মতামত

নির্বাচনী জোটগণিত

জোট গড়ে, জোট ভাঙে এবং নির্বাচন এগিয়ে এলে জোট গঠন নিয়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়। চিত্রটা মোটামুটি এমনই বাংলাদেশে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি ছোট ছোট দলের সাথে বৈঠক করছে, কথা বলছে। বিএনপি যে রাজনীতি করে, তার সাথে আদর্শিক মিল আছে জামায়াতে ইসলামির এবং সেই সম্পর্ক কিছুটা আড়ালে রাখলেও জামায়াত-বিএনপির ২০ দলীয় জোট অসক্রিয় থাকলেও ভেঙে যায়নি।

Advertisement

এবার একটু ভিন্ন পথে হাঁটছে বিএনপি। ‘খানিকটা বাম’ চরিত্রের গণসংহতি আন্দোলন ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাথে কথা বলতে এই দুটি রাজনৈতিক দলের অফিসে গিয়ে উপস্থিত হয়েছেন খোদ বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বেশ ক’জন কেন্দ্রীয় নেতা। অনেকেই হয়তো কিছুটা বিস্মিত হতে চাচ্ছেন যে, বিএনপি ডানপন্থি দল ছেড়ে কেন কিছুটা বাম ঘরানার দলের দলের সাথে জোট গড়তে চায়। প্রথমত, মির্জা ফখরুল এটি পরিষ্কার করেছেন যে, এই জোট ইস্যুভিত্তিক।

দ্বিতীয়ত বিএনপি ইসলামি ও ডানপন্থিদের ছাড়েনি, তাদের সাথে সখ্য ইস্পাত কঠিন রেখেই নতুন বন্ধু খুঁজছে যেমন বন্ধুত্ব গড়েছিল ২০১৮-এর নির্বাচনের সময় ড. কামাল হোসেনদের সঙ্গে। একথাও সত্য যে, জুনায়েদ সাকিদের মতো নেতা ও তাদের দলের সাথে যে বিএনপির অঘোষিত মতৈক্য হয়েই আছে, তা জানতে এই দুই পক্ষের ইশতেহার পড়ার দরকার নেই। রাজনৈতিক ইতিহাস চর্চা করলেই সেটা বোঝা যায়। এই যে ‘খানিকটা বাম’ জাতীয় ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দল ও জোট আছে, তাদের সাথে আবার গহীনের সম্পর্ক আছে রেজা কিবরিয়া-নুরের গণ অধিকার পরিষদের মতো চরম ডানপন্থি দলেরও।

তাই মানসিক ঐক্যটা ছিলই, এখন মাঠে সেটাকে কাজে লাগাতে চায় বিএনপি। যার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের এত আয়োজন সেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে জোট বিএনপি আগেও করেছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ২০১২ সালে গড়ে তোলা ২০ দলীয় ঐক্যজোট গড়ে জামায়াতের সহযোগিতায় প্রচণ্ড আন্দোলন, সারাদেশে জ্বালাও পোড়াও করেও নির্বাচন ঠেকাতে পারেনি এবং ১৫৪ জনের মতো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কার্যত কোনো গণবিক্ষোভ রচনা করতেও সফল হয়নি। ফলে পুরো সময় ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগ ২০১৮-সালে নিয়মমাফিক নির্বাচন দেয় এবং সেটিকে সামনে রেখেও বিএনপি জোট গঠনে তৎপর হয়।

Advertisement

ড. কামাল হোসেন, মাহমুদুর রহমান মান্নাদের সাথে গিয়ে ২০১৮ সালের নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি, যুক্তফ্রন্ট ও জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়া নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট হয়, কিন্তু সাফল্য আসেনি।

বিএনপিকে যখন জামায়াতের সাথে সখ্য নিয়ে প্রশ্ন করা হয় তখন তারা বলে সরকার কেন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করছে না, যেন যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে জামায়াতের বিরুদ্ধে সব ব্যস্থা নেওয়ার একক দায়িত্ব শুধু আওয়ামী লীগের। নিজেরা শুধু সখ্য ছাড়বে, এটুকুও করতে রাজি নয় বিএনপি।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগ যখন বিএনপিকে জামায়াত ইস্যুতে খোঁচাখুঁচি করে তখন তারা নিজেদের দেখতে পায় না যে, হেফাজতে ইসলামের মতো চরম গোরা একটি গোষ্ঠীর সাথে সে আপস করে, তাদের কথা রেখে শাসন কার্য পরিচালনা করছে। তাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক মঞ্চে রাজনীতির নৈতিকতা নিয়ে উচ্চরব হওয়ার সুযোগ আর নেই। বরং ভাবা যেতে পারে, বিএনপি’র এই নতুন জোটপন্থার ভবিষ্যৎ কী? সেটা অবশ্য কারও কাছেই এখন খুব স্পষ্ট নয়।

