সিআইআরডিএপি বা সিরডাপ হল এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সমন্বিত পল্লী উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ কেন্দ্রিক আন্ত-রাষ্ট্রীয় সংস্থা যা পল্লী উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য কাজ করে। এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতি বছর দারিদ্র্য বিমোচন এবং পল্লী উন্নয়নে অবদানের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে পল্লী উন্নয়ন পদক প্রদান করে থাকে। এই পদক প্রদানের মাধ্যমে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে স্থানীয় পর্যায়ের জনগণের উন্নয়নের জন্য কাজ করবার অনুপ্রেরণা জোগানো হয়। ২০২১ সালের "আজিজুল হক পল্লী উন্নয়ন পদক" পেয়েছেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ২৯ মে সিরডাপের মহাপরিচালক ডা. চেরদসাক ভিরাপা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাতে এই পদক তুলে দেন। অভিনন্দন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী!
Advertisement
শেখ হাসিনা ব্যক্তিগত জীবনে পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্র এবং প্রতিষ্ঠানের নিকট থেকে অনেক সম্মানজনক পদক এবং সম্মাননা পেয়েছেন। হয়তো অনেক ক্ষেত্রেই সেগুলো পল্লী উন্নয়ন পদকের চেয়েও সম্মানের। তবে এই পদকটির একটি আলাদা মূল্য রয়েছে। গত সাড়ে তের বছরে বাংলাদেশের তৃণমূলের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য তিনি যে কাজ করে চলেছেন সেই কাজের স্বীকৃতি অনুযায়ী তাঁকে এই পদকটি প্রদান করা হয়েছে। পদকপ্রাপ্তির পরে স্বাভাবিক ভাবেই তিনি এই পদকটি বাংলাদেশের জনগণের জন্য উৎসর্গ করেছেন।
পদক প্রদান অনুষ্ঠানে তিনি স্পষ্ট ভাবে বলেছেন যে তাঁর সরকারের মূল কাজ হচ্ছে গ্রামের উন্নয়নের মাধ্যমে শহরের উন্নয়ন করা। গ্রামকে উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু ধরেই সকল উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে তাঁর সরকারের আমলে। উন্নয়নকে টেকসই এবং কার্যকরী করতে হলে গ্রামকে উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে বিবেচনা করে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয় যাতে সকল অংশীদার সমান ভাবে উন্নয়নের সুবিধা ভোগ করতে পারে। এই বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সঠিকভাবে উপলব্ধি করেছেন বিধায় ২০০৯ সাল থেকেই স্থানীয় জনগণের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য তিনি নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন।
শেখ হাসিনার দর্শন হলো তৃণমূল থেকে উন্নয়নের প্রক্রিয়া শুরু করা। আর এই কারণেই তৃণমূলে বসবাসরত মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য তিনি বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। তৃণমূল পর্যায়ে উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার অভিপ্রায়ে ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহকে শক্তিশালী করবার কাজ হাতে নিয়েছিলেন।
Advertisement
স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরের জন্য আলাদা আইন প্রণয়নের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করা হয়েছে। স্থানীয় জনগণ যেন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারে এবং নিজেদের পছন্দমতো সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান প্রতিনিধিদের বাধ্য করতে পারে সেই বিষয়টিকে মাথায় রেখেই নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে।
এটা ঠিক যে পরিবর্তন এখনো কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছে নি। তবে পাশাপাশি এটা অস্বীকার করবার উপায় নেই যে তৃণমূল পর্যায়ে জনসাধারনের নিজেদের অধিকার সম্পর্কিত জ্ঞান বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা এখন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করে নিজেদের চাহিদার কথা জানাতে পারে। আর এই কারণেই সম্পদের সুষম বন্টন সম্ভব হচ্ছে স্থানীয় পর্যায়ে।
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালীকরণের সাথে সাথে তৃণমূল পর্যায়ে বসবাসরত জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসেই সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন ধরনের সুবিধা প্রদান করবার কার্যক্রম শুরু করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশে বর্তমানে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির অধীনে ১৩০ টির উপর সেবা প্রদান করা হয় তৃণমূল বসবাসরত মানুষদের।
সময়ের সাথে সাথে উপকারভোগীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। তবে এটা ঠিক যে এখনো সকল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষকে এই কর্মসূচীর আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। আবার অনেক ক্ষেত্রেই যে পরিমাণ সুবিধা প্রদান করা হয় সেটি হয়তো একটি দরিদ্র পরিবারের জন্য পর্যাপ্ত নয়। তবে বাংলাদেশের মতো দেশের সরকারের পক্ষে এ ধরনের সুবিধা প্রদান করা খুব সহজ কাজ নয়।
Advertisement
