দেশজুড়ে

নড়াইলে পালিত হচ্ছে মোসলেম উদ্দীনের ১১২তম জন্মবার্ষিকী

মোসলেম স্মৃতি পর্ষদ এর উদ্যোগে নড়াইলে নানা আয়োজনে পালিত হচ্ছে জারি সম্রাট মোসলেম উদ্দীনের ১১২তম জন্মবার্ষিকী। এ উপলক্ষে নড়াইল জেলা শিল্পকলা একাডেমি চত্বরে শুরু হয়েছে দিনব্যাপি মোসলেম মেলা। মোসলেম স্মৃতি পর্ষদ এর সভাপতি প্রফেসর রবিউল ইসলাম জানান, জন্মজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে দিনব্যাপি নানা কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সকাল সাড়ে ৯টায়  শিল্পকলা একাডেমি থেকে শোভাযাত্রা, কবির প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ, দোয়া অনুষ্ঠান, মোসলেম গীতি ও লোকগীতি প্রতিযোগিতা, আলোচনা সভা, সঙ্গীতানুষ্ঠান এবং জারি গানের আসর।মোসলেম উদ্দীন ইংরেজি ১৯০৪ সালের ২৪ এপ্রিল সদর উপজেলার সিংগাশোলপুর ইউনিয়নের তারাপুর গ্রামে কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম মৃত আব্দুল অহেদ এবং মায়ের নাম মৃত মুসলিমা বেগম। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়ায় তিনি যথাসময়ে বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাননি। স্থানীয় সিংগাশোলপুরের জমিদার কালিপ্রসন্ন রায় চৌধুরির বাড়িতে বাবার সঙ্গে শ্রমিকের কাজ করতেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে জমিদারদের টোল ঘরে পণ্ডিত বিনয় ভূষণ চক্রবর্তী ছাত্রদের পড়ানোর সময় মোসলেম ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে মনোযোগ সহকারে সেগুলো শুনতেন। একদিন পণ্ডিত মহাশয়ের দৃষ্টি গোচর হয় এবং মোসলেমকে কাছে ডেকে জানতে চান দাঁড়িযেয়ে কি কি শুনেছে। মোসলেম বিগত এক সপ্তাহের পড়ানো বিষয়গুলো পণ্ডিত মহাশয়কে শুনিয়ে দেন। পণ্ডিত মহাশয় অবাক হন এবং জমিদারের অনুমতি নিয়ে তাকে পড়ার সুযোগ করে দেন। তিনি কাব্যতীর্থ পাস করেন। কাব্যতীর্থ পাস করার পর সিংগাশোলপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এ বিদ্যালয় হতে এমইএ (পঞ্চম শ্রেণি) পাস করেন। এরপর পুরুলিয়া জুনিয়র হাইস্কুল হতে অষ্টম শ্রেণি পাস করেন। সংসারে নিদারুণ দরিদ্রতা এবং বাবার আকস্মিক মৃত্যুর পর তার শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি ঘটে।মোসলেম সর্ব প্রথম কালিয়া থানার রঘুনাথপুর গ্রামের মরহুম রাহাতুল্লাহ বয়াতীর কাছে শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং এর কিছুদিন পর কালিয়া থানার হাড়িয়ারঘোপ গ্রামের কামেল পুরুষ মোক্তদির বিশ্বাস ওরফে মোক্তার ফকিরের কাছে বায়াত গ্রহণ করেন। মোক্তার ফকির মোসলেমকে যোগ্য শিষ্যরূপে গ্রহনণ করেন ।