রাজনীতি

পদ্মা সেতু ‘দুর্নীতির টেক্সটবুক এক্সাম্পল’ হয়ে থাকবে: রুমিন

পদ্মা সেতু নির্মাণের বিপুল লুটপাট আগামীতে ‘দুর্নীতির টেক্সটবুক এক্সাম্পল’ হয়ে থাকবে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা।

Advertisement

বুধবার (৮ জুন ) রাতে জাতীয় সংসদে ‘জাতিকে পদ্মা সেতু উপহার দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ’ জানিয়ে আনা প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে এ মন্তব্য করেন তিনি।

রুমিন ফারহানা এক গল্পের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, লিথুয়ানিয়ার কৌনাস পৌরসভার ‘গোল্ডেন টয়লেটের’ মতো পদ্মা সেতু হবে বাংলাদেশের ‘গোল্ডেন ব্রিজ’। লিথুনিয়র কৌনাস পৌরসভার মেয়র শহরে একটি টয়লেট নির্মাণ করেছিলেন দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে। কাছাকাছি একটি টেনিসক্লাবে একই ধরনের টয়লেট বানায় সাড়ে চার লাখ টাকা খরচ করে। টয়লেট নির্মাণে মেয়রের অবিশ্বাস্য খরচের কারণে মানুষ মজা করে সে টয়লেটকে বলতো গোল্ডেন টয়লেট। একই রকম বা একটু বেশি দৈর্ঘ্যের অন্যান্য সেতুর সঙ্গে পদ্মা সেতুর মডেলের, পদ্মা সেতুকে আমরা বলতেই পারি গোল্ডেন ব্রিজ। যৌক্তিকভাবে অনুমান করি কৌনাস টয়লেট কেসের পাশাপাশি বাংলাদেশ গোল্ডেন ব্রিজ কেসও দুর্নীতির টেক্সটবুক এক্সাম্পল হয়ে থাকবে।

তিনি বলেন, পদ্মা বহুমুখী সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল ২০১১ সালে, শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৩ সালে। মূল প্রকল্পের পরিকল্পনা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালে। সেই সময় ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা মূল আলোচিত পদ্মা প্রকল্প পাস হয়। পরে দুর্নীতির অভিযোগ যখন বিশ্বব্যাংক চলে যায় তখন আওয়ামী লীগ পদ্মা সেতুর ভার নেয় ।

Advertisement

‘আর দফায় দফায় এর মেয়াদ বাড়ে। অর্থ ব্যয়ে তা ৩০ হাজার কোটি টাকা হয়। আমাদের সঙ্গে তুলনা করলে ভারত, চীন, মালয়েশিয়ায় প্রতি কিলোমিটার সেতু তৈরি করতে খরচ পড়ে পাঁচশ থেকে সাতশ কোটি টাকা। বুয়েটের অধ্যাপক শামসুল হকের মতে, আমাদের দেশে প্রতি কিলোমিটার সড়ক পথে ব্যয় হয় পাঁচশ কোটি, রেল সেতুতে খরচ হয় সাতশ কোটি টাকা প্রতি কিলোমিটারে। নদীর ভূপ্রকৃতি বিবেচনায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটা দ্বিগুণও হতে পারে। অর্থাৎ সেল সেতুতে সর্বোচ্চ ১৪০০ কোটি টাকা ব্যয় হতে পারে। অথচ পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় ৫ হাজার কোটি টাকা প্রতি কিলোমিটারে।’

পদ্মা সেতু নির্মাণে ‘লুটপাটের’ তথ্য তুলে ধরতে গিয়ে বিএনপির এই সংসদ সদস্য বলেন, ঘরের পাশে ভূপেন হাজারিকা সেতুর দিকে তাকালে ৯ কিলোমিটারের সেতুতে নির্মাণ ব্যয় ১১ কোটি রুপি। অর্থাৎ ভারতে একটা পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় দিয়ে ৩০ টা ভূপেন হাজারিকা সেতু নির্মাণ সম্ভব। ভারতে ১০ কিলোমিটারের যে সেতু নির্মাণ হচ্ছে ছয় লেন বিশিষ্ট সে সেতুর খরচ হচ্ছে তি হাজার কোটি টাকা।

তিনি বলেন, একটা পদ্মা সেতুর ব্যয়ে ভারতে ১০ টা সেতু নির্মাণ সম্ভব। লুটপাট আর কাকে বলে।

রুমিন দাবি করেন, শুরুতে যখন পদ্মা সেতু পরিকল্পনা নেওয়া হয় তখন রেল পরিকল্পনায় ছিল না। কিন্তু পরে আওয়ামী লীগ রেল যুক্ত করে। দাম বেড়ে হয় ৩৯ হাজার২৪৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২১ হাজার ০৩৬ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে এক্সিম ব্যাংক অব চায়না, বাকিটা দেশের টাকা।

