দেশজুড়ে

কৃষি ও প্রকৃতিকে আপন করে নিয়েছেন দেলোয়ার

চারপাশে ফসলের ক্ষেত। মাঝে গাছপালা আর লতায় পাতায় মোড়ানো একটি বাড়ি। প্রতিটি ঘর কাঠ আর বাঁশ দিয়ে তৈরি। আছে ছনের ছাউনিও। বাড়ির উঠানজুড়ে ছোট-বড় শতাধিক গাছ। সৌরভ ছড়াচ্ছে ফুল। চারদিকে ঘুঘু, দোয়েলসহ নানা পাখির কিচিরমিচির শব্দ।

Advertisement

সবুজ প্রকৃতির মাঝে এমন এক খামারবাড়ির দেখা মিলবে মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার বালিয়াখোড়া ইউনিয়নের কাউটিয়া গ্রামে। উচ্চশিক্ষিত এক সফল কৃষক দেলোয়ার জাহান গড়ে তুলেছেন এ খামার বাড়িটি। যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘প্রাকৃতিক কৃষিকেন্দ্র ও প্রাণবৈচিত্র্য খামার।’ বিলাসী জীবন ছেড়ে প্রকৃতি ও মানুষ বাঁচাতে দেলোয়ারের এ উদ্যোগ।

শুধু সবুজ প্রকৃতির মাঝে খামারবাড়িই গড়ে তোলেননি দেলোয়ার; তার খামারে উৎপাদিত সবজিসহ প্রতিটি ফসল কীটনাশক ও রাসায়নিক সারমুক্ত।

নিজেদের জীবনযাপনও প্রাকৃতিক। খামারে বিদ্যুতের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয় সোলার প্যানেল। সংসারের তৈজসপত্র সবই মাটির তৈরি। মাটির পাত্রেই খাওয়া-দাওয়া। কোনো অতিথি এলে তাদেরও মাটির পাত্রেই খাবার পরিবেশন করা হয়।

Advertisement

কুষ্টিয়ার গোপালপুর গ্রামে বেড়ে ওঠা দেলোয়ার জাহান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে চাকরির সুযোগ এলেও তা নাকচ করে দেন। কারণ ছোটবেলা থেকেই কৃষি ও প্রকৃতি তাকে খুব কাছে টানতো।

শিক্ষাজীবন শেষে দীর্ঘ আট বছর ঢাকায় দুটি জাতীয় দৈনিকে সাংবাদিকতা করেছেন দেলোয়ার। সেখানেও তার বিষয় ছিল কৃষি ও পরিবেশ। কৃষিকে আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এগ্রো ইকোলজি বিষয়েও কোর্স করেছেন তিনি।

শিক্ষাজীবন থেকেই দেলোয়ার জাহানের ভাবনায় ছিল, আধুনিক চাষাবাদের নামে যেখানে কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহার করে জীবন ও প্রকৃতিকে হুমকিতে ফেলা হচ্ছে, সেখান থেকে কীভাবে বেরিয়ে আসা যায়। তার মনে গেঁথে ছিল, ভালো থাকতে গেলে নিরাপদ খাদ্য আর বিশুদ্ধ অক্সিজেনের কোনো বিকল্প নেই। তাই সংকল্প করেন মানুষ ও প্রকৃতিকে বাঁচাতে কাজ করবেন তিনি।

বিভিন্ন পেশার সমমনা কিছু মানুষের মাঝে শেয়ার করেন তার ভাবনার কথা। কয়েকজন সমর্থন দেন এবং এগিয়ে আসেন। তাদের নিয়েই প্রাণবৈচিত্র্য খামারের মাধ্যমে শুরু হয় তার প্রাকৃতিক কৃষিরক্ষার সামাজিক আন্দোলন।

Advertisement

ভাবনাটা ২০০৪ সাল থেকে হলেও মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করেন ২০১২ সালে। মানিকগঞ্জের কাউটিয়া গ্রামে নিজের কেনা দুই বিঘা জমি নিয়ে গড়ে তোলেন খামারবাড়ি। স্থানীয়দের কাছ থেকে লিজ নিয়ে ১৪ বিঘা জমিতে নানা ধরনের ফসলের চাষাবাদ করছেন।

