চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের দৃশ্য দেখে দেশের মানুষ হতবাক। এই দুর্ঘটনার খবর শুরুতে সামান্য মনে করা হলেও সেদিন রাত গড়িয়ে পরদিন আবার রাত পার হয়ে তার পরদিনের সকাল পর্যন্ত নিহত ও আহতদের বীভৎস দৃশ্য এবং মর্মন্তুদ আহাজারি সবার বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছে। হাইড্রোজেন পার অক্সাইড নামক কেমিক্যালভর্তি কনটেইনারের বিকট শব্দের বিস্ফোরণে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে ডিপো। এর ২৬ একর এলাকা এখন মৃত্যুপুরী।
Advertisement
আগুন নেভানোর জন্য দমকল কর্মীদের প্রাণান্তকর চেষ্টার পর আত্মাহুতির খবর আমাদের অন্তরাত্মাকে কাঁপিয়ে তুলছে। অগ্নিনির্বাপকদের পোশাকের পোড়া অংশ সেখানে পড়ে আছে। এই দৃশ্য কি চোখে দেখে সহ্য করা যায়? তবে দুদিন পরও এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত সম্পর্কে কোনো সঠিক তথ্য জানা যায়নি।
বিস্ফোরণে ৮০০ মিটার লম্বা টিনের ডিপোটি উড়ে গেছে। সংলগ্ন অফিসের ধ্বংসস্তূপ ছাড়া কিছু অবশিষ্ট নেই। গভীর রাতের নির্জনতা ভেঙে বিস্ফোরণ ও আগুনের লেলিহান শিখা দেখে বহুদূরে অবস্থানরত মানুষও হতবিহ্বল হয়ে পড়েছেন। এ পর্যন্ত নয়জন দমকলকর্মী, পুলিশসহ ৪৯ জন নিহত হওয়ার খবর জানা গেছে। আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪৫০ জন। চারজন দমকল কর্মীসহ ২০ জন তখনো নিখোঁজ।
শত শত মানুষের কান্নার নোনাজলে ভারী হয়ে উঠেছে সেখানকার আকাশ-বাতাস ও হাসপাতালের করিডোর। দমকলের ২৫টি ইউনিট, ২৪ পদাতিক ডিশিনের ২৫০ সৈন্য, পুলিশ, রোভার স্কাউট, স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীরা দিনরাত পরিশ্রম করে নিহতদের মরদেহ উদ্ধার এবং আহতদের সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। হাসপাতালের চিকিৎসকরা আপ্রাণ চেষ্ট করছেন আহতদের বাঁচাতে। কিন্তু প্রায় দুদিন পরও এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের উৎস সম্পর্কে কোনো সঠিক তথ্য জানাতে পারেনি কোনো কর্তৃপক্ষ। সেদিন ডিপোর মালিক, পরিচালক কাউকে অকুস্থলে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
Advertisement
বিশেষ করে অগ্নিকাণ্ডের খবর পাওয়ার পর দমকলকর্মীরা আগুন নেভাতে ছুটে গেলে কোনো তথ্য জানতে না পেরে দাহ্য পদার্থের কেমিক্যালভর্তি কনটেইনারে পানি ছিটানোর সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো বিস্ফোরিত হতে থাকে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। হাইড্রোজেন পার অক্সাইডভর্তি জ্বলন্ত কনটেইনারে ঠান্ডা পানি লাগার সাথে সাথে সেগুলো বিস্ফোরিত হতে থাকে এবং দমকলকর্মী, সাংবাদিক ও উদ্ধারকাজে নিয়োজত স্থানীয়দের ওপর ছিটকে পড়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। তারা পোশাকের আগুনে ঝলসে মাটিতে গড়াগড়ি দিতে থাকার সময় মুহুর্মুহ অনেকগুলো বিস্ফোরণ ঘটতে থাকে এবং সাজিয়ে রাখা শত শত কনটেইনারে নতুন করে আগুন লাগতে থাকে। এই কারণে ২৪ ঘণ্টা পরও নতুন করে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে।
এছাড়া কেমিক্যাল হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ছাড়ার আরও ভিন্ন দাহ্য পদার্থ থাকতে পারে। এদের একেকটির প্রকৃতি আলাদা। তাই এদের আগুন নেভানোর কৌশলও আলাদা। হাটহাজারীর কারখানায় উৎপাদিত হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রপ্তানির জন্য এই ডিপোতে জমা রাখা হয়। সেগুলোতে সতর্কতা ও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না।
এছাড়া দাহ্য পদার্থ উৎপাদন, মজুত, পরিবহন, রপ্তানি ও বিপণনের জন্য আইন হয়তো ঠিকমতো মেনে চলা হয়নি। এজন্য চারটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। তারা কাজ শুরু করেছেন। সবাই দ্রুত কাজ করছেন। তদন্ত রিপোর্ট বের হলে আসল তথ্য জানা যাবে বলে ঊধ্বর্তন এক কর্মকর্তা টিভিতে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন।
দমকলকর্মীরা বলেছেন, তারা কনটেইনারে কেমিক্যাল থাকার তথ্য জানতো না। ফলে ফোম ব্যবহার না করে পানি দিতে গিয়ে ভয়াবহ বিস্ফোরণ শুরু হয় ও হতাহত বাড়তে থাকে। এটা সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্যজনক বিষয়। সময়মতো সঠিক তথ্য পেলে এ বিপর্যয় এড়ানো যেত।
