সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে‘ বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ প্রতি বছর ৫ জুন সারা বিশ্বে পালিত হয়। ইউনাইটেড নেশনস এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম (UNEP) এর নেতৃত্বে ১৯৭৩ সাল থেকে প্রতি বছর এই দিবসটি অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। দিবসটি পরিবেশ নিয়ে প্রচারের জন্য বৃহত্তম বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে।
Advertisement
বিশ্ব পরিবেশ দিবস ২০২২ এর আয়োজক দেশ সুইডেন। দিবসটির এবারের প্রচারাভিযানের স্লোগান “Only one Earth” বা "একটিই মাত্র পৃথিবী" যার ফোকাস “Living Sustainably in Harmony with Nature”. বা "প্রকৃতির সাথে সাদৃশ্যে টেকসই জীবনযাপন"। ইউএনইপি বলছে, মহাবিশ্বে রয়েছে কোটি কোটি ছায়াপথ, আর ছায়াপথে রয়েছে কোটি কোটি গ্রহ কিন্তু পৃথিবী আছে মাত্র একটিই। আর এই পৃথিবী ও তার পরিবেশের সংরক্ষণ বা যত্নের দায়িত্ব আমাদেরই।
আজ থেকে ৫০ বছর আগে একই স্লোগান অর্থাৎ “Only one Earth” বা "একটিই মাত্র পৃথিবী" নিয়ে প্রথম বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হয়েছিল। পাঁচ দশক পরে, এটি এখনও সত্য কারণ পৃথিবী এখনও আমাদের একমাত্র বাসযোগ্য স্থান এবং মানবজাতিকে অবশ্যই এর সীমাবদ্ধ সম্পদগুলিকে রক্ষা করতে হবে। বিশ্ব পরিবেশ দিবস ২০২২ এর বিশ্বব্যাপী প্রচারাভিযান থিম #OnlyOneEarth ব্যবহার করে প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে পরিচ্ছন্ন, সবুজ এবং টেকসই জীবনযাপন করতে নীতি এবং পছন্দগুলিতে রূপান্তরমূলক পরিবর্তনের আহ্বান জাানাচ্ছে।
জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি-জেনারেল এবং ইউএন এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রামের নির্বাহী পরিচালক ইনগার অ্যান্ডারসেন বিশ্ব পরিবেশ দিবস ২০২২-এর একটি বার্তায় বলেছেন "বিশ্ব পরিবেশ দিবসের ধারণাটি ৫০ বছর আগে ১৯৭২ সালে স্টকহোমে জাতিসংঘের মানব পরিবেশের সম্মেলনে জন্ম হয়েছিল। এটি এই উপলব্ধি থেকে জন্মগ্রহণ করেছিল যে আমাদের বায়ু, স্থল এবং পানি রক্ষার জন্য এক হয়ে দাঁড়াতে হবে, যার উপর নির্ভর করে আমরা সবাই বেঁচে আছি," ।
Advertisement
“বিশ্ব পরিবেশ দিবস ” টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাগুলোর পরিবেশগত মাত্রার অগ্রগতি প্রচারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে। ইউএনইপির নেতৃত্বে, ১৫০ টিরও বেশি দেশ প্রতি বছর বিভিন্ন ইভেন্টে অংশগ্রহণ করে। বিশ্বজুড়ে বড় বড় কর্পোরেশন, বেসরকারি সংস্থা, সম্প্রদায়, সরকার এবং সেলিব্রিটিরা পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে একই ব্যানারে একত্রিত হয়”।
প্রতি বছর এককটি দেশ বিশ্ব পরিবেশ দিবস আয়োজন ও উদযাপন করে। এ বছর আয়োজক দেশ সুইডেন। ইউএনইপি এবং অংশীদারদের সহায়তায় এই বছর একটি উচ্চ-পর্যায়ের আন্তর্জাতিক বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছিল গত ২ ও ৩ রা জুন। সভার নাম দেওয়া হয়েছিল "স্টকহোম+৫০: সকলের সমৃদ্ধির জন্য একটি সুস্থ গ্রহ - আমাদের দায়িত্ব, আমাদের সুযোগ"। বিভিন্ন ইভেন্ট আয়োজনের মাধ্যমে সবচেয়ে জরুরি পরিবেশগত সমস্যাগুলি সেখানে হাইলাইট করা হয়।
"১৯৭২ সালে শুরু হওয়া এই আন্দোলনটি আজ একটি অতি প্রয়োজনীয় অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। অবস্থা এমন যে হয় এখনই বা কখনই নয়। কারণ আমরা একই মানব প্রজাতি এবং আমাদের একটাই মাত্র পৃথিবী আছে। আমাদের একটিই বাড়ি আছে এবং সেইজন্যই এর সুরক্ষা অতি জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে," অ্যান্ডারসেন তার বার্তায় এভা্বেই উল্লেখ করেছেন।
পরিবেশের সুরক্ষা ও টেকসইতা নিয়ে নিঃসন্দেহে আজ আমরা বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির মুখোমুখি। জীবনের মূল প্রয়োজনীয়তাগুলি সবই মাতৃসম প্রকৃতি থেকে আমরা পূরণ করি এবং দুর্ভাগ্যবশত, এটিকিই এখন আমরা বিপদজ্জনক করে তুলেছি। গত বছর জলবায়ু সম্মেলনে জাতিসংঘ মহাসচিব মি. অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেছিলেন, ‘আমরাই নিজেদের কবর খুঁড়ছি এবং প্রকৃতিকে একটা টয়লেট হিসেবে ব্যবহার করছি।’ কাজেই প্রকৃতিকে টয়লেট হিসেবে ব্যবহার থেকে বিরত থাকা ও এই গ্রহটিকে বাঁচিয়ে রাখা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য করা সবারই জন্য একান্ত বাধ্যবাধকতা হয়ে দেখা দিয়েছে।
Advertisement
এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, প্রতি বছর পৃথিবী থেকে আহরিত সম্পদের পরিমাণ ৯০ বিলিয়ন টন। পৃথিবীর জনসংখ্যার পরিমাণ ৭.৮ বিলিয়ন । বিশ্বের ভোক্তার সংখ্যা ৪.১ বিলিয়ন । ২০৩০ সালের মধ্যে প্রত্যাশিত ভোক্তার সংখ্যা হবে ৫.৬ বিলিয়ন । বিশ্বের মোট সম্পদের অতিরিক্ত ৭০ শতাংশ বর্তমানে অতিরিক্ত ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রতি বছর ডাম্প করা বর্জ্যের পরিমাণ ২.১২ বিলিয়ন টন। প্রতি বছর উত্পাদিত ই-বর্জ্যের পরিমাণ ৫০ মিলিয়ন টন । বিশ্বব্যাপী উৎপাদিত রাসায়নিক সিন্থেটিক পণ্যের বাজার মূল্য ৭.৮ ট্রিলিয়ন ডলার। ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের সব জনসংখ্যার জন্য খাদ্য যোগানো কঠিন হয়ে যাবে। ২০৭০ সাল নাগাদ প্রবাল প্রাচীরগুলি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশংকা করা হচ্ছে।
প্রকৃতির ওপর অতিরিক্ত অত্যাচারের ফলে আমরা ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করছি। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত জাতিসংঘের আন্তঃসরকার প্যানেল (আইপিসিসি) তাদের সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলেছে, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এখনই কমানো না গেলে খুব শিগগিরই বিশ্ববাসীকে গুরুতর পরিণতি ভোগ করতে হবে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে—অবিলম্বে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিলে বিশ্বে খরা, বন্যা ও তাপপ্রবাহের মতো বিপর্যয় বাড়তেই থাকবে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন অত্যন্ত অনুভূত হচ্ছে। মানুষ এবং প্রকৃতিকে ২০ বছর আগের তুলনায় আরও চরম আবহাওয়া মোকাবিলা করতে হচ্ছে। তাপমাত্রার পরিবর্তন বা ভারী বৃষ্টিপাতের মতো ঘটনাগুলো প্রায়শই ঘটছে। পশুপাখি, কৃষি ও মানুষের মধ্যে ক্রমশ প্রাণঘাতী রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। জাতিসংঘ বলছে যে এই ধরনের প্রবণতা রোধ করতে একটি সুস্থ বাস্তুতন্ত্র এবং সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য নিশ্চিত করতে হবে। এটা সম্ভব হলে জনগণের কল্যাণ ও জীবনযাত্রার পথ টিকবে।
বাংলাদেশ ১৭০ মিলিয়ন জনসংখ্যার দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব যেমন, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা, জলোচ্ছ্বাস, সাইক্লোন, ভূমিকম্প, নদী ভাঙন, এবং জলাবদ্ধতা, মাটির লবণাক্ততা ইত্যাদির কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। দক্ষিণ এশিয়ায় অবস্থিত দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ। এই জলবায়ু পরিবর্তন দেশের কৃষি, অবকাঠামো এবং জীবনযাত্রার উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। ইতোমধ্যেই আমরা সিলেট ও সুনামগঞ্জ অঞ্চলে অকাল বন্যা হতে দেখেছি। যাতে হাওড় অঞ্চলের ফসল বিশেষ করে ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অস্বাভাবিক তাপমাত্রার কারণে এ বছর কলেরার প্রার্দুভাব দেখা দিয়েছে। ডেঙ্গুসহ অন্যান্য সংক্রামক রোগও বেড়েছে।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেও বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশ একটি সমতল ও নিচু ভূমি এলাকা নিয়ে গঠিত। জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের নাগরিক এবং সরকারের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠছে। দেশের ৮০ শতাংশেরও বেশি জমি বন্যা প্রবণ। বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কৃষিকাজে নিয়োজিত, তাই জলবায়ু পরিবর্তন এই কৃষকদের খারাপভাবে প্রভাবিত করবে।
বিশ্বব্যাংক সতর্ক করেছে বাংলাদেশ ২১০০ সালের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হবে। প্রতিবেদনে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৩ ফুট বাড়বে বলে অনুমান করা হয়েছে। এতে দেশে ব্যাপক বন্যা হবে এবং ফসলহানি ঘটবে। এতে দারিদ্র্য ও মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদযাপন অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। পরিবেশ নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে “বিশ্ব পরিবেশ দিবস” পালন নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করি। কারণ এই দিনটি আমাদেরকে প্রকৃতির সাথে পুনরায় সংযোগ স্থাপন করার কথা মনে করিয়ে দেয়। কখনও কখনও আমরা ভুলে যাই যে প্রাকৃতিক ব্যবস্থা আমাদের জীবন যাত্রার কল্যাণে কিভাবে ভূমিকা রাখে। যেহেতু আমরা প্রকৃতির অংশ, এবং আমরা এটির উপর নির্ভরশীল এটিকে রক্ষায় সচেতনতা বৃদ্ধিতে এই দিবসটি উদযাপন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি আমাদের মাঝে সচেতনতা যেমন বাড়ায় তেমনি এটির রক্ষায় আমাদেরকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করে। আমাদের একটাই পৃথিবী কাজেই এই সুন্দর পৃথিবীটিকে রক্ষার দায়িত্ব আমাদেরকেই নিতে হবে।
লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।
এইচআর/জেআইএম