আমাদের দেশে যারা বুদ্ধিজীবী এবং সুশীল বলে পরিচিত, তারা এখন আর কেউ জনগণের কিংবা দেশের বৃহত্তর কল্যাণের কথা বলেন না। দু-একজন ছাড়া প্রায় সবাই দলীয় কর্মীর ভাষায় ব্যক্তিস্বার্থের দিকে নজর রেখে কথা বলেন। তারা দলবাজিতে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। রাজনৈতিক দলের অনুগত হয়ে গেছেন। এত বেশি তারা পরচর্চা,পরনিন্দা, মিথ্যাচার করেন যে, সবার বিবেককে নাড়া দেয়।
Advertisement
বেসরকারি টিভিতে টকশো শুরুর প্রথম দিকে অনেকে নিরপেক্ষ এবং স্বাধীনভাবে কথা বলতেন, রাত জেগেও মানুষ টকশো দেখতো। তাদের কথা শোনার জন্য তীব্র আকর্ষণ ছিল মানুষের, এখন আর তা নেই। প্রশ্ন উঠেছে, জাতীয় স্বার্থের কথা না বলে, নীতিনৈতিকতা ভুলে যারা দলীয়প্রীতির প্রতি নিমগ্ন থাকেন, ক্ষমতা কিংবা খ্যাতির নেশায় যারা মদমত্ত, তারা আদৌ বুদ্ধিজীবী কিংবা সুশীল সমাজের মধ্যে পড়ে কি না।
সাম্প্রতিককালে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক জননন্দিত লেখক ইভিএম নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি ক্ষমতাসীনদের সুরে সুর মিলিয়ে বিতর্কিত এই মেশিনের পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখেন। এর আগেও তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিশ্বাসকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে তাদের অভূতপূর্ব আন্দোলনকে থামিয়ে দিয়েছিলেন। ছাত্রছাত্রীদের দাবিকে পদদলিত করে তিনি একটি গোষ্ঠীর স্বার্থ হাসিল করেছিলেন। তাদের প্রধান দাবি ‘ভিসির পদত্যাগ’ আজো পূরণ হয়নি।
এ দুটি ঘটনা প্রমাণ করে যে, তিনি একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর পক্ষ হয়ে কাজ করছেন। এরকম আরও ঘটনা আছে। জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা সত্ত্বেও পক্ষালম্বন করার কারণে তিনি এখন জনগণের কাছ থেকে অনেক দূরে সরে গেছেন। বর্তমান সময়ের বুদ্ধিজীবী আর সুশীলরা নীতি নৈতিকতা ভুলে যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তাদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের সাথে সুরে সুর মিলিয়ে কথা বলেন-এখান থেকেই মূলত তাদের অসন্মানের শুরু।
Advertisement
বিভিন্ন টকশো, লেখনিতে, বিবৃতিতে,বক্তৃতায় এ ধরনের কথিত বুদ্ধিজীবীদের উপস্থিতি লক্ষণীয়। জনগণ এদের অনেককে দলীয় বুদ্ধিজীবী, আত্মবিক্রিত বুদ্ধিজীবী, রাষ্ট্রযন্ত্রের ভাড়াটে বুদ্ধিজীবী, পদক বুদ্ধিজীবী, তোষামোদকারী বুদ্ধিজীবী বলে অভিহিত করেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তবে বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজ কারা? তাদের কাজ কী? তাদের প্রকৃত পরিচয়ই বা কী? বাংলাদেশে প্রচলিত অর্থে যারা এ ধরনের বুদ্ধিজীবী এবং সুশীল বলে পরিচিত, তারা কী প্রকৃত অর্থেই বুদ্ধিজীবী কিংবা সুশীল সমাজের বাসিন্দা না অন্য কিছু?
