মো. মাহমুদুল হাসান মাহমুদ
Advertisement
তোমারে দেব না ভুলিতে- অজস্র পরাণের গহীন ভিতর রাজসিক আসন তার। তাকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা ৷ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, বীর মুক্তিযোদ্ধা সর্বকনিষ্ঠ শহীদ বুদ্ধিজীবী শেখ আব্দুস সালাম।
আমাদের প্রিয় মানুষ, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ক্ষণজন্মা পুরুষ, বিদায়ী একজন নেতা, একজন অভিভাবক যার অভাব কোনোদিন পূরণ হওয়ার নয়। তিনি চিরঅম্লান হয়ে আছেন ও থাকবেন নড়াইলবাসী তথা বাঙালির হৃদয়ে। মহান আল্লাহ তাঁর আত্মাকে শান্তিতে রাখুন, ভালো রাখুন অনন্তকাল।
শহীদ শেখ আব্দুস সালাম ছিলেন সত্যিকার অর্থে সমাজের প্রাজ্ঞজন। উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত, নড়াইল জেলার সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান শহীদ শেখ আব্দুস সালাম একজন উদারমনা, অসাম্প্রদায়িক, ধর্মপরায়ণ মানুষ ছিলেন। সমাজের সব পঙ্কিলতার বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রামী ছিলেন তিনি।
Advertisement
তিনি ছিলেন একাধারে সুবক্তা, আলোচক, প্রাবন্ধিক, সাহিত্য-সংস্কৃতিকর্মী ও রাজনীতিবিদ। বাংলাদেশের মহান স্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহধন্য মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী খ্যাতনামা এই শিক্ষাবিদ শহীদ বুদ্ধিজীবী শেখ আব্দুস সালাম ১৯৪০ সালের ১২ জুলাই নড়াইল জেলা শহরের কালিয়া থানার অদূরে একটি ছায়াঘেরা নিবিড় গ্রাম বিলবাওচ এ জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম শেখ আবদুল গফুর এবং মাতা ফুলজান নেছা। এলাকায় জনশ্রুতি আছে , বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত ক্ষণজন্মা মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শহীদ শেখ আবদুস সালামকে ভালোবেসে 'আমার কালোমানিক' বলে জনসভায় সম্বোধন করতেন।
শেখ আব্দুস সালাম ১৯৫৬ সালে কালিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৫৮ সালে নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ১৯৬০ সালে তিনি খুলনা বিএল কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। পরে খুলনা আইন কলেজ থেকে বিএ'ল এবং ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে বিএড ডিগ্রি লাভ করেন।
পারিবারিক জীবন ও রাজনীতির কারণে তার ধারাবাহিক শিক্ষাজীবনে কিছুটা ছেদ পড়লেও পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষাব্যবস্থা, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করেন। এখানেও তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। ১৯৬৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ ক্লাসে ভর্তি হন। ১৯৭০ সালে ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে এমএ প্রথম পর্ব পাস করেন এবং ১৯৭১ সালে শেষ পর্বের পরীক্ষা চলাকালে আন্দোলনের কারণে পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যায়।
শেখ আব্দুস সালাম ১৯৬০ সালে কালিয়ার নওয়াগ্রাম ইউনাইটেড একাডেমির প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে তিনি বেন্দা ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশন এবং বড়দিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি কালিয়া বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হন। তিনি এই সময়ের মধ্যেই চারটি স্কুল ও একটি কলেজের এফিলিয়েশন করাতে সক্ষম হন।
Advertisement