Advertisement

সরকার বহু টাকা নয় ছয় করে নষ্ট করার পরে পায়রাকে আর গভীর সমুদ্র বন্দর করেনি বলে উল্লেখ করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, পদ্মা সেতুর মতো এত বড় প্রকল্পের জন্য পক্ষে লাভজনক শর্তে ঋণ নিতে না পারা সরকারের একটা বড় ব্যর্থতা। আজ এ সংসদে আলোচনা হয়েছে- বিশ্বব্যাংক আবার ফিরে এসেছিল। তাহলে বিশ্বব্যাংকে আবার নেওয়া হয়নি কেন? বিশ্বব্যাংকের ঋণ নিলে জবাবদিহিতা থাকতে হয় এবং এ সরকার যে হরিলুট করেছে সেটা বিশ্বব্যাংকের ঋণ নিয়ে সম্ভব হত না।

বিশেষজ্ঞদের উদ্ধৃত করে রুমিন বলেন, পদ্মা সেতুর রেল লাভজনক নয়। এটা যে আয় হবে সে তুলনায় ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ঢাকা ভাঙ্গা মাওয়া পার হয়ে পদ্মা সেতুতে যেতে হবে সে মহাসড়কটি ৫৫ কিলোমিটার সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে। অর্থাৎ মহাসড়কটি ব্যয় দুইশ কোটি টাকার ওপরে প্রতি কিলোমিটারে। যেখানে ইউরোপ আরেমিকায় প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হয় ৩০-৩৫ কোটি টাকা।

তিনি বলেন, গর্বের জায়গা হলো নিজের টাকায় সেতু তৈরি হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে ঋণের টাকায় যদি সেতু তৈরি হয় সেটি বুঝি নিজের টাকায় নয়? ঋণ দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করাটাই স্বার্থের অনুকূল। দিনে দিনে দায় শোধ করা যায়, এর মধ্যে সেতু থেকেও আয় শুরু হয়। প্রকল্প শেষে অর্থনীতিতে অবদান রাখতে শুরু করার পর তার দায় শোধ করাটাই মঙ্গলজনক।

সংসদের পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে এ সংসদ সদস্য বলেন, কী বীভৎস অসহিষ্ণ সংসদ। এ পদ্মা সেতু নিয়ে টিকটক ভিডিও করার কারণে একজনকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় মামলা, গ্রেফতার ও রিমান্ডেও নেওয়া হয়। কথা কথায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা, গ্রেফতার, রিমান্ডে নেওয়ার আর কোনো বিষয় নয়। এখন আর এ সরকারকে খুব নিরাপত্তাও দিতে পারছে না উল্লেখ করে তিনি প্রস্তাব করেন, হলোকাস ডিনায়েল অ্যাক্টর মতো ডেভেলপমেন্ট ডিনালে অ্যাক্ট বা উন্নয়ন অস্বীকার আইন করা হোক।

তিনি আরও বলেন, যে আইনে সরকারের বয়ানের সঙ্গে যারা একমত না হবেন, লুটপাটের বিরুদ্ধে যারা বলবে, মানবাধিকারের কথা ও ভোটের অধিকারের কথা বলে, ন্যায় বিচারের কথা বলে তাদের ওই অ্যাক্টের আওতায় শাস্তি দিয়ে জেলেপুরে রাখা যাবে যতদিন খুশি ততদিন।

প্রধানমন্ত্রী চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন, কিন্তু অনেক প্রশ্ন আছে

বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ বলেন, পদ্মা সেতু একটি বিরাট অর্জন তাতে সন্দেহ নেই। প্রধানমন্ত্রী চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন। কিন্তু অনেক প্রশ্ন আছে, বিশ্ব ব্যাংক কেন অর্থায়ন করেনি, দফায় দফায় ব্যয় বেড়েছে। এসবের স্বচ্ছতা জবাবদিহি দরকার। বড় বড় প্রকল্পগুলো নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে।

রুমিনের বক্তব্যের সময় সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা হইচই করার ঘটনার কথা উল্লেখ করে হারুন বলেন, সংসদে আলোচনা হবে। সরকারি দলের সদস্য বক্তব্য খণ্ডন করতে পারেন। কিন্তু যেভাবে হইচই হয়েছে, স্পিকার প্রটেকশন দেননি।

হারুন বলেন, পদ্মা সেতুর ফলে দক্ষিণাঞ্চলে উন্নয়নের মাইলফলক হবে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু রেল সেতু, এক্সপ্রেসওয়ে, লক্ষ কোটি টাকার মেগা প্রকল্প নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে।

হারুন বলেন, শাসকের সামনে সত্য বলা সবচেয়ে বড় জিহাদ। তারা সেই জিহাদ করছেন, সত্য বলছেন। মিথ্যা বলছেন।

পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধে বিএনপির ভূমিকা নিয়ে সরকার পক্ষের বক্তব্যের পাল্টায় হারুন বলেন, বিশ্ব ব্যাংক কি বিএনপির কথায় টাকা দেয়? বিএনপি বিরোধী দল, ক্ষমতাও নেই, বিএনপি কীভাবে টাকা বন্ধ করে দেয়?

বিকালে স্পিকার শিরীন শারমিনের সভাপতিত্বে সংসদের অধিবেশন শুরু হয়। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দিতে আলোচনার প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন নূর ই আলম চৌধুরী।

এইচএস/আরএডি