অর্থনীতি

‘সরকারি অপচয় রোধ করতে সার্বিকভাবে চিন্তার প্রয়োজন’

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। জন্ম ১৯৫১ সাল। শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক। বেসরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ব্র্যাকের চেয়ারম্যান। ড. ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে দায়িত্ব পালন করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শিক্ষা ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, যুক্তরাজ্য আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিভাগ, ডেনিশ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা, সুইডিশ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিতা সংস্থা, টেকসই উন্নয়ন কমিশন, অ্যাকশন এইড, জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও জাতীয় সংস্থার পরামর্শদাতা হিসেবে সামলেছেন দায়িত্ব। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিপিআরসিরও নির্বাহী প্রধান তিনি।

Advertisement

বৈশ্বিক সংকট, দেশে দেশে খাদ্য রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা, বাংলাদেশ পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে করণীয় প্রসঙ্গে মুখোমুখি হন জাগো নিউজের। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু।

জাগো নিউজ: একদিকে করোনা মহামারির বিপর্যয়। অন্যদিকে যুদ্ধাবস্থা। এই পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন অনেকে। আপনার কোনো পর্যবেক্ষণ আছে কি না?

Advertisement

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: বিশ্বব্যাপী যে সংকট চলছে তার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যকার যুদ্ধ অন্যতম। বিশ্বের খাদ্য ব্যবস্থার জন্য রাশিয়া ও ইউক্রেন অন্যতম জোগানদাতা। বিশেষ করে গমের সরবরাহে।

এই যুদ্ধের কারণে দুটি প্রভাব সরাসরি লক্ষ্য করার মতো। প্রথমত, খাদ্য, বিশেষ করে গমের সরবরাহে প্রভাব। দ্বিতীয়ত, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি বা সরবরাহে প্রভাব। জ্বালানি দ্বারা পৃথিবীর সবকিছুই প্রভাবিত। এ কারণে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সারা বিশ্বে এরই মধ্যে প্রভাব ফেলেছে।

জাগো নিউজ: আর কী কারণ উল্লেখ করবেন?

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে অনবরত। খাদ্য সংকটের জন্য জলবায়ুর পরিবর্তনও প্রধানত দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে। এখন অসময়ে বৃষ্টি হচ্ছে। অতিবৃষ্টি হচ্ছে। পাশের দেশ ভারতেও তাই লক্ষ্য করতে পারবেন। কৃষির ওপর প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলছে জলবায়ু পরিবর্তন। করোনার সংকটও প্রভাব ফেলছে বটে। কিন্তু সেই সংকট মানুষ কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। যুদ্ধ ও জলবায়ুর পরিবর্তন সংকট বাড়িয়ে তুলছে।

Advertisement

খাদ্যে দুই ধরনের সংকট দেখতে পাচ্ছি। প্রথমত, খাদ্যমূল্য বাড়ছে। দ্বিতীয়ত, খাদ্য সংরক্ষণে জাতীয়তাবাদ বিষয়টি তীব্র হচ্ছে। আন্তঃদেশীয় যে নির্ভরতা আছে, তা সংকোচিত হচ্ছে। দেশে দেশে রপ্তানি নীতি পরিবর্তন হচ্ছে। নিজে বাঁচার জন্য মরিয়া হয়ে পড়ছে।

জাগো নিউজ: বাংলাদেশের পরিস্থিতি কী দেখছেন?

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: বাংলাদেশে জোগানের ঘাটতি এখনো চোখে পড়ার মতো হয়নি। কিন্তু মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সংকট তৈরি হয়েছে। জোগানের বিষয়ে বাংলাদেশে পরবর্তীসময়ে কী ঘটবে, তা বলার সময় আসেনি। তবে মূল্যবৃদ্ধির কারণে জোগান থাকার পরেও সংকট তীব্র হয়েছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পরিধিটা ব্যাপক। দরিদ্র ও মধ্যবিত্তরা এরই মধ্যেই এ সংকটের কবলে পড়েছে।

সুতরাং খাদ্য সংকট নিয়ে মানুষ যে উদ্বেগ প্রকাশ করছে, তার আসলে ভিত্তি আছে।

জাগো নিউজ: সংকট মোকাবিলায় দেশে দেশে উদ্যোগ নিচ্ছে। বাংলাদেশ নিয়ে কী বলবেন?