দেলোয়ারের খামারে লালন-পালন করা গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগিও বড় হচ্ছে প্রাকৃতিক খাবার খেয়ে। জমির ফসল ফলান প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে।

দেলোয়ারের খামারে আছে মাছ, হাঁস, মুরগি, ছাগল ও কবুতর। এগুলো সবই প্রাকৃতিক খাবার খেয়েই বড় হচ্ছে। ধান, পাট, সবজিসহ নানা ফসল উৎপাদনে কোনো কীটনাশক এবং রাসায়নিক সার ব্যবহার করেন না তিনি।

দেলোয়ারের ভাষ্য, ‘আধুনিক চাষাবাদের নামে পরিবেশ ও প্রকৃতিকে হুমকির মুখে ফেলা হচ্ছে। পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণের জন্য কীটনাশকের প্রয়োজন নেই।বিভিন্ন পোকা, ছত্রাক, অণুজীব আছে যেগুলো ক্ষতিকর পোকামাকড়কে মেরে ফেলতে পারে। এক্ষেত্রে বড় উপকারে আসে ব্যাঙ, পাখিও।’

দেলোয়ারের এই প্রাণবৈচিত্র্য খামার দেখতে প্রায় প্রতিদিনই ভিড় করে মানুষ। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের আগ্রহীরা আসেন প্রাকৃতিক কৃষির ওপর প্রশিক্ষণ নিতে এবং গবেষণা করতে। দেলোয়ার তাদের শেখান কীভাবে নিরাপদ খাদ্য ও বিশুদ্ধ অক্সিজেন গ্রহণের মাধ্যমে মানুষ ভালো থাকতে পারে।

দেলোয়ারের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে টাঙ্গাইল, সুনামগঞ্জ, ঝিনাইদহসহ কয়েকটি জেলায় শতাধিক কৃষক কীটনাশক ও রাসায়নিক মুক্ত ফসল উৎপাদন করছেন। তাদের এবং মানিকগঞ্জ খামারে উৎপাদিত ফসল বিক্রির জন্য ঢাকার মোহাম্মদপুরে চালু করেছেন একটি প্রাকৃতিক কৃষি বিপণন কেন্দ্র। সপ্তাহের সাতদিনই বিপণন কেন্দ্রটি খোলা থাকে।

উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হলেও নিজেকে আপাদমম্তক একজন কৃষক মনে করেন দেলোয়ার জাহান। নিজের খামারে সাধারণ কৃষকের মতোই কাজ করেন। তার স্ত্রী ডলি বেগমও খামার সামলান গ্রামের সাধারণ কৃষক পরিবারের মতোই। তাদের সংসারে রয়েছে পাঁচ বছর বয়সী ছেলে তৃণ আর দুই বছর বয়সী মেয়ে ভূমি।

প্রাকৃতিক কৃষির ওপর নির্ভর করে যে ভালো থাকা সম্ভব তা বোঝাতেই খামারটি প্রতিষ্ঠা করেছেন বলে জানান দেলোয়ার জাহান। তিনি বলেন, ‘সুস্থভাবে বাঁচতে চাইলে মানুষকে জীবনে ফিরতে হবে। এর মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তনের অভিমুখ হতে পারি আমরা।’

‘অনেকেরই প্রাকৃতিক কৃষি নিয়ে আগ্রহ আছে। কিন্তু বাণিজ্যিক সিস্টেমের কারণে তারা শেষ পর্যন্ত সফল হন না। দেলোয়ার স্বপ্ন দেখেন, ভবিষ্যতে তার প্রাণবৈচিত্র্য খামারটি হবে একটি মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। যেখান থেকে প্রাকৃতিক কৃষি বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করে মানুষ ছড়িয়ে পড়বে সারাদেশে। তাদের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠা পাবে একটি স্বনির্ভর সমাজ।

এসআর/জেআইএম