তাছাড়া কালিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যান। মহান স্বাধীনতা পর কলেজের কার্যক্রম পুরোপুরি শুরু হলেও পূর্বেই কার্যক্রম পরিচালনার জন্য শহীদ শেখ আব্দুস সালামকেই অধ্যক্ষ হিসেবে নির্বাচন করেন কলেজ প্রতিষ্ঠার পেছনের আরেক স্বপ্নদ্রষ্টা তারই সহযোদ্ধা ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহচর,মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সাবেক সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধ শহীদ এখলাস উদ্দিন আহমেদসহ অন্য স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা।
শহীদ শেখ আব্দুস সালামের এই কলেজ প্রতিষ্ঠার পেছনে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ স্বাধীনতার পর কলেজটির নামকরণ হয় 'শহীদ আব্দুস সালাম মহাবিদ্যালয়' পরে 'শহীদ আব্দুস সালাম ডিগ্রি কলেজ' হিসেবে উন্নীত হয়।
শহীদ শেখ আব্দুস সালাম কালিয়ার মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন। মহান স্বাধীনতা আন্দোলনে কালিয়ায় তার নেতৃত্বেই প্রথম অস্ত্র সংগ্রহ, ডিস্ট্রিবিউশন ও প্রশিক্ষণসহ মুক্তিবাহিনী গঠিত হয়, যা সালাম বাহিনী নামে পরিচিত ছিল। কালিয়ায় কয়েকটি প্রতিরোধ যুদ্ধ ও যশোরের ঝুমঝুমপুর যুদ্ধে কালিয়ার নেতৃত্ব তিনিই দেন।
শেখ আব্দুস সালাম ছাত্রাবস্থা থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি ১৯৬৯ সালে আইয়ুববিরোধী গণআন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন ও স্যার এফ এম হলের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। রাজনৈতিক তৎপরতার কারণে ১৯৭০ সালে তিনি সামরিক সরকার কর্তৃক কারারুদ্ধ হন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলনে আবদুস সালাম সংগঠকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। এ সময় তিনি ছিলেন নড়াইল মহাকুমার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
তার নেতৃত্বে কালিয়ায় প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। আবদুস সালাম সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। লোকমুখে জানা যায়, স্বাধীনতার সময়ে তার একটি রেডিও ও টেপরেকর্ডার ছিল। সেই টেপরেকর্ডারে তিনি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ রেকর্ড করেছিলেন, যা কালিয়ার বিভিন্ন এলাকায় মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করতে বাজিয়ে শোনাতেন এবং পাকিস্তানিদের শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে জনগণের উদ্দেশে জ্বালাময়ী ভাষণ দিতেন। কালিয়ার আপামর জনসাধারণ সেই ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
কালিয়ায় যুদ্ধ শুরু হলে প্রতিরোধযুদ্ধে তিনিই প্রথম নেতৃত্ব দেন। কিন্তু তাদের সেই প্রতিরোধযুদ্ধ বেশি দিন টেকেনি কারণ যুদ্ধে সক্রিয় নেতৃত্ব দেওয়ায় কারণে পাকিস্তানি সেনারা তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি পাক আর্মির হাতে গ্রেফতার হন। ধরা পড়ার পর যশোর সেনানিবাসে শেখ আব্দুস সালামের ওপর মধ্যযুগীয় কায়দায় অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়।
১৯৭১ সালের মে মাসের প্রথমদিকে রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি সৈন্যরা শেখ আব্দুস সালামকে গ্রেফতার করে। যশোর ক্যান্টনমেন্টে কয়েকদিন নির্যাতনের পর ১৩ মে তাকে হত্যা করা হয়। তার ওপর চলা নির্যাতনের ঘটনা পরে জানা যায় বেঁচে যাওয়া একজন প্রত্যক্ষদর্শীর মাধ্যমে। তার নাম আলিমুজ্জামান। তিনি পরবর্তী সময়ে যশোরের সিভিল সার্জন হয়েছিলেন। তিনিও আব্দুস সালামের সঙ্গে আটক ছিলেন। আরও অনেকে সেখানে আটক ছিলেন।
