কিশোরগঞ্জের ছেলে সাইমন সাদিক। শৈশব-কৈশোর পুরোটাই কেটেছে সেখানে। নির্মাতা জাকির হোসেন রাজু পরিচালিত ‘জ্বি হুজুর’ চলচ্চিত্রের অভিনয়ের মাধ্যমে ঢাকাই চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় তার। এরপর একই নির্মাতার ‘পোড়া মন’ ছবিতে অভিনয় করে আলোচনায় আসেন। ধীরে ধীরে এই নায়ক হয়ে ওঠেন নির্মাতাদের আস্থার প্রতীক। এখনো পর্যন্ত তার অভিনীত ১০টি ছবি মুক্তি পেয়েছে এবং বর্তমানে ঝুলিতে আছে হাফ ডজনেরও বেশি ছবি। গেল বছরের মাঝামঝি সময়ে মুক্তিপ্রাপ্ত সাইমন অভিনীত সাফি উদ্দিন সাফি পরিচালিত ‘ব্ল্যাকমানি’ ছবিটি ছিল বছরের অন্যতম ব্যবসা সফল ছবি। এছাড়া আসছে ২৯ জানুয়ারি মুক্তি পেতে যাচ্ছে সাইমন অভিনীত ‘পুড়ে যায় মন’ ছবিটি। সমসাময়িক ব্যস্ততা, ক্যারিয়ার ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন হালের এই হার্টথ্রুব নায়ক- জাগো নিউজ : চলচ্চিত্রে আসার গল্পটা জানতে চাই...সাইমন : এটা ২০০৬ সালের কথা। তখন বারিধারায় আমার নিজস্ব ব্যবসা ছিল। একদিন জাকির হোসেন রাজু স্যারের সাথে আমার দেখা হলো। সেখানে আলাপ হলো অন্য বিষয় নিয়ে। হঠাৎ করেই তিনি আমাকে চলচ্চিত্রে কাজ করার জন্য অফার দেন। আমি আসলে হতম্ভব হয়ে গিয়েছিলাম। স্যারের পাগলামির বাতিক ভেবে বিষয়টা আমলে নেইনি। তাছাড়া আমাদের চলচ্চিত্রে সেসময় অশ্লীলতা ছিল, তাই আমারও আগ্রহ ছিলো না। পরে জানতে পারি জাকির হোসেন রাজু হলেন ‘জীবন সংসার’, ‘মিলন হবে কত দিনে’, ‘নিঃশ্বাসে তুমি বিশ্বাসে তুমি’ এমন সব নন্দিত ছবির নির্মাতা। আর এই ছবির নামগুলোর সাথে আমি পরিচিত ছিলাম। তবুও নিজেকে চলচ্চিত্রে নিয়ে আসার সাহস পাচ্ছিলাম না। কিন্তু ততদিনে রাজু স্যারের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা বেশ ভালো। একদিন তিনি আমাকে ফটোসেশনের জন্য টাকাও দিলেন। তারপর রাজু স্যার শুটিং দেখার জন্য আমোকে যেকে নিয়ে যেতেন। তখনই আসলে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের প্রতি আগ্রহটা জন্মায়। আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম শুটিং দেখে। সেখানের সবকিছুই আমাকে নাড়া দিয়েছিলো। সবচেয়ে বড় কথা আমিও ভেবেছিলাম যে নায়ক হবো। এদিকে আমার ব্যবসা কিছুটা ঢিলে হয়ে পড়ায় লোকসানের মুখে পড়তে হয়। তাই ভাবলাম রাজু স্যারের হাত ধরেই নতুন যাত্রা হোক। আমি উনাকে অভিনয়ে আগ্রহের কথা জানালাম। তারপর আনন্দমেলার শিকদার স্যারের প্রযোজনায় এবং রাজু স্যারের পরিচালনায় আমার কাজ শুরু করি ‘জ্বি হুজুর’ ছবিতে। বাকি গল্প সবারই জানা।জাগো নিউজ : নায়ক না হলে কী তবে সাইমন ব্যবসায়ীই হতো?সাইমন : সেটা বলা মুশকিল। আমার রাজনীতিতেও ঝুঁক ছিলো। পরিবারেও ছোটবেলা থেকেই রাজনীতি দেখেছি। হয়তো নেতাও বনে যতে পারতাম। হা হা হা...... তবে এ কথা সত্যি যে, আমি কোনোদিন ভাবিনি ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবো। এমন কিছুই হতে চেয়েছি যাতে মানুষের কাছে থাকা যায়। সে জায়গা থেকে বলা চলে আমি কিছুটা হলেও সফল। মানুষের কাছাকাছি পৌঁছাতে পেরেছি বলেই হয়তো আমি আজকের সাইমন।জাগো নিউজ : অনেকগুলো ছবিইতো মুক্তি পেয়েছে আপনার। তার বিচারে নিজেকে কীভাবে বিশ্লেষণ করেন?