মতামত

স্বপ্নের দেশে আগ্নেয়াস্ত্রের অভিশাপ

সহপাঠীর চেহারা দেখতে ভালো লাগছে না। ব্যস এইটুকু কারণেই গুলি ছুড়ে দেয় ৭ বছরের এক শিশু। অবুঝ শিশুর এমন কর্মকাণ্ডকে হালকাভাবে নেওয়ার হাজারো যুক্তি দেওয়া যায়। কিন্তু ১৮ বা তার বেশি বয়সীরা যখন নিজ স্কুলে বিনা কারণেই ব্রাসফায়ার করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের খুন করে, তখন এর সরল ব্যাখ্যা হয় না। যুক্তরাষ্ট্রে দিনে-দুপুরে সবার সামনে অহরহই ঘটে এমন লোমহর্ষক ঘটনা। বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যমে বিষয়গুলো গুরুত্ব পেলেও মার্কিনিদের কাছে বন্দুক হামলার ঘটনা অনেকটা ডাল-ভাতের ব্যাপার হয়ে গেছে।

Advertisement

স্বপ্নের আমেরিকায় দুঃস্বপ্নের নাম এখন অস্ত্র সহিংসতা। আগ্নেয়াস্ত্র রাখা মার্কিনিদের সাংবিধানিক অধিকার। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে এটি নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু এই অধিকারের অপপ্রয়োগে ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে স্বাভাবিক মৃত্যুর অধিকার। সড়ক, হাট-বাজার, স্কুল, উপাসনালয় কিংবা নিজ ঘর কোথাও আর নিরাপদ নন নাগরিকরা। যখন তখন যে কেউ বন্দুক নিয়ে গুলি ছুড়ছে। ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৬৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৫০ বছরে ১৫ লাখের বেশি মার্কিনি গুলিতে নিহত হয়েছেন। দেশটির স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে আড়াইশো বছরে সব যুদ্ধে নিহতদের সংখ্যা যোগ করা হলেও এর বেশি হবে না। গত পাঁচ বছরে বন্দুক হামলার সংখ্যা বেড়েছে ২৫ শতাংশ। আর ১০ বছরে ৪৩ ভাগ।

অস্ত্র দিয়ে হামলা প্রতি লাখে ১১ মার্কিনির মৃত্যু হয়। এই তালিকায় বিশ্বে ২০তম অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে উন্নত বিশ্বের তুলনায় বন্দুক হামলার নিহতের এই হার কয়েকগুণ বেশি। পিউ রিসার্চ বলছে, এই সহিংসতায় অস্ট্রেলিয়ায় প্রতি লাখে নিহত হন একজন। স্পেন ও জার্মানিতে একজনেরও কম। কানাডায় সোয়া দুই ও ফ্রান্সে পৌনে তিন।

অস্ত্র সহিংসতার তথ্য নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা-গান ভায়োলেন্স আর্কাইভের তথ্য মতে, বর্তমানে গড়ে প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্রে গুলিতে ৪৭ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। তবে এর অর্ধেকের বেশি মৃত্যু আবার আত্মহত্যায়। বিশ্বে আত্মহত্যার শীর্ষ তিন দেশ হলো ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। বন্দুক সহিংসতার বিরুদ্ধে সচেতনতার কাজ করা বেসরকারি সংগঠন স্যান্ডি হুক বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ১২ শিশুর মধ্য একজন বন্দুক হামলায় নিহত হয়।

Advertisement

গত ৫০ বছরে স্কুলে দুই হাজারের বেশি বন্দুক হামলা হয়েছে। যার অর্ধেকই হয়েছে গত ১০ বছরে। নিজ ঘরেই ভয়াবহ ঝুঁকিতে থাকে ৪৬ লাখ শিশু। এসব ঘরে সেফটি লক খোলা বা গুলিভর্তি পিস্তল-বন্দুক থাকে। বাবা-মা, অভিভাবকদের অর্ধেকই এই ভুল ধারণার মধ্যে থাকে যে, বন্দুক-পিস্তল কোথায় রাখা হয়েছে; সেটি জানে না তাদের সন্তানরা।

মার্কিন রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র-সিডিসির তথ্য বলছে, বছরে প্রতি পাঁচজনের একজন মার্কিনি দুশ্চিন্তাসহ নানান মানসিক সমস্যার শিকার হন। তবে ৬০ শতাংশই কোনো ধরনের চিকিৎসা নেন না। এছাড়া ৩২ কোটি মানুষের দেশটিতে অন্তত ১ শতাংশ লোক সিজেফ্রেনিয়ার মতো মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত। সংখ্যার হিসাবে যা হতে পারে ৩২ লাখ। মানসিক স্বাস্থ্যের এই করুণ অবস্থা শুধু বয়স্কই নয়, শিশুদের মধ্যেও রয়েছে।

এত এত তথ্য-সমীক্ষা একটি বিষয় স্পষ্ট করছে, যুক্তরাষ্ট্রে ভয়াবহভাবে বাড়ছে বন্দুক হামলার ঘটনা। কিন্তু এর কারণ কী? মোটা দাগে অন্তত তিনটি কারণ পাওয়া যায়। ১. বন্দুকের সংখ্যা ও শিথিল আইন।২. মানসিক সমস্যা।৩. বর্ণ বৈষম্য।