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: পৃথিবীর সংকট সব সময়ই হয়ে আসছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারগুলো আসলে এই সংকট কীভাবে সামাল দেয়। দক্ষ রাষ্ট্র বা সরকারগুলো পরিস্থিতি এমনভাবে সামাল দেয় যে, মানুষ সেই অর্থে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।

বাংলাদেশে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যাপকভাবে এবং ক্ষতির পরিধি বাড়ছে ক্রমাগতভাবে। প্রত্যেক মানুষকেই কোনো না কোনোভাবে বাজারমুখী হতে হয়। কেউ স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। আর বাজারে ক্রয়ক্ষমতা সবার সমান নয়। যার হাতে নগদ টাকা নেই, সে কী করবে!

সংকটের এই ধাক্কায় নতুন করে নগর সমাজতত্ত্ব সামনে এসেছে। শহরের অনেক মানুষই তার পরিবারের একটি অংশ গ্রামে পাঠিয়ে দিচ্ছে। হয়তো তার সন্তানদের গ্রামে দাদা-দাদি বা নানা-নানির কাছে রেখে আসছে। ব্যয় কিছুটা কমাতেই এমন কৌশল নিতে হচ্ছে।

জাগো নিউজ: বাংলাদেশ সরকারও পরিস্থিতি সামলে আনতে উদ্যোগ নিচ্ছে। সরকারপ্রধান কৃচ্ছ্রসাধনে সরকারি আমলাদের বিদেশ সফর কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এটি তো প্রশংসার দাবি রাখে?

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: অবশ্যই বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে এটি একটি সুষ্ঠু পদক্ষেপ। তবে এ ধরনের উদ্যোগের দুটি দিক। প্রথমত, উদ্যোগ গ্রহণ গণ্ডির মধ্যেই আটকে থাকলো কি না। দ্বিতীয়ত, এই পদক্ষেপ দিয়ে সরকার সংকেত দিচ্ছেন কি না যে আরও বৃহৎ পরিসরে ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে।

সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর কমিয়ে আনার বিষয়টি হয়তো ডলার ক্রাইসিস থেকে গুরুত্ব পেয়েছে। এটি খণ্ডিত পদক্ষেপ বলে মনে করি।

আমরা দেখেছি, বিদেশ সফরগুলোর অধিকাংশই অপ্রয়োজনে হয়ে আসছে। প্রয়োজনের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় খরচগুলো নির্ধারণ করা হচ্ছে না। সুতরাং এ উদ্যোগ কৃচ্ছ্রসাধনের বৃহত্তর সংকেত হলে ভালো হয়। কিন্তু সাংকেতিক বলে মনে হচ্ছে না।

জাগো নিউজ: কেন এমন মনে করছেন?

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: অপচয় রোধ করার অনেক ক্ষেত্র রয়েছে। সরকার সেখানে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। যেমন- প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই বা প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণ না করেই গ্রহণ করা হচ্ছে। একটির পর একটি বিশাল আকারের প্রকল্প নিয়ে কোটি কোটি টাকা অপচয় করছে। পরে আবার স্বীকার করে বলছে, দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। যেমন- ঢাকা-চট্টগ্রামের ইলেকট্রিক বুলেট ট্রেন প্রকল্পে একশ কোটি টাকা ব্যয় হওয়ার পর আবার নতুন করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।

এ কারণে শুধু ডলার ক্রাইসিস কেন্দ্র করে উদ্যোগ নেওয়া কোনো টেকসই সিদ্ধান্ত হতে পারে না। সরকারি অপচয় রোধ করতে সার্বিকভাবে চিন্তার প্রয়োজন রয়েছে। আপনি অপচয় করার ক্ষেত্র তৈরি করে রাখবেন, আবার খণ্ডিত উদ্যোগ নেবেন, তা তো হতে পারে না। মনে রাখতে হবে অপচয়ের ক্ষেত্র থাকলে দুর্নীতি করার ব্যাপক সুযোগ তৈরি হয়। এখন তাই হচ্ছে।

এএসএস/এএসএ/জেআইএম