আলিমুজ্জামানের ভাষ্যমতে জানা যায়, পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের প্রহসনমূলক বিচার শুরু করে। বিচারকালে বিচারক তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, তিনি আওয়ামী লীগ করেন কি না? বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ প্রচার করেছেন কি না? শেখ আব্দুস সালাম নির্ভীকভাবে উত্তর দিয়েছেন, তিনি আওয়ামী লীগ করেন। কারণ, আওয়ামী লীগ তো বেআইনি দল নয়। তারপর তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের মহান স্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যা, গণতন্ত্রের মানসকন্যা দেশরত্ন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী খ্যাতনামা এই শিক্ষাবিদ শহীদ বুদ্ধিজীবী শেখ আবদুস সালাম এর নামে কলেজটিকে সম্প্রতি সরকারীকরণ করেছেন। এর আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকতে ১৯৯৮ সালের ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে বাংলাদেশ সরকারের ডাকবিভাগ থেকে তার নামে স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করেন।
তাছাড়া স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময়ে এই বীর মুক্তিযোদ্ধার নামে তার জন্মস্থান যে ইউনিয়নে অবস্থিত তার নামকরণ তার এলাকাবাসীর দাবি ও তখনকার আওয়ামী লীগ নেতা তারই সহযোদ্ধা ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহচর, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সাবেক সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এখলাস উদ্দিন আহম্মদের প্রচেষ্টায় ‘সালামাবাদ ইউনিয়ন পরিষদ’ করা হয়।
সবশেষে আমার বিনীত স্বীকারোক্তি যে, বীর মুক্তিযোদ্ধা সর্বকনিষ্ঠ শহীদ বুদ্ধিজীবী শেখ আব্দুস সালাম বিষয়ে পড়াশোনা বা তেমন কোন গবেষণা আমার নেই; ছোটবেলা থেকে এই অকুতোভয় সৈনিকের অনেক গল্প শুনেছি একান্ত মনোযোগী শ্রোতা হয়ে (আমার পরিবারের কাছে) তা ছাড়া তার অনেক সহযোদ্ধা ও শুভাকাঙ্ক্ষীর কাছ থেকে যেসব গল্প শুনেছি, সেসব মতামত ও সামান্য কিছু পড়াশোনা থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আমি আমার মতো করে জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তান, বীর মুক্তিযোদ্ধা সর্বকনিষ্ঠ শহীদ বুদ্ধিজীবী শেখ আব্দুস সালামকে নিয়ে লিখছি।
বিদগ্ধ ও পণ্ডিতজনের কাছে অনুরোধ, আপনাদের কাছে যদি অতিরিক্ত কোনো তথ্য থাকে তা জানিয়ে লেখাটি সমৃদ্ধ করতে ভুলবেন না, কেননা জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পরিচয় করিয়ে দিতে পারি। আমাদের অনেক দায় আছে।
উল্লেখ্য, শেখ আবদুস সালাম এক ছেলে ও তিন মেয়ের জনক। ছেলে শেখ মিজানুর রহমান, প্রকৌশলী। বর্তমানে সুইডেনপ্রবাসী। বড় মেয়ে শেখ তাসলিমা মুন, আইন বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরে স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেছেন তুলনামূলক আন্তর্জাতিক আইনে বর্তমানে সুইডেনপ্রবাসী, সেখানে সরকারি কর্মকর্তা l
মেজ মেয়ে ড. শেখ মুসলিমা মুন, ডেপুটি সেক্রেটারি, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অব ভেটেরিনারি মেডিসিন স্নাতক ও এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, থাইল্যান্ড থেকে জেন্ডার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে স্নাতকোত্তর করেন l নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগ থেকে lছোট মেয়ে ড. শেখ সালমা নার্গিস, সরকারি কর্মকর্তা। স্ত্রী মরহুমা মনোয়ারা সালাম ছিলেন একজন শিক্ষক, সমাজসেবক।
তথ্যসূত্র : বাংলাপিডিয়া ও অন্যান্য।
লেখক: গবেষক।
এইচআর/ফারুক/জিকেএস