সুইডিশভিত্তিক গবেষণা প্রকল্প স্মল আর্মস সার্ভে বলছে, প্রতি একশো আমেরিকানের কাছে রয়েছে ১২০টি আগ্নেয়াস্ত্র। ৩২ কোটি মানুষের হাতে রয়েছে ৩৯ কোটি অস্ত্র। নাগরিকদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র থাকার এই তালিকায় বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রই শীর্ষে। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেনে প্রতি একশোজনে অস্ত্রের সংখ্যা ৫২ দশমিক ৮।

Advertisement

অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে তা অর্ধেকেরও কম। দেশটির বেশিরভাগ রাজ্যে প্রাপ্ত হলেই অনলাইনে অস্ত্র কিনতে পারেন যেকোনো নাগরিক। এছাড়া ২৫টি রাজ্যে লাইসেন্স ছাড়াই প্রকাশ্যে অস্ত্র সঙ্গে রাখার আইনি সুবিধা রয়েছে। বন্দুক সহিংসতার বিভিন্ন লোমহর্ষক ঘটনার পর বারবার অস্ত্র আইন শক্ত করার দাবি উঠলেও স্বার্থবাদীদের কারণে তা ধোপে টেকে না। যার মধ্যে অন্যতম বন্দুক রাখার অধিকার নিয়ে কাজ করা দেড়শো বছরের পুরোনো অ্যাডভোকেসি গ্রুপ-ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশন অব আমেরিকা বা এনআরএ। এর সদস্য সংখ্যা ৫০ লাখের বেশি।

বন্দুক আইন শিথিল রাখার ক্ষেত্রে আইনপ্রণেতা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সবার পেছনেই অর্থ খরচ করে এই সংস্থাটি। এই কাজে এনআরএ’র মতো সংগঠনগুলো যে পরিমাণ অর্থ খরচ করে; তা আগ্নেয়াস্ত্র সহিংসতা প্রতিরোধ ও শক্ত আইন তৈরির জন্য জনসচেতনতায় খরচের চেয়ে অনেক বেশি।

প্রথাগতভাবে নাগরিকদের একটি বড় অংশই আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণে শক্ত আইনবিরোধী। পিউ রিসার্চ বলছে, অর্ধেক মার্কিনি শক্ত আইনের পক্ষে থাকলেও বিপক্ষে দৃঢ় অবস্থানে রয়েছেন ৩৫ শতাংশ নাগরিক। এই হার গ্রামে অনেক বেশি। বিশেষ করে রিপাবলিকান দলের সমর্থক গ্রামের মানুষদের মধ্যে ৭১ শতাংশ মনে করেন, স্কুল-কলেজে শিক্ষকদের সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্র থাকা উচিত। শহরের রিপাবলিকানদের মধ্যে এমন মত ধারণ করেন ৫৬ শতাংশ।

যুক্তরাষ্ট্রজুড়েই বর্ণবৈষম্য এখনো প্রকট। শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদ ঘৃণিত হলেও ব্যাপকভাবে চর্চিত হচ্ছে। যার ধারকরা ‘রিপ্লেসমেন্ট থিওরি’ বা প্রতিস্থাপন তত্ত্বের মতো ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাসী। ট্রাম্প জমানায় শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীরা পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় মদত, যা এখন ফুলে ফেঁপে অতিকায় দানব আকৃতি নিয়েছে।

মূলত ২০ শতকে ফরাসি জাতিয়তাবাদী ধারণা থেকে এসেছে এই রিপ্লেসমেন্ট থিওরি। যাতে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীরা বিশ্বাস করেন, ধীরে ধীরে তাদের স্থান দখল করে নিচ্ছে অশ্বেতাঙ্গরা। এটি একটি পরিকল্পনামাফিক করা হচ্ছে। মিথ্যা এই ধারণার পালে হাওয়া লাগে ২০১১ সালে ফরাসি লেখক রেনু কামুর হাত ধরে।

যুক্তরাষ্ট্রে যা ঘরে ঘরে ছড়িয়েছেন ফক্স নিউজের উপস্থাপক টাকার কার্লসন। টক শোক টাকার কার্লসন টু নাইট নামে অনুষ্ঠানের ৪শ’ পর্ব নিয়ে গবেষণা করেছে মার্কিন গণমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমস। যাতে উঠে এসেছে, অভিবাসীদের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের জনমিতি পরিবর্তন করা হচ্ছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে শ্বেতাঙ্গদের। বিভিন্ন রাজ্যে দ্রুত কমছে তাদের হার।

বর্তমান বিশ্বে অস্ত্র সরবরাহকারী শীর্ষ পাঁচটি কোম্পানির সবকটিই যুক্তরাষ্ট্রের। বিভিন্ন দেশকে নিরাপত্তার নামে অস্ত্র বিক্রি; কখনওবা দুই দেশের ঝগড়ার ফায়দা নিয়ে অস্ত্রচুক্তি। এ সবেরই নেতৃত্ব দিচ্ছে তারা। এছাড়া বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের মুখোশ পরে ধ্বংস করেছে বহু দেশ। যাতে মরেছে লাখ লাখ মানুষ। পাপ বাপকেও ছাড়ে না। মানুষ মারার এই খেলা চলে এসেছে আজ নিজ অন্দরেই। প্রতিটি মার্কিনির মনেই অন্য মার্কিনিকে নিয়ে ভয়। কখন সে গুলি করে দেয়।

লেখক: নিউজ এডিটর, চ্যানেল 24।

এইচআর/ফারুক/জেআইএম