আমরা গত দু'বছরে করোনা অতিমারি চলাকালীন সময় বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষ যেন কোনোভাবেই কষ্ট না পায় সেই জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির অধীনে প্রদত্ত সুবিধার উপকারভোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছিল করোনাকালীন সময়ে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষেরদের মোবাইলে সরাসরি অর্থ সাহায্য প্রদান করা হয়েছে। টিসিবি এবং ও এম এস এর মাধ্যমে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী স্বল্প মূল্যে বিক্রয়ের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। সার্বিকভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় করোনা থেকে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষের সন্তানরা যেন শিক্ষার সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হয় সেজন্য স্থানীয় পর্যায়ের শিক্ষা ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ২ কিলোমিটার অন্তর অন্তর একটি করে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে যাতে করে ছেলেমেয়েরা হেঁটে স্কুলে যেতে পারে। নারী শিক্ষা অবৈতনিক করা হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষার সাথে। এমন কি নারী শিক্ষার্থীদের বৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে যাতে দরিদ্র বাবা-মা সন্তানদের শিক্ষাকে নিজেদের ওপর বোঝা না ভাবে। এই সকল সিদ্ধান্তের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বান্ধব নীতি প্রতিফলিত হয়েছে।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করবার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করেছেন। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে অন্তত একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক কাজ করছে। কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষকে উপজেলা পর্যায়ে অথবা জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে যেতে হয় না।
সময়ের সাথে সাথে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোকে ঔষধ সরবরাহ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং স্বাস্থ্য কর্মীর সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। এটা ঠিক যে এই ক্লিনিকগুলো এখন পর্যন্ত কাঙ্খিত সেবা প্রদান করতে সক্ষম হয়নি। তবে সরকার যেভাবে এই বিষয়টিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাতে অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো দরিদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করতে সক্ষম হবে।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর গৃহহারা মানুষকে গৃহদান করবার জন্য বিভিন্ন রকম পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় "একটি বাড়ি একটি খামার" ও "আমার বাড়ি আমার খামার" কর্মসূচির মাধ্যমে হাজার হাজার দরিদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষকে সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের মাধ্যমে ভূমিহীনদের মধ্যে জমির মালিকানাসহ পাকা বাড়ি হস্তান্তর করার সিদ্ধান্ত ছিল মুজিববর্ষে শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড় উপহার। এ পর্যন্ত প্রায় ১ লক্ষ ৫০ হাজার ২৩৩ টি বাড়ি হস্তান্তর করা হয়েছে ভূমিহীনদের মধ্যে। ভূমিহীনদের পাকা বাড়ি প্রদানের মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি তার ভালোবাসা ফুটে উঠেছে। পাকা বাড়ি পেয়ে দরিদ্র ভূমিহীন পরিবারের সদস্যদের মুখে যে হাসি আমরা প্রত্যক্ষ করেছি তা থেকে নিশ্চিত ভাবে বলা যায় যে তারা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জন্য অশেষ দোয়া করেছে। সেই হাসি গুলোই হবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আগামী দিনের কাজের অনুপ্রেরণা।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর হাতে ডিজিটাল সেবা পৌঁছে দেবার জন্য সরকার বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের সেবা প্রদান একেবারেই সহজলভ্য করা হয়েছে। এছাড়াও প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুলগুলোতেও ইন্টারনেট সেবা প্রদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল ডিভাইস এর সাথে পরিচয় করে দেওয়ার কাজ সমাপ্ত হয়েছে। ফলে গ্রামে বসে এখন প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বাদ আস্বাদন করতে পারে।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সুপেয় পানি সরবরাহ এবং স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন নিশ্চিত করবার জন্য সরকারের স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চলেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানুষ সুপেয় পানি পান করে এবং স্যানিটারি টয়লেট ব্যবহার করে। এছাড়া গত দুই বছর থেকে সরকারের মূল টার্গেট হলো শহরে গ্রামে সেবা পৌঁছে দেওয়া। এই লক্ষ্যে গ্রাম অঞ্চলে ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হচ্ছে।
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে একথা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বর্তমান সরকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করে যে সমস্ত কর্মসূচি গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করেছে তাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পল্লী উন্নয়ন পদকের যোগ্য দাবিদার ছিলেন। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টায় স্থানীয় পর্যায়ের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষের মুখে হাসি ফুটেছে। মানুষ দুবেলা পেট ভরে খেতে পারছে। সরকারি অর্থায়নে তৈরি পাকা বাড়িতে বাস করতে পারছে। এ সবকিছুই সম্ভব হয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দরিদ্রবান্ধব নীতির কারণে। আর এই কারণেই বাংলাদেশের জনগণ তাঁর ওপরে আস্থা রাখবে আগামী দিনে। তাঁর নেতৃত্বে গত সাড়ে তের বছরে বাংলাদেশের যে অপ্রতিরোধ্য উন্নয়ন সাধিত হয়েছে তা আগামী দিনগুলোতেও অব্যাহত থাকবে বলেই আমাদের সকলের বিশ্বাস।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর।
এইচআর/এমএস