সাইমন : আমার তো সবে যাত্রা শুরু। আরো পাঁচ বছর যাক। তখনই না হয় হিসেবে নিকেশ করা যাবে। আপাতত নিজের কাজ ও ক্যারিয়ারটাকে উপভোগ করছি। তবে গন্তব্য বলতে পারি- বহুদূর। নিজেকে আপাদমস্তক একজন স্বপ্নের মানুষে পরিণত করতে চাই। সে লক্ষেই পরিশ্রম করছি। জাগো নিউজ : ‘জ্বি হুজুর’ থেকে মুক্তির অপেক্ষায় থাকা ‘পুড়ে যায় মন’- পার্থক্যটা কেমন অনুভব করছেন?সাইমন : পার্থক্য যতোটা অনুভব করেছি তাতে বলবো আগে একেবারেই ব্র্যান্ডনিউ ছিলাম কিন্তু এখন আমি পুরোপুরি চলচ্চিত্রের মানুষ। অনেক কিছুই শিখেছি, অনেক ভালো ভালো পরিচালক অভিনেতা অভিনেত্রীদের সাথে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। পোড়া মন, ব্ল্যাক মানির মতো ব্লকবাস্টার সুপারহিট ছবি রয়েছে আমার। এসব কিছুই আমার কাছে অনেক বড় কিছু মনে হয়। জাগো নিউজ : এখনো পর্যন্ত আপনার ১০টি ছবি মুক্তি পেয়েছে। এরমধ্যে কোন ধরণের চরিত্রে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন?সাইমন : সব ছবির সব ছবির চরিত্রে কাজ করেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছি। আমি কোনো নির্দিষ্ট ঘরানায় বন্দি হতে চাই না। একজন অভিনেতা বা নায়ক হিসেবে নিজেকে বৈচিত্রময় চরিত্রেই হাজির করতে চাই। আর তাই প্রতিটা চরিত্রই আমার কাছে চ্যালেঞ্জিং। আমি চেষ্টা করি চরিত্রগুলো নিজের মধ্যে ধারণ করতে। সেজন্যই একটা কথা বিনয়ের সাথেই বলতে চাই- এখন পর্যন্ত কেউ বলতে পারেনি যে এই ছেলেটি অভিনয়ে একেবারেই নতুন। জাগো নিউজ : ‘পুড়ে যায় মন’ ছবিতে আপনি পরীমনির সঙ্গে জুটি বেঁধেছেন। কিন্তু আপনাদের জুটিবদ্ধ হওয়া প্রথম ছবি ‘রানা প্লাজা’ নানা কারণে আটকে গেছে। ছবিটি মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এই বিষয়টি নতুন ছবিতে কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন?সাইমন : আমার মনে হয় না। দুটি ছবির গল্প আলাদা, প্রেক্ষাপট আলাদা, নির্মাণ আলাদা। বরং আমার মনে হয় পরী ও আমার জুটির প্রথম ছবিটি মুক্তি পায়নি বলে দ্বিতীয় ছবিটি নিয়ে দর্শকদের মধ্যে আরো বেশি আগ্রহ তৈরি হয়েছে। তাছাড়া, আমাদের কাজ করার হিসেবে এটি দ্বিতীয় হলেও পর্দায় কিন্তু আমাদের জুটির অভিষেক হচ্ছে ‘পুড়ে যায় মন দিয়ে’ই। আমি আশাবাদী ছবিটি দেখে সবার ভালো লাগবে। নির্মাতাদ্বয় অপূর্ব-রানা এবং আমরা এই ছবির পুরো টিম চেষ্টা করেছি মন্দার এই বাজারে মৌলিক গল্পে পরিচ্ছন্ন এবং বিনোদনমূলক একটি ছবি করার। জাগো নিউজ : বর্তমান ব্যস্ততা নিয়ে জানতে চাই...সাইমন : এ মুহূর্তে আটটি ছবি আছে আমার হাতে। তাছাড়া আগামী ২৯ তারিখ পুড়ে যায় মন মুক্তি পাচ্ছে সারাদেশে। এছাড়াও বর্তমানে যেসব ছবিতে কাজ করছি সেগুলোর মধ্যে পি এ কাজলের ‘চোখের দেখা’, শওকত ইসলামের ‘নদীর বুকে চাঁদ’, শাহীন সুমনের ‘প্রবাসী ডন’, ‘আঙটি’, আরিফুর জামান আরিফের ‘দুম ধাড়াক্কা’ উল্লেখযোগ্য।জাগো নিউজ : একটু ভারী বিষয় নিয়ে কথা বলি। একজন অভিনেতা হিসেবে আপনার চোখে বর্তমান সময়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রতিবন্ধকতাগুলো কী?