ফরাসি দার্শনিক জুলিয়েন বান্দা মনে করেন, ‘প্রকৃত বুদ্ধিজীবী তারাই, যারা জাগতিক লাভের ঊর্ধ্বে উঠে নিঃস্বার্থ এবং আপসহীন জ্ঞানচর্চায় ব্যস্ত থাকেন। সত্য উচ্চারণে তারা থাকেন নির্ভীক, এমনকি সত্য প্রকাশের জন্য প্রাণ সংশয়ের মতো ঝুঁকি নিতেও তারা দ্বিধাবোধ করেন না। বরং জাতির সংকটে নিজের জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করেন।’
আরেক দার্শনিক এডওয়ার্ড সাঈদের মতে, ‘বুদ্ধিজীবী এমন একজন ব্যক্তি যিনি স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের পক্ষে একটি নির্দিষ্ট বার্তা, একটি দৃষ্টিভঙ্গি ও একটি সুচিন্তিত মতামত জনগণের সামনে তুলে ধরেন। কোনো প্রতিবন্ধকতাই তাকে সত্য প্রকাশ থেকে বিচ্যুত করতে পারে না ‘ বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সেরা চিন্তাবিদ বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কি বুদ্ধিজীবীর দায়বদ্ধতা প্রসঙ্গে আরও পরিষ্কারভাবে বলেছেন, ‘বুদ্ধিজীবীর দায়িত্ব হচ্ছে, রাষ্ট্র ও সরকারের মিথ্যাগুলোকে জনগণের সামনে উম্মোচন করা।’
এসব প্রখ্যাত দার্শনিক, চিন্তাবিদ এবং বুদ্ধিজীবীর বক্তব্য পর্যালোচনা করে আমরা বলতে পারি, আমাদের দেশে যাদের আমরা বুদ্ধিজীবী কিংবা সুশীল বলে জানি, তারা এই সার্কেলের মধ্যে পড়ে না। ভাবতে আশ্চর্য লাগে, এসব সুবিধাভোগী বুদ্ধিজীবী একটুও চিন্তা করেন না, তাদের স্বার্থান্ধ দলকানা বক্তব্য দেশটাকে কোন অতল গহ্বরে নিয়ে যাচ্ছে!
Advertisement
সমাজে যে সব দুর্বৃত্তায়ন হচ্ছে, তার জন্য তারা কতখানি দায়ী? দিন দিন তারা চরমভাবে বিতর্কিত হচ্ছে। আমরা টিভির টকশোতে দেখতে পাই, এসব কথিত বুদ্ধিজীবী তথা সুশীল সমাজের লোকজন কথা বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে পাড়ার মাস্তানদের মতো হাতাহাতিতেও লিপ্ত হন। তারা মিথ্যাকে সত্য, সত্যকে মিথ্যা বলার প্রাণান্তকর চেষ্টা করেন। ভাবতে আশ্চর্য লাগে, দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নে তারা কীভাবে অকাট্য যুক্তিতর্ক দিয়ে নির্লজ্জ মিথ্যাচার করে যাচ্ছে, যা সচেতন মানুষের মনকে বিষাক্ত করে তোলে। প্রিয় দেশটার ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠিত করে।
আহমদ ছফার মতে, বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা সুবিধাবাদী। তারা নিজেদের আখের গোছাতেই বেশি ব্যস্ত। সমাজের কল্যাণসাধন তাদের উদ্দেশ্য নয়। নিজের স্বার্থের বাইরে তারা একচুলও নড়ে না। সুশীল সমাজের গবেষক ড. শান্তনু মজুমদার এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সুশীল সমাজের কাজ হলো জনগণ এবং গণতন্ত্রের পক্ষে শাসকদের সঙ্গে আলোচনা, দরকষাকষি এবং প্রয়োজন হলে চাপ সৃষ্টি করা। কিন্তু বর্তমানে তারা জনগণের জন্য কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। আমাদের প্রয়োজন স্বাধীন বুদ্ধিজীবীভিত্তিক সুশীল সমাজ যা অতীতে ছিল।’ বাংলাদেশ অধ্যয়ন কেন্দ্রের সম্পাদক অরূপ রাহী তার ‘সিভিল সোসাইটি পর্যালোচনা’ গ্রন্থের এক জায়গায় বলেছেন, “এখানে কথিত সুশীল সমাজ এক ধরনের ‘পাওয়ার এলিট’। তারা তাদের স্বার্থে কখনো এক হন, আবার কখনো নানা শিবিরে বিভক্ত হন। ফলে সত্যিকারের সুশীল সমাজ এখানে গড়ে ওঠেনি।”
অনেকে উচ্চশিক্ষিত ডক্টরেট ডিগ্রিধারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক, গবেষক, ইতিহাসবিদ, বিজ্ঞানী, রাজনীতিক আলোচক হলেই তাদের বুদ্ধিজীবী বলার চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রকৃতঅর্থে তাদের বুদ্ধিজীবী বলা ঠিক নয়। বুদ্ধিজীবী এবং সুশীল ব্যক্তিত্ব তারাই, যারা ক্ষমতা বা খ্যাতির পেছনে ছোটেন না, যারা সমাজের বা রাষ্ট্রের বিরাজমান ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, সমস্যাগুলো নিয়ে নিরপেক্ষভাবে আলোচনা করে সমাধানের পথ নির্দেশনা দেন। এভাবেই ধীরে ধীরে সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায় এবং সন্মানীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিগণিত হন। অবশেষে তারাই হয়ে ওঠেন বুদ্ধিজীবী এবং সুশীল সমাজ, যারা জনগণের অধিকার সংরক্ষণ এবং রাষ্ট্রের কল্যাণ নিশ্চিতকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
লেখক:সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক।golamss636@gmail.com
এইচআর/ফারুক/এমএস