মতামত

গতানুগতিক বাইশের বাজেট

বাজেট পেশের একটাই নিয়ম। অর্থমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে বলে দেন সরকার কী করতে চেয়েছে আর কী করতে পেরেছে। আমরা, মানে আম পাবলিক কী আশা করেছিলাম আর কী পেলাম সেটা নিয়ে ভাবার, বলার আবকাশ নেই তার। বাজেটের অঙ্কটা তাকে মেলাতেই হয় এবং সেটা ঘাটতি হলেও আমাদের জীবনের অঙ্কটা মেলানোর ফুরসত নেই। ব্যবসায়ী আর বুদ্ধিজীবীরা কয়েকদিন কথা বলবেন, পত্রিকার পাতা ভরে থাকবে নানা অঙ্কে আর মানুষ তার অঙ্ক মেলাবে শ্রমে আর ঘামে।

Advertisement

২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার মধ্যে সরকার নিজেই খরচ করবে ৪ লাখ ৩১ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ বেতন-ভাতা, মঞ্জুরি ও সাহায্য, ভর্তুকি ও সুদে চলে যাবে প্রায় সব টাকা। এই লক্ষ্যমাত্রা আদায় করতে গেলে নিবর্তনমূলক হতে হবে এবং সাধারণ মানুষের ওপর করের চাপ বাড়বে।

উন্নয়নের জন্য থাকছে সরকারের পরিচালন ব্যয়ের প্রায় অর্ধেক- ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। মোটা দাগে এটাই বাজেট, যা অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উত্থাপন করেছেন। অর্থমন্ত্রীর ভাষায় তার বাজেটের শিরোনাম ‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় পরিবর্তন’।

এই বাজেটে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা এবং সমস্যাটা এখানেই। এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয় না, কোনো বছরই হয় না এবং এজন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড- এনবিআর এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে কোনো জবাবদিহিতা করতে হয় না। বরং সংসদ বছরান্তে একটি সংশোধিত বাজেট পাস করে দিয়ে এই ব্যর্থতা জায়েজ করে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সংগৃহীত কর থেকে পাওয়া যাবে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। এনবিআরবহির্ভূত কর থেকে আসবে ১৮ হাজার কোটি টাকা আর কর ব্যতীত প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা।

Advertisement

এবারের বাজেটে মোট ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। ঘাটতির মধ্যে অনুদানসহ বৈদেশিক উৎস থেকে আসবে ৯৮ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা। এটি সত্যি পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ আছে। তাই অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আসবে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকার যে টার্গেট আছে তার প্রায় পুরোটাই আসবে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ আকারে। এত টাকা যদি সরকারই নেয় তাহলে বিনিয়োগ আর ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বেসরকারি খাত ঋণ পাবে কোথায়?

কিছু কিছু বিষয়ের স্বীকৃতি পাওয়া গেল এবারের বাজেটে। এতদিন একটা রাখঢাক ছিল বাংলাদেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচার নিয়ে। অর্থমন্ত্রী বিষয়টির স্বীকার করে নিয়ে বিদেশ থেকে টাকা ফেরত আনার ব্যাপারে কর ছাড় দিলেন। যারা অবৈধভাবে টাকা নিয়ে গেলেন, তারা ৭ শতাংশ দিয়েই সাদা মনের মানুষ হয়ে যেতে পারবেন। এটা অনৈতিক। প্রথমে সবাইকে অনৈতিকভাবে আয় করার সুযোগ করে দিয়ে পাচারের সুযোগ দিয়ে আবার করছাড়ের মাধ্যমে তাদের বৈধ করে দেওয়া হবে। ফলে যারা সৎপথে ব্যবসা করেন বা আয় করেন তারা উৎসাহ হারাবেন। ন্যায্যতার প্রশ্নেও বিষয়টি অগ্রহণযোগ্য। সৎ ব্যবসায়ীরা কর দেবেন বছরে ২০-৩০ শতাংশ হারে আর পাচারকারীরা ৭ শতাংশ দিয়েই বৈধ হয়ে যাবেন।