মোসলেমের মনে ছোটবেলা হতেই প্রশ্ন জাগে সৃষ্টি কী ? আমি কে ? আমি কেন ? কোথা হতে এলাম ও কোথায় যাবো ? কেন এলাম, কেন যাবো  ইত্যাদি হাজারো প্রশ্ন এবং এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই মোসলেম ভাবরাজ্যে নিমজ্জিত হন এবং বস্তু ও ভাবের মহিমা বুঝতে গিয়ে এ সম্পর্কিত রহস্য অনুসন্ধানের প্রয়োজন পড়ে বিধায় অলিখিত এ সকল তাত্ত্বিক বিষয়বস্তু উদ্ধারের জন্য তত্ত্বমোসি গুরুর শিক্ষা প্রয়োজন হয়। কারণ মোক্তার ফকির রচিত অনেক গানের পদে তিনি মোসলেমকে উপলক্ষ করেছেন। অন্যদিকে মোসলেম ও পদরচনার ভনিতায় গুরুরূপে মোক্তার ফকিরের শিক্ষাদীক্ষার কথা উল্লেখ করেছেন। এভাবেই মোসলেম গুপ্ত ভান্ডারের রহস্য ভেদ করে অসংখ্য সংগীত রচনা, সুরারোপ করা, গাওয়া ও প্রকাশনার মাঝে নিজেকে আমৃত্যু ব্যাপৃত রাখেন। মোসলেম বিচিত্র ধরনের সংগীত রচনা করেছেন যেমন-ভজন, ভাটিয়ালী, বিচ্ছেদ, ভাব,নাতে রাসুল, হামদ, দেশাত্ববোধক, বাউল, ব্যাঙ্গগীতি, প্রশ্ন ও জবাব সংক্রান্ত ধুয়াগান, জারিপালা কাহিনী, কীর্তন, অষ্টক, উপদেশমূলক ধুয়োগান, আধ্যাত্মিক গান, হালুই, খাজা বাবার শানে গান, গণসংগীতসহ বিভিন্ন ধরনের প্রায় এক হাজার গান রচনা করেছেন, গেয়েছেন এবং দুইখানা বই `চারণ কবি মোসলেম উদ্দিনের জারিগানের পালা` ও `মোক্তার মালা সংগীত লহরী` তে এর কিছু অংশ প্রকাশিত হয়েছে। রচনার ক্ষেত্রে মোসলেমের অসামান্য অবদান হল শাহনামা কাহিনী অবলম্বনে সোহরাব-রোস্তম জারিপালা। সোহরাব রোস্তম জারিপালায় ইরানি কাহিনী বর্ণনায় তিনি দেশীয় উপকেণের উপমা ব্যবহার করে বাঙালির নৈমিত্তিক জীবনের সুখ দুঃখকে ও বাঙালির অস্তিত্বকে যথার্থ সম্মানে উপস্থাপিত করার প্রয়াস পেয়েছেন। এছাড়া তিনি কারবালা কাহিনীভিত্তিক পালা যথাক্রমে হোসেন শহীদ, মোসলেম শহীদ, মোসলেমের পুত্রবধূ, হাসানের বিষপান, কাসেম শহীদ , হোসেন সমাধী, জয়নাল উদ্ধার, জানচুরি (সংগৃহীত) এবং আরব্য কাহিনী অবলম্বনে সুখদুঃখ ও কল্পকাহিনী ভিত্তিক কামেশ্বরী জারিপালা কাহিনী রচনা করে তা একটা বইয়ে প্রকাশ করে বাংলাদেশি জারিগানের ক্ষেত্রে এক মহান দায়িত্ব পালন করেছেন। অন্যদিকে মোসলেম ছিলেন একজন দক্ষ অভিনেতা। জীবনের প্রথম সাংস্কৃতিক কর্ম হিসেবে মোসলেম ঈমাম যাত্রাপালায় পালা কাহিনী হিসেবে অভিনয়ের জন্য কারবালার বিয়োগান্তক কাহিনী অবলম্বনে  রচনা করেন বেশ কিছু পালাকাহিনী। যথা- হোসেন শহীদ, কাশেম সখিনা, জয়নাল উদ্ধার, মোসলেমের পুত্রবধূ ইত্যাদি। তিনি ১৯৯০ সালের ১৯ আগস্ট নিজ বাড়িতে মারা যান।মোসলেম স্মৃতি পর্ষদ এর সাধারণ সম্পাদক তরিকুল ইসলাম তরিক জানান, নতুনদের মাঝে  জারি সম্রাট মোসলেম উদ্দিনের স্মৃতি বিকশিত করা এবং সকলের মধ্যে মোসলেম প্রেম জাগ্রত করার জন্যই আমরা প্রতি বছরের মতো এ বছরও মেলার আয়োজন করেছি। মোসলেম স্মৃতি পর্ষদকে মোসলেম ফাউন্ডেশনে রূপান্তর করার জন্য যা যা করা দরকার আমরা সেটা চেষ্টা করছি এবং এজন্য সকলের সহযোগিতা কামনা করছি। হাফিজুল নিলু/এসএস/এমএস

Advertisement