Advertisement
এসব তথ্য না থাকার পরিপ্রেক্ষিতে সেখানকার শ্রমিক, ড্রাইভার, ফায়ারকর্মী, পুলিশ, দর্শনার্থী জনতা সবাই আক্রান্ত হয়ে পড়েন। হাসপাতালের চিত্র খুবই ভয়াবহ। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আর সেবা দেওয়ার উপায় নেই। আহতদের বিভিন্ন ক্লিনিক ও সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে ঢাকায় ভালো চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে। এরপরও আহতদের যথেষ্ট সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কারণ, সব হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডে আহত রোগীদের সেবার ব্যবস্থা নেই।
অনেকের দেহ আগুনে পুড়ে বিকৃত হয়েছে। অনেককে চেনার উপায় নেই। তাদের আত্মীয়-স্বজনরা হন্যে হয়ে খুঁজছেন অনেককে। সময় যত গড়াচ্ছে লাশের সারি ততই দীর্ঘ হচ্ছে। তাদের নিকটজনদের আর্তনাদ ততই পরিবেশকে করে তুলছে ভারী। এসব কথা লিখে বোঝানো যাবে না।
মূল কথা হলো- আমাদের দেশে আর্থ-সামাজিক কর্মকাণ্ড ব্যপ্তির সাথ সাথে শিল্প দুর্ঘটনার সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। মনে রাখতে হবে দুর্ঘটনা হতেই পারে। এটা হঠাৎ যে কোনো সময় ঘটতেই পারে। তবে এসব দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য যথেষ্ট সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। এজন্য ১৯৬৫ সালের কারখানা আইনে নির্দিষ্ট বিধিবিধান দেওয়া রয়েছে। শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য ১৯২৩ সালের শ্রমিক ক্ষতিপূরণ আইন রয়েছে।
এসব আইন আমাদের দেশের উপযোগী করে সংশোধন ও পরিমার্জন করে পণ্য মানুষের নিরাপত্তাদানের বিষয়গুলো আরও সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছে। এসব নিরাপত্তা আইন ঠিকমতো মেনে না চলার জন্য ১৯১৭ সালে কয়েকটি কারখানাকে জরিমানা করা হয়েছিল বলে জানা গেছে।
সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোর ঘটনা অতি ভয়াবহ, লোকসানমূলক ও মর্মন্তুদ। যার কথা বলতে গেলে আমাদের কষ্ট আরও বেড়ে যেতে পারে। জাতি গত ৫০ বছরের ইতিহাসে এত বড় কনটেইনার ডিপো দুর্ঘটনা দেখেনি। এমনকি কল্পনাও করেনি।
এত বড় দুর্ঘটনায় এত বেশি ক্ষয়ক্ষতি দেখে আপাতদৃষ্টিতে দাহ্য পদার্থের মজুত ও পরিবহন নিয়ে ম্যানেজমেন্টের দুর্বলতা আঁচ করা যায়। ডিপো কর্তৃপক্ষ সঠিক নিরাপত্তা দিতে পারেনি বলে মনে হয়। এর পেছনে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র রয়েছে কি না এজন্য আমাদের সংসদে চলতি অধিবেশনে ইতোমধ্যে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। কোন পর্যায়ে কারও কোথাও অবহেলা ও গাফিলাতি রয়েছে কি না সেজন্য পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করে দোষীদের চিহ্নিত করতে হবে। এসব জীবনসংহারী রপ্তানিযোগ্য পদার্থের ব্যবসার নামে স্পর্শকাতর জায়গায় বিশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা তথ্যের দুর্বলতা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
যে কোনো অগ্নিকাণ্ডে মানুষ নিঃস্ব ও অসহায় হয়ে যায়। চোর চুরি করলে বা বাড়িতে ডাকাত পড়লে সবকিছু নিতে পারে না। কিন্তু ঘন ঘন মারাত্মক অগ্নিকাণ্ড ও ক্রমাগত নদীভাঙন আমাদের পথে বসিয়ে দেয় প্রতি বছর। বিশেষ করে বিএম ডিপোতে অর্ধশত মানুষ ও নয়জন দমকলকর্মী হারানোর বেদনা ও ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া অতি সহজ ব্যাপার নয়। তাদের সবার পরিবারকে যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা উচিত।
চিকিৎসার ব্যবস্থাও করতে হবে বিনামূল্যে। কারণ অঙ্গ হারানোদের জন্য ডিপো কর্তৃপক্ষের ঘোষিত চার বা ছয় লাখ টাকা দিয়ে শুধু চিকিৎসার খরচই বহন করা অসম্ভব। এসব বড় দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের আরও বেশি সতর্ক হতে হবে এবং আরও বেশি আধুনিক অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা তৈরি করে কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও নিরাপত্তামূলক সরঞ্জাম কিনে প্রটেকশনের শক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন। fakrul@ru.ac.bd
এইচআর/ফারুক/জেআইএম