জাগো জবস

স্রোতের বিপরীতে পলাশের পথচলা

পলাশ সকালের পড়াশোনা টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে হলেও ক্যারিয়ার গড়েছেন স্রোতের বিপরীতে। ২০১২ সালে গাজীপুরের ঢাকা ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (ডুয়েট) থেকে বিএসসি সম্পন্ন করলেও মন বসেনি গতানুগতিক ক্যারিয়ারে। শৈশবের প্রিয় খেলা ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ থেকে গড়ে তুলেছেন স্পোর্টস এজেন্সি ‘পাওয়ার প্লে কমিউনিকেশনস’। এ ছাড়াও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে ‘হাউজ অব এনইউবিডিয়ান্স’ নামক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছেন। পাশাপাশি তার পরিচয় তালিকায় আছে শিক্ষক, উদ্যোক্তা, মডেল, সামাজিক সংগঠক প্রভৃতি।

Advertisement

সম্প্রতি জাগো নিউজের মুখোমুখি হয়ে জানিয়েছেন ভিন্নধর্মী কাজের সাথে নিজের পথচলার গল্প। তার বর্তমান কার্যক্রম, ভবিষ্যৎ ও জানা-অজানা বিষয়ে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—

জাগো নিউজ: রেডিওতে ক্যারিয়ারের শুরুর গল্পটা কেমন ছিল?পলাশ সকাল: প্রথমে রেডিওতে ক্যারিয়ার শুরু করি। ২০০৮ সালে ‘রেডিও আমার’ নামে চ্যানেলে কাজ করা শুরু হয়। প্রথমে ইউনিভার্সিটি প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করি। এরপর রেডিওর নিউজ টিমে এবং স্পোর্টস টিমে কাজ করা হয়। তখন রেডিওতে ‘মাই ক্যারিয়ার’ নামে একটি পোগ্রাম পরিচালনা করতাম। ২০১৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ৭ বছর রেডিওতে কাজ করা হয়েছে।

জাগো নিউজ: ক্রিকেট নিয়ে কাজ করার গল্পের শুরুটা কীভাবে?পলাশ সকাল: ক্রিকেটে কাজ করার গল্পটা একটু ইন্টারেস্টিং ছিল। রেডিওতে কাজ করার সময় সিনিয়র ক্রিকেটার মোহাম্মদ আশরাফুলের ইন্টারভিউ নেই তার বাসায়। সেখান থেকে ক্রিকেটে কাজ করার পথচলা শুরু হয়। তখন প্লেয়ারদের ব্র্যান্ডিং নিয়ে কাজ করার আইডিয়াটা মাথায় আসে। এই আইডিয়া আশরাফুল ও মমিনুল ভাইকে শেয়ার করি। পাশাপাশি আরও কয়েকজন প্লেয়ারকেও বলি। প্রথমে দু’একজন নিয়ে হলেও বর্তমানে ভালো কাজ করছি।

Advertisement

জাগো নিউজ: ভালো ক্যারিয়ার ছেড়ে এই ঝুঁকির পথচলা কেমন?পলাশ সকাল: আমি সব সময় গতানুগতিক বিষয় বাদে ভিন্ন কিছু করার চিন্তা করতাম। অন্য মানুষের চিন্তা-ভাবনা থেকে আলাদাভাবে চিন্তা করার চেষ্টা করতাম। পড়াশোনা শেষ করার পর একটি ফরেন বায়িং হাউজে চাকরি করি। যখন খেলা হতো তখন অফিসে দেখতাম সবাই অনেক আগ্রহ নিয়ে খেলা দেখতেন। বাংলাদেশ ভালো খেললে সবাই একসাথে মাঠে আনন্দ করছেন। তখন ভাবি এমন কিছু করবো, যাতে প্লেয়ারদের সাথে থাকা যায় এবং তাদের সাথে কাজ করার সুযোগ থাকবে। এভাবে আইডিয়াটা মাথায় আসে। তখন চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ শুরু করি। শুরুর দিকে আমার জীবনে অনেক বাধা আসে। প্রথমে প্লেয়াররা আমার উপর ট্রাস্ট রাখতে পারেননি। ফ্যামিলি থেকে সাপোর্ট পাইনি। শিক্ষক ও বন্ধু-বান্ধব সবাই বলতেন, ভালো ক্যারিয়ার ছেড়ে কেন অনিশ্চিত ক্যারিয়ারের দিকে পা দিচ্ছি! আমি আসলে ঝুঁকি নিতে পছন্দ করি। আর জীবনে বড় হতে হলে অবশ্যই ঝুঁকি নিতে হবে। টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার, গোছানো ক্যারিয়ার এবং ভালো ভবিষ্যৎ ছেড়ে অনিশ্চিত জীবনে ঝাঁপ দেওয়া অনেক ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। প্রথম কয়েক বছর অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল, অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। আস্তে আস্তে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে পেরেছি।

জাগো নিউজ: ‘পাওয়ারপ্লে কমিউনিকেশনস’ সম্পর্কে কিছু বলুন—পলাশ সকাল: আমি ২০১৫ সালে ‘পাওয়ারপ্লে কমিউনিকেশনসে’ কাজ শুরু করি। এটি হচ্ছে এজেন্সি। আমি ব্যক্তি পলাশ প্লেয়ারদের এজেন্ট হিসেবে কাজ করি। যে কাজগুলো করি, আমার কোম্পানির মাধ্যমে করা হয়। বাংলাদেশের অনেক বড় বড় কোম্পানির পাশাপাশি অনেক ইন্টারন্যাশনাল ব্র্যান্ডের সাথে কাজ করেছি। যেমন- কোকাকোলা, ইয়ামাহা, অপো, ভিভো, রিয়েলমি এবং কয়েকটি বিদেশি কোম্পানি। পাশাপাশি ক্রিকেট নিয়ে ‘পাওয়ারপ্লে কমিউনিকেশনস’ কাজ করছে।

জাগো নিউজ: সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে ক্রিকেটার মেহেদী মিরাজসহ ৩ জন মিলে ‘সকলের হাসি’ প্রতিষ্ঠা করেছেন, যাত্রাটা কেমন ছিল? পলাশ সকাল: আমি আসলে চেষ্টা করি ভালো কাজ করার এবং ভালো কাজের দ্বারা মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে। করোনার সময়ে অনেকের চাকরি চলে যায়। তখন মানুষগুলো অনেক কষ্টে দিনযাপন করত। তাদের জন্য কিছু করার চিন্তা থেকে বাবলু ভাই ও মেহেদী মিরাজকে আইডিয়া শেয়ার করি। তারা বিষয়টিতে ইতিবাচকভাবে সাড়া দেন। তখন থেকে ‘সকলের হাসি’ সংগঠনটির পথচলা শুরু। ২০২০ সালে প্রায় ২৩-২৪টি জেলায় সকলের হাসির পক্ষ থেকে অসহায় মানুষদের যথাসম্ভব সহযোগিতা করেছি। পাশাপাশি এই ভালো কাজগুলো সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। যাতে অন্যরা দেখে নিজ থেকে মানুষদের সহযোগিতা করেন। আমাদের কাজ দেখে অনেকেই অনুপ্রাণিত হয়েছেন এবং অসহায় মানুষদের সহযোগিতা করেছেন। সকলের হাসির পক্ষ থেকে চেষ্টা করছি গরিব ও অসহায় শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করার। আশা করি, ভালো কাজের দ্বারা সকলের হাসি অনেক দূর এগিয়ে যাবে।

জাগো নিউজ: জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম নিয়ে কাজ করছেন—পলাশ সকাল: ২০২০ সালের জুলাই মাসে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটি প্ল্যাটফর্ম চালু করেছি। বর্তমানে দেশে প্রায় ৪০ লাখ শিক্ষার্থী আছে। তারমধ্যে ৬ লাখ পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায়, বাকি ৩৪ লাখ শিক্ষার্থী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ঢাকার বাইরে। নেটওয়ার্কিং, কমিউনিকেশন ও কানেক্টিভিটির জায়গা থেকে তারা অনেক পিছিয়ে। সবচেয়ে বড় কথা, এসব শিক্ষার্থী হীন্মন্যতায় ভোগেন। তারা প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের থেকে নিজেকে ছোট মনে করেন। সঠিক ইনফরমেশন না পাওয়ায় তারা ভালো কিছু করতে পারেন না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া মানেই তারা মেধাবী নন বা কিছু করতে পারবেন না বিষয়টি এমন নয়। ঢাকার বাইরে থাকার ফলে তারা নেটওয়ার্ক থেকে পিছিয়ে। প্রাইভেট সেক্টরগুলোয় তাদের উপস্থিতি কম। এসব শিক্ষার্থীর নেটওয়ার্ক বৃদ্ধি, স্কিল ডেভেলপ, কানেক্টিভিটি, পাবলিক স্পিকিং এবং আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য কাজ শুরু করি। এ প্লাটফর্মে থেকে যদি কেউ ভালো চাকরি পান বা ক্যারিয়ার পরিবর্তন করতে পারেন, তাহলে এটাই আমার সার্থকতা। আমার মৃত্যুর পর তা সদকা হিসেবে থেকে যাবে। আমরা অনেক এগিয়ে যেতে পেরেছি। বর্তমানে ‘এনইউবিডিয়ান্স’ পেজ ও গ্রুপ মিলিয়ে দুই লাখ শিক্ষার্থী নিয়মিত আমাদের ক্লাসগুলো করছেন।

Advertisement

জাগো নিউজ: হাউজ অব এনইউবিডিয়ান্সের লক্ষ্য কী ছিল? পলাশ সকাল: আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে—জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কোয়ালিটি ও মানের মধ্যে যে ফাঁক রয়েছে, তা কমিয়ে নিয়ে আসা। তাদের প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমকক্ষ করা। কর্পোরেট সেক্টরে তাদের চাকরির কোয়ালিটি ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে কাজ করা। এসব শিক্ষার্থী দক্ষ হলে দেশের উন্নয়ন সম্ভব। ২৫টিরও বেশি জেলায় আমাদের ক্যাম্পাস টিম আছে। ৫০টি ক্যাম্পাস পাইপলাইনে আছে। গত ২ বছরে প্রায় ৫০০টির মতো ক্লাস ও সেশন নিয়েছি। স্কিল ডেভেলপমেন্ট ক্যারিয়ার মিটআপ করেছি। জাতীয়ভাবে পাঁচটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। বৃক্ষরোপণ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং সোশ্যাল অ্যাক্টিভিটি নিয়ে কাজ করেছি। পড়াশোনার পাশাপাশি সামাজিক কার্যক্রমের দিকে সংযুক্ত করা, নেটওয়ার্কিং বৃদ্ধি, কানেক্টিভিটি বাড়ানো, শিক্ষদের সাথে সম্পর্ক ভালো করা, চাকরির বাজারে প্রবেশের সুযোগ বৃদ্ধি করা। এরইমধ্যে ১০টি কোম্পানির সাথে কথা হয়েছে, যারা এসব শিক্ষার্থীকে চাকরির সুযোগ তৈরি করে দেবেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হাইলাইট করা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো শিক্ষার্থীদের দিয়ে অন্যদের অনুপ্রেরণা দেওয়ার চেষ্টা করি। প্রায় ২৫০-৩০০ পর্যন্ত ক্যাম্পাস লিডার আছে, যাদের নিয়মিত ট্রেনিং করাই এবং তাদের মাধ্যমে পুরো ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে যাই। আর এই মাস থেকে দেশের প্রতিটি ক্যাম্পাসে ফ্রি লাইব্রেরি করে দেবো। জুন মাস থেকে প্রতিমাসে ‘এনইউবিডিয়ান্স জানালা’ নামে একটি ম্যাগাজিন বের হবে।

জাগো নিউজ: কতটা সফল মনে করেন এ উদ্যোগে? পলাশ সকাল: যতটা আশা করেছি, তার চেয়ে বেশি সফল হয়েছি। কারণ এ প্লাটফর্মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর শিক্ষকরা ক্লাস নেন। ওয়ালটন, আকিজ গ্রুপের এমডি, বড় বড় কোম্পানির সিও ও এমডিরা তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছেন এবং নলেজ দেন। প্রায় ১০-১৫টি কোম্পানি আছে, যারা শিক্ষার্থীদের চাকরির সুযোগ দেন। এরইমধ্যে ৫০০ এর উপরে ক্লাস দিয়েছি। ৩০টির মতো ট্রেনিং দিয়েছি। বিভাগীয় শহরে ক্যারিয়ার মিটআপ করেছি। এনইউবিডিয়ান্স জানালা ম্যাগাজিনে ক্যারিয়ার, শিক্ষা, স্কিল ডেভেলপ, হেলথ টিপস, ফ্যাশন ও চাকরি বিষয়ক লেখা থাকবে। তা ছাড়া শিক্ষার্থীরা গল্প, কবিতা, ছড়া এবং বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এখানে লেখা দেবেন। আমরা যেই লক্ষ্য নিয়ে কাজে নেমেছি, তাতে সফলতা এসেছে।

জাগো নিউজ: শিক্ষক পরিচয়ে নিজেকে গড়ে তোলার গল্পটা শুনতে চাই—পলাশ সকাল: প্রত্যেক মানুষই চায়, যে জিনিসটি জানে সেটা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে। আমিও আমার নলেজ ও অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চাই। প্রথমে একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বছর ক্লাস নিই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে গেস্ট টিচার হিসেবে ক্লাস নিই। সম্প্রতি কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশে এডজান্ট ফ্যাকাল্টি হিসেবে যোগদান করেছি। এখানে এমবিএ পড়াই। শিক্ষকতা আনন্দদায়ক ও সম্মানের পেশা। আমার নলেজ ও অভিজ্ঞতাগুলো শিক্ষার্থীদের মাঝে শেয়ার করি। সব সময় নিজে শিখতে এবং শিক্ষার্থীদের শেখাতে চেষ্টা করি। এই বয়সে তিন-চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে।

জাগো নিউজ: আগামীর পথে কী নিয়ে স্বপ্ন দেখছেন?পলাশ সকাল: ক্রিকেট নিয়ে ভবিষ্যতে অনেক দূর যেতে চাই। পাশাপাশি সবার আস্থার পাত্র হিসেবে গ্রহণযোগ্য হতে চাই। ইন্টারন্যাশনালি যেন সব ক্রিকেটার আমাকে এক নামে চেনেন এবং তাদের আস্থাভাজন হিসেবে কাজ করতে পারি। এনইউবিডিয়ান্স নিয়ে লক্ষ্য ৩৪ লাখ শিক্ষার্থী এ প্লাটফর্মে আসবে। সবাই দক্ষ ও স্কিলফুল হয়ে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখবে। সবাই এনইউবিডিয়ান্সকে ধারণ করবে। দেশের পাশাপাশি বিশ্বে এনইউবিডিয়ান্স এবং তাদের সফলতাকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাই।

এসইউ/এএসএম