ময়লা পরিষ্কারের জন্য নেট ও ভ্যাকুয়াম মেশিন। সুইমিংপুলটি জাতীয় মানের নয়। ভাল মানের পুলে বয়লার সিস্টেম থাকে। যার মাধ্যমে পানি রিফাইন করে ব্যবহার করা যায়। এখানে সে ব্যবস্থা নেই। আর এখানে পানিতে আয়রন হয় বেশি। প্রতি সপ্তাহে পানি পরিবর্তন করতে হয়। এজন্য সপ্তাহে দু’দিন পুলটি বন্ধ রাখতে হয়।’ যশোর জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাতাঁর পরিষদের সভাপতি অ্যাড. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘করোনার পর মার্চ থেকে সুইমিংপুল চালু করা হয়েছে। নতুন নতুন সাঁতার প্রশিক্ষণার্থী আসছে। তবে পুলটি চালু রাখা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পানি উত্তোলন, রক্ষণাবেক্ষণ, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা, পানি ভাল রাখতে রাসায়নিক উপকরণ, প্রশিক্ষক বেতনসহ সর্বসাকুল্যে প্রতিমাসে ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা ব্যয় হয়। প্রশিক্ষণার্থীদের বেতন থেকে এই টাকা নির্বাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে ভর্তুকি দিয়ে পুল চালু রাখা হয়েছে।’

তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘সুইমিংপুলের গ্যালারি, ডাইভিংপুলসহ আরও কিছু প্রয়োজনীয় সংযোজন ও সংস্কার দরকার। পুলের জন্য কোনো কেয়ারটেকার নেই। এখানে স্থায়ী কেয়ারটেকার দরকার। এসব বিষয়ে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কাছে আবেদনও জানানো হয়েছে।’

তবে যশোর জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাতাঁর পরিষদের সাবেক সম্পাদক আব্দুল মান্নান বলেন, ‘পুল চালু হলেও সাঁতার নিয়ে ক্রীড়া সংস্থার পরিকল্পনা ও উদ্যোগে ঘাটতি রয়েছে। যশোরে দীর্ঘদিন ধরে কোনো সাঁতার প্রতিযোগিতা নেই; নেই ওয়াটারপোলো টুর্নামেন্ট। এমনকি ট্যালেন্ট হান্টও নেই। ফলে নতুন সাঁতারু উঠে আসছে না। আগে পুল না থাকলেও যশোর থেকে জাতীয় মানের সাঁতারু উঠে এসেছে। এখন পুল থাকার সেই ধারা নেই।’

সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা হয় যশোর জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা ইয়াকুব কবীরের সাথে। তিনি বলেন, ‘করোনাকালে দু’বছর সাঁতারসহ খেলাধুলা বন্ধ ছিল। এখন সুইমিংপুল সংস্কার করে সাঁতার চলছে। নতুনরা সাঁতার শিখছে। পাশাপাশি পুরানো সাঁতারুরাও প্র্যাকটিস করছে। ফলে আমরা আশাবাদী আগামী দু’বছরের মধ্যে যশোর আবার সাঁতারে আগের অবস্থানে উঠে আসবে।

ইয়াকুব কবীর উল্লেখ করেন, ‘সুইমিংপুলের বড় সঙ্কট হচ্ছে, এটি রক্ষণাবেক্ষণ বা সংস্কারের জন্য কোনো অর্থ বরাদ্দ নেই। এ ব্যাপারে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি গ্যালারি নির্মাণসহ কিছু সংস্কারের জন্যও জাতীয় ক্রীড়া পরিষদকে অবহিত করা হয়েছে।’

মিলন রহমান/আইএইচএস/