কয়েক বছর ধরে দেশে নাগরিকের আয়ের বৈষম্য বাড়ছে। বাড়ছে শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্যও। বাড়ছে স্বাস্থ্যের অধিকারের বৈষম্যও। অন্তত কোভিডের সময় কেন্দ্রের প্রকাশিত উদ্বেগ এবং নাগরিকের অবস্থা নিয়ে দুশ্চিন্তার দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আশা করা গিয়েছিল শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে খরচ অন্তত তুল্যমূল্য ভাবে বেড়ে বিভেদ কমানোর প্রচেষ্টার প্রতিফলন করবে। সেটা দেখা গেলো না। বাজেটের বাকি অঙ্ক না দেখে আরও বিস্তারে যাওয়া মুশকিল কিন্তু এখন পর্যন্ত যেটুকু দেখা গেছে তাতে আবারও বলতে হয়, কর ব্যবস্থায় কোন সংস্কারের পদক্ষেপ নেই এই বাজেটে।

সেই চিরাচরিতভাবে বললেন, রাজস্ব আহরণ কার্যক্রম জোরদার করা হবে এবং সেজন্য অটোমেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে। মূল্য সংযোজন কর ও আয়করের নেট বৃদ্ধি করা হবে। এসব কথা আমরা বছরের পর বছর ধরে শুনে আসছি। বাস্তবতার খাতিরে তাকে বলতেই হলো, বিলাসী ও অপ্রয়োজনীয় আমদানি নিরুৎসাহিত করা হবে এবং আন্ডার ও ওভার ইনভয়েসিংয়ের বিষয়টি সতর্ক পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার প্রতিযোগিতামূলক রাখা হবে। প্রশ্ন হলো চাহিদার প্রবৃদ্ধি থামিয়ে দিয়ে সংকট সমাধান কীভাবে হবে? চাহিদা কমলে জিডিপিই-বা কীভাবে সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে? এসব প্রশ্নের উত্তর আপাতত নেই।

Advertisement

কোভিড-১৯ আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমদানি ব্যয় বেড়েছে, কমেছে প্রবাসী আয়, ঘটেছে মূল্যস্ফীতি, সরকারের ভর্তুকি ব্যবস্থাপনার ওপর সৃষ্টি হয়েছে ভয়ংকর চাপ। এই বাস্তবতায় অর্থমন্ত্রী কম অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পসমূহের বাস্তবায়নে ধীরে অগ্রসর হওয়া আর উচ্চ ও মধ্যম অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পসমূহের বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করার প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানাই।

বড় বাজেটের বড় চ্যালেঞ্জ বাজেট বাস্তবায়ন। ব্যয় মেটাতে গিয়ে যদি জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয় তবে আগুনের বাজার এবার বিস্ফোরিত হবে। বহু মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকাই কঠিনতর হবে। কারণ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট কিছু চোখে পড়ল না। করমুক্ত আয়ের সীমা কেন একই জায়গায় রেখে দেওয়া হলো সেটাও বোধগম্য নয়। সরকারের ব্যয় উল্লেখযোগ্য হারে বাড়লেও, আয়ের উৎস কার্যত সীমিত থেকে গেছে। ফলে বিশাল ব্যয়ের ধাক্কা সামলানোর কৌশলই সারাবছর সরকারের কাছে বেশি প্রয়োজনীয় হবে মানুষের ভাবনার চেয়ে।

অতিমারি-উত্তর বিশ্ব অর্থনীতিতে এখন যুদ্ধের ধাক্কা। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের দুশ্চিন্তার কারণ হলো, বাজারে কেনাকাটা। মূল্যবৃদ্ধি মাথাচাড়া দিয়ে সামর্থ্যের বাইরে চলে গেছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে কী গতি আসবে, তা-ও অজানা। এক প্রান্ত থেকে ধারালো পেস বোলিংয়ের মতো বেকারত্ব আর অন্য প্রান্ত থেকে মূল্যবৃদ্ধির বিষাক্ত সুইং- আমাদের জন্য এটাই বাজেট, এটাই জীবন।

লেখক: সাংবাদিক।

এইচআর/এমএস/ফারুক