ইসরায়েল ইস্যুতে পাকিস্তানের রাজনীতির মাঠ গরমের চেষ্টা করছেন দেশটির সদ্য পদচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। গত মে মাসে প্রবাসী পাকিস্তানিদের ১৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দলের ইসরায়েল সফরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিতর্ক তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি।
Advertisement
প্রতিনিধি দলটি ইসরায়েলের রাষ্ট্রপতি আইজ্যাক হারজোগের সাথে বৈঠক করে। এসময় আইজ্যাক হারজোগ তাদেরকে ‘গর্বিত’ পাকিস্তানি' বলে আখ্যা দেন। এদিকে সাধারণ পাকিস্তানিদের মধ্যে ইসরায়েল বিরোধী মনোভাবকে অস্ত্র বানিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা নিতে চেয়েছেন ইমরান খান। গত ২৮ মে খাইবার পাখতুনখোয়ার চরসাদ্দায় পিটিআই-এর একটি কনভেনশনে তিনি সরকারের সমালোচনা করে দাবি করেন, ‘পাক সরকার ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে।’
যদিও পাকিস্তানের পরিকল্পনা বিষয়ক ফেডারেল মন্ত্রী আহসান ইকবাল বলেন, ‘পাকিস্তানের কোনও সরকারী বা আধা-সরকারি প্রতিনিধি দল ইসরায়েলি রাষ্ট্রপতির সাথে দেখা করেনি।’এর আগে পাকিস্তানি আমেরিকান আনিলা আলী নিজের টুইটার অ্যাকাউন্টে একটি ছবি শেয়ার করে ইসরায়েল সফরের কথা জানান। তিনি তেহরিক-ই-পাকিস্তান ও কায়েদ-ই-আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর উপর তার বাবা কুতুবউদ্দিন আহমেদের লেখা একটি বই উপহার দিতে গত ১২ মে ইসরায়েলি রাষ্ট্রপতির সাথে দেখা করেছিলেন। ওই সফরে যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তান টেলিভিশন (পিটিভি) উপস্থাপক ওয়াকার কুরেশিও।
এর জেরে কুরেশিকে বরখাস্ত করে পাকিস্তান সরকার। এরপরেও পিটিআই সরকারের সাবেক মানবাধিকার মন্ত্রী শিরিন মাজারি কুরেশির ওই সফরে যোগ দেওয়ার সমালোচনা করেন। মাজারি বলেন, কুরেশি রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। ফলে তার সফর অগ্রহণযোগ্য। পিটিআই সদস্য আরসলান খালিদও পাকিস্তান ও ইসরায়েলি প্রতিনিধিদলের মধ্যে বৈঠকের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
Advertisement
এদিকে টুইটারে ওয়াকার বলেন, প্রতিউত্তরে মাজারির সাবেক কর্মকর্তা সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাজা কাসুরি ২০০৫ সালে তুরস্কে পাকিস্তান-ইসরায়েলের প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারণের পর থেকে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) চেয়ারম্যান ইমরান খান সরকারের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করে আসছেন।
তার দাবি, সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে মার্কিনীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল ভারত ও ইসরায়েল। তার এই কথায় এটি প্রমাণিত হয়েছে যে তিনি ইসরায়েলের সঙ্গে পর্দার আড়ালে 'ট্র্যাক-২ কূটনীতি' চালু করেছিলেন। গত ২১ মে জিও টিভির এক প্রতিবেদনে ইসরায়েল সফরের প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য আমেরিকান মুসলিম এবং মাল্টিফেইথ উইমেনস এমপাওয়ারমেন্ট কাউন্সিলের নেতা আনিলা আলি ব্রিটিশ ও আমেরিকান পাকিস্তানিদের সাথে দুজন পাকিস্তানিকে ইসরায়েল সফরের অনুমতি দেওয়ায় ধন্যবাদ জানান।
এতে তিনি পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পাকিস্তানি পাসপোর্টে বেনখাল্ড নামে এক পাকিস্তানি ইহুদিকে ধর্মের জায়গায় ইহুদি ধর্ম লেখার অনুমতি দেওয়ার জন্য ইমরানের সরকারকে ধন্যবাদ জানান।
জমিয়ত উলেমা ইসলাম- (ফজলুর) ও পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম) এর প্রধান মাওলানা ফজলুর রহমান আগেও দাবি করেছিলেন পাকিস্তানে ইমরান খানের সরকার চক্রান্তের জন্যে ইসরায়েলসহ আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়দের ডেকে এনেছেন।
Advertisement
১৯৯৫ সালের মার্চ মাসে স্যার জেমস গোল্ডস্মিথের মেয়েকে প্রথম বিয়ে করার জেরে রাজনৈতিক কর্মজীবন জুড়ে ইমরান খানের সমালোচকরা তাকে ইসরায়েলি/ইহুদি দালাল হিসেবে অভিযুক্ত করেছেন। এছাড়াও তিনি ইসলামী শিক্ষার বাইরে অতীতে আন্তর্জাতিক প্লেবয় হিসেবে চিহ্নিত হতেন।
২০২১ সালে করাচিতে একটি ইসরায়েল-বিরোধী সমাবেশের নেতৃত্ব দিয়ে ফজলুর রহমান দাবি করেন, প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এমনকি বিরোধীদলীয় নেত্রী মরিয়ম নওয়াজ শরীফও ইমরান খানের বিরুদ্ধে একই তোপ দেগেছেন।
এক সমাবেশে তিনি বলেন, আমেরিকান ইহুদি আইনজীবী ব্যারি সি. স্নেপস ইমরান খানের পিটিআইকে আর্থিক সহায়তা দেন। তিনি ইসরায়েলের কাছ থেকে অর্থায়ন পান। যদিও ইমরান খানের দাবি তাকে অনাস্থা প্রস্তাবে ক্ষমতা থেকে অপসারণের ঘটনা আসলে বিদেশী শক্তি ষড়যন্ত্র। ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের নিন্দা করতে ইসলামাবাদের ব্যর্থতা ও ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিতে ইমরান উদ্যোগ না নেওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই ঘটনা ঘটিয়েছে। এমনকি রাজনৈতিক বিরোধীদের তিনি আমেরিকার দাস হিসেবেও অভিহিত করেন।
৯০'র দশকে রাজনীতিতে প্রবেশের পর থেকে ইমরান খান নিজেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমান হিসেবে দাবি করে পাকিস্তান ও মুসলিম উম্মাহর স্বার্থের জন্য যেকোন কিছু ত্যাগ করতে ইচ্ছুক বলে নিজেকে প্রমাণ করতে চেয়েছেন। সবশেষ তিনি দাবি করলেন, যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও ভারত তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।
গত বছর সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশি অভিযোগ করে বলেন, বিভিন্ন স্তরে ইসরায়েলের গভীর জাল বিছানো রয়েছে। তারা মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করেন। খাইবার পাখতুনখাওয়ার চরসাদ্দায় পিটিআই কর্মীদের কনভেনশনে ভাষণ দেওয়ার সময় ইমরান খান বলেন, এই সরকার কাশ্মীরের জনগণকে বিক্রি করার জন্য ভারতের সাথে একটি চুক্তি করবে।
তিনি বলেন, এই সরকারের কারো সঙ্গে কোন অংশীদারিত্বের যোগাযোগ নেই। একারণে তারা তারা আন্তর্জাতিক অর্থ ঋণদাতার দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। এছাড়া তারা বিদেশ থেকে নির্দেশ নেয় ও বিদেশী নির্দেশের সাথে সঙ্গতি রেখে সমস্ত সিদ্ধান্ত নেয়।
তিনি বলেন, অনাস্থা পদক্ষেপের মাধ্যমে পিটিআই সরকারকে অপসারণের পর সারা ভারতে আনন্দের পরিবেশ ছিল। পাকিস্তানে সরকার পরিবর্তনে ভারতীয়রা এত খুশি হয়েছিল যেন শেহবাজ শরিফ নয়, শেহবাজ সিং দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন।
পাকিস্তানে ইহুদি-বিদ্বেষকে গভীরভাবে চাষ করা হয়েছে। ষড়যন্ত্রের কথা দাবি করে জনগণের মধ্যে অতিরঞ্জিত মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হয়েছে। ইসরায়েল বা ইহুদিরা পাকিস্তানকে অস্থিতিশীল বা ভাঙ্গার দীর্ঘমেয়াদী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে এমন দাবির ভিত্তি নেই বলেই বিভিন্ন সময় প্রমাণ মিলেছে। তবুও রাজনৈতিক কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে ইহুদি ও ইসরায়েলের বিরোধিতাকে পুঁজি করেছেন ইমরান খান।
ইমরান খান নিজে যেখানে রাজনৈতিক জীবনে তথাকথিত ইহুদি ষড়যন্ত্র তত্ত্বের শিকার ছিলেন তিনিও রাজনীতিতে পিছিয়ে পড়া পরিস্থিতি সামাল দিতে মার্কিন-ইসরায়েল এবং ভারতকে জড়িয়ে বক্তব্য দিয়ে একই পথ ধরেছেন।
ফজলুর রহমানের জেইউআইসহ (এফ) পাকিস্তানের অন্যান্য রাজনৈতিক দলের আচরণ একই রকম। তারা তৃতীয় দেশে ইসরায়েলিদের সাথে গোপনে বৈঠক করা সত্ত্বেও তেল আবিবের সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক অস্বীকার করে থাকে। পর্দার আড়ালে তারা গভীর সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা চালিয়ে গেলেও তা প্রকাশ্যে অস্বীকার করেন।
যেখানে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ অনেক বিশিষ্ট সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ অর্থনৈতিক বিবেচনার কারণে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করছে, সেখানে পাকিস্তান সম্পর্কের জায়গায় নয়-ছয় অবস্থান বজায় রাখছে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/এএসএম