সাইমন : প্রতিবন্ধকতা আছে অনেক। তবে আমাকে যদি প্রধান তিনটি কারণ বলতে বলা হয় তবে আমি আগে বলবো বিশ্বমানের কিংবা বর্হিবিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে ছবি করার মত উপকরণ এবং বাজেট আমাদের নেই। তাছাড়া আমাদের দর্শকদের কথা চিন্তা না করে তাদের রুচির কিংবা তারা কি চাচ্ছেন সেটা বিবেচনা না করে আমাদের নির্মাতা প্রযোজকরা তাদের ইচ্ছামত ছবি নির্মাণ করছেন। সেদিক থেকে দর্শকরা হলে গেলে তাদের পছন্দসই গল্পের ছবি না পেয়ে হতাশ হচ্ছেন। যার প্রেক্ষিতে বাংলা ছবির প্রতি আগ্রহটা হারাচ্ছে। তাছাড়া আমাদের দেশের প্রেক্ষাগৃহগুলো দিনদিন কমে যাচ্ছে যেটা খুবই দুঃখজনক ব্যাপার। আর যেসব প্রক্ষাগৃহ তারমধ্যে নব্বই ভাগের পরিবেশই ভালো নয়। ছারপোকা, মশা, নারিকেলের ছোবড়ার ছেঁড়া চেয়ার, দুর্গন্ধ- সবমিলিয়ে একেবারে জরাজীর্ণ অবস্থা। এসব বিষয়ের দিকে মনযোগ দিয়ে এগুতে হবে আমাদের।জাগো নিউজ : নতুন অনেকেই আসছেন কিন্তু আওয়াজ দিয়েই হারিয়ে যাচ্ছেন। এর কারণ কী?সাইমন : আমার মনে হয় সঠিক দিক নির্দেশনা ও সঠিক সাপোর্ট না পাওয়াতেই নতুনরা অকালে ঝড়ে যায়। এখানে গাইডলাইনটা খুব বেশি প্রয়োজন। আর প্রতিযোগীতায় টিকে থাকার মতো যোগ্যতা, মেধাও থাকা চাই। সুন্দর আর স্মার্ট হলেই কিন্তু নায়ক বা নায়িকা হওয়া যায় না। জাগো নিউজ : আপনার দৃষ্টিতে সঠিক সাপোর্ট বিষয়টি কেমন?সাইমন : এটা হতে পারে কোনো বড় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান কিংবা গুণী কোনো নির্মাতার ছবিতে কাজ করা। নতুনদের জন্য ঝুকিঁ নিতে হবে। তাদের নিয়ে এক্সপেরেমেন্ট চালাতে হবে। আমাদের এখানে একটি ছবি দেখেই বলে দেয়া হচ্ছে অমুক ছেলে বা মেয়েটিকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। এটা হাস্যকর। একজন শিল্পীকে এত সহজেই চিনা যায় না। তাকে সুযোগ দিতে হবে। কিন্তু আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে এটা বিরল। নিজেকে দিয়েই বলি। আমার প্রথম ছবি ‘জ্বি হুজুর’ ছিল ব্যবসায়িকভাবে ফ্লপ। তারপর নিজের মধ্যে অনেকটাই হতাশার ভূত ভর করে। ঠিক যখন দিশেহারা হয়ে যাচ্ছিলাম তখন জাজ থেকে আমাকে দিয়ে ‘পোড়া মন’ ছবিতে কাজ করানো হয়। ওটা ছিল সুপারহিট ছবি। আমি অকপটে সবসময় বলে থাকি পোড়া মন আমার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট। আমাকে জাজ সাপোর্ট দিয়েছিলো আমার খারাপ সময়ে। অনেকেই এটা পায় না। তবে আমি এটুকু প্রমাণ করেছিলাম যে সাপোর্ট বা সুযোগ পেলে আমি ভাল করবই। যে কোনো নবাগতের মধ্যে এই আত্মবিশ্বাসটাও থাকা চাই।জাগো নিউজ : একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলি। আপনার এলাকার একজন জনপ্রিয় অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন। তার সঙ্গে আপনার সম্পর্কটা কেমন?সাইমন : এখন পর্যন্ত তার সাথে আমার তিন-চার বার দেখা হয়েছে। প্রতিবারই তিনি আমার সাথে ভালোভাবে কথা বলেছেন আমার খোঁজখবর নিয়েছেন। তাছাড়া উনি এখন আর নিয়মিত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন না। যদি করতেন তবে হয়তো আমার কোনো প্রযোজন হলে তিনি আমার হেল্প করতে পারতেন। জাগো নিউজ: আপনার পরিবার সম্পর্কে জানতে চাই...সাইমন : একান্নবর্তী পরিবারে আমার জন্ম এবং বেড়ে উঠা। বাবা সাদিকুল ইসলাম সাদিক। তিনি আমাদের এলাকার পরপর নির্বাচিত তিন বারের ইউপি চেয়ারম্যান। বাবা ও আট চাচার সাথে একত্রে বসবাস করি। মা, বড় তিন বোন পপি, পলি, দীপু এবং ছোট এক ভাই সাফায়েতকে নিয়ে আমার স্বপ্নের জগত।এনই/এলএ
Advertisement