ড. কামালদের সাথে নিয়ে ২০১৮ সালের জোট গঠন নিয়ে নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে ব্যাপক সমালোচনা করছেন বিএনপিপন্থি হার্ডকোর বুদ্ধিজীবীরা। তারা বলেছেন, এদের সাথে যাওয়াই ঠিক হয়নি বিএনপির। তাই নতুন জোটের দিকে যখন সবাই তাকিয়ে তখন বেশকিছু ঘটনা ভিন্ন তর্কও সামনে আনছে। কিছুদিন আগে বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ সংগঠন জাতীয়তাবাদী যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। কমিটিতে সুলতান সালাহউদ্দিন টুকুকে সভাপতি করা হয়েছে।

Advertisement

২০০৪ সালের একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা করে শেখ হাসিনাসহ পুরো আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করার প্রচেষ্টা চিরস্থায়ীভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্ষত নিয়ে এসেছে। সেই হামলার পরিকল্পনা, এর সাথে জড়িত বলে পরিচিতি আছে সাবেক উপমন্ত্রী ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার অন্যতম আসামি আব্দুস সালাম পিন্টু। তারই ভাই টুকু। তাকে যখন সভাপতি করা হয়, তখন বিএনপি যে বার্তা দেয় রাজনীতিতে সেটা পরিষ্কার হয়। পরিষ্কার হয় যখন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের মিছিল থেকে স্লোগান উচ্চারিত হয়, ’৭৫-এর হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার’।

ক্যাম্পাস গণতন্ত্র বিবেচনা করলে ছাত্রদলের অবশ্যই সেখানে অবস্থান করার, মিটিং-মিছিল করার অধিকার আছে। কিন্তু কোন রাজনীতি নিয়ে তারা উপস্থিত হচ্ছে সেই প্রশ্নটা ওঠে।

এগুলো সংকেত এবং নির্বাচনী রাজনীতিতে সংকেতের মূল্য কম নয়। রাজপথের আন্দোলনকে সফল না করলে নির্বাচনী জোট সাফল্য আনতে পারে না, এটি বাংলাদেশে বারবার প্রমাণিত হয়েছে। তাই কোনো রাজনীতি নিয়ে জনতার সামনে হাজির হতে হচ্ছে সেটি বড় বিবেচ্য। আগামী সংসদ নির্বাচনে সঙ্ঘবদ্ধ লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। তাই সংখ্যা বাড়াতে উদ্যোগী তার নেতৃত্ব। কিন্তু শুধু এই পাটিগণিতের জোরে নির্বাচনী সাফল্য আসবে এমন ভাবনা দুর্বল।

বিএনপির সামনে অপশন দুটি– ১. যেটা বলছে যে, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া তারা নির্বাচন না করা এবং ২. আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে না গিয়ে তা প্রতিহত করা। দুটোর জন্যই মাঠের সক্রিয়তা আবশ্যক। এই পরিপ্রেক্ষিতেই বৃহত্তর ছবিটিও বিশেষ প্রাসঙ্গিক। যদি এমন হয় যে, বিএনপি নির্বাচনে গেল না, কিন্তু জোটের বন্ধুরা ঠিকই নির্বাচন করল, তখন কী অবস্থা হবে?

জামায়াত নিয়ে দেশের ভেতরে ও বাইরে অনেকের আপত্তি রয়েছে। আপত্তি রয়েছে বিএনপির ভেতরেও। ১৫ আগস্ট এবং একুশে আগস্ট নিয়েও দলের ভেতরে বাইরে এবং বৃহত্তর সমাজে বড় ভাবনা আছে। বিএনপি কি সেটা শুনতে পায়? শুধু জোট দিয়ে মধ্যবিত্তের মধ্যে নৈতিক সমর্থন আদায় সম্ভব হবে না। ষাটের দশক থেকে অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ যে নাগরিক সমাজ বাংলাদেশের সমাজের অন্তরে বসে আছে তাকে বড় আকারে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়া সহজ কাজ নয়।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।

এইচআর/এএসএম/ফারুক