মতামত

পাকিস্তানি নারীর ওপর হামলা বাড়ছে কেন?

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও পাকিস্তানে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে পাকিস্তানের নারীরা। বিন্দুমাত্র নিরাপত্তা নেই তাদের। পান থেকে চুন খসলেই গুলি করে মারা হচ্ছে নারীদের। দাম্পত্য জীবনে হিংসা তাদের নিত্যদিনের ঘটনা। বিবাহ বিচ্ছেদ করলেও নেমে আসছে ভয়ঙ্কর শাস্তি।

Advertisement

বিদেশের মাটিতেও এখন আর মোটেই সুরক্ষিত নন পাকিস্তানি নারীরা। যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী সন্তান-সহ পাকিস্তানি নারীদের গুলি করে মারার ঘটনা কমার কোনও লক্ষণ নেই। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার পাশাপাশি পাকিস্তানি গণমাধ্যম ডন পাকিস্তানি নারীদের নিরাপত্তাহীনতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সেখানকার পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের কোনও তুলনাই চলেনা। আমাদের দেশেও পারিবারিক সহিংসতা রয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানের তুলনায় তার চরিত্র এবং পরিমাণ খুবই নগণ্য।

সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশে অপরাধীরা শাস্তি পায়। তাই এখানে বউকে হত্যা করাটা মোটেই অভ্যাসে পরিণত হয়নি। কিন্তু পাকিস্তানে শাস্তির কোনও বালাই না থাকায় বউকে গুলি করে মারাটাই স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে উঠেছে। কখনো 'অনার কিলিং', কখনও প্রতিহিংসামূলক হত্যা, যেন নারীরা তাদের খেলার সামগ্রী ঠিকমত কাজ না করলেই আছড়ে ভেঙ্গে ফেলা যায়!

২০২০ সালের ২০ ডিসেম্বর থেকে নিখোঁজ ছিলেন বালুচ আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী এবং কানাডায় নির্বাসিতা করিমা বালুচ। দুদিন পর টরেন্টো ওয়াটারফ্রন্ট থেকে তার লাশ উদ্ধার হয়। বালুচরা বিশ্বাস করেন করিমাকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু ঘাতক কোনও প্রমাণ রাখেনি। কানাডার পুলিশও তাই বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছে করিমা পানিতে ডুবেই মারা গিয়েছেন। করিমা একা নন, দেশে বা বিদেশের মাটিতে পাকিস্তানি নারীদের অকাল মৃত্যু বেড়ে চলেছে। নারী হত্যা বাড়লেও ঘাতকদের শাস্তির হার কমছে।

Advertisement

নিউ ইয়র্কের হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ২০০৯ সালে তাদের প্রতিবেদনে বলেছিল, 'প্রতি বছর অন্তত ৫ হাজার নারী হিংসায় প্রাণ হারান। ২০ শতাংশেরও বেশি নারীকে সহ্য করতে হয় অসহ্য অপমান ও অসম্মান। প্রতি বছর হাজার হাজার নারী মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণার শিকার হয়ে বিকলাঙ্গের মতো জীবনযাপন করছেন'। প্রতিবেদনটি ২০০৯ সালের।

পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি আরও কয়েক গুণ খারাপ হয়েছে। ডন-এর প্রতিবেদনই তার বড় প্রমাণ। অন্যদিকে, বাংলাদেশের চিত্রটি পুরো উল্টো। গত কয়েক বছর ধরে নারীদের স্বাধীনতা ও মর্যাদা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমেছে পারিবারিক সহিংসতা। তাছাড়া অপরাধীদের কঠোর শাস্তি দেয়া হচ্ছে বাংলাদেশে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ সবধরনের হিংসার বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নারীর নিরাপত্তা বাড়িয়েছে।

অতি সম্প্রতি, ১৯ মে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস শহরের অভিজাত আবাসনে সাত সকালে খুন হন পাকিস্তানি-আমেরিকান নারী সাদিয়া মঞ্জুর (৩৯)। তার সঙ্গেই তার মা ইনায়েত বিবি ও চার বছরের সন্তান খাদিজাকেও হত্যা করা হয়। পরে সাদিয়ার প্রাক্তন স্বামী নিজেও আত্মহত্যা করেন।

সাদিয়ার অপরাধ স্বামীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ডিভোর্স দিতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন নতুন করে বাঁচতে। কিন্তু সেটাই তার জীবনে কাল হয়ে ওঠে। মার্কিন বিচার বিভাগকে উদ্ধৃত করে ডন জানিয়েছে, স্বামীকে ডিভোর্স দিলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পাকিস্তানি নারীকে মৃত্যুবরণ করতে হয়। জরিপকে উল্লেখ করে ডন জানিয়েছে, নির্যাতিতা নারীরাই ৫০০ গুণ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। প্রতিবাদ করলেই নেমে আসছে মৃত্যুর খড়গ।

Advertisement

সাদিনা বা করিমার মতোই দশা হয় স্পেন থেকে পাকিস্তানে আসা দুই বোন অনিষা ও আরুজ আব্বাসদের। ডন জানিয়েছে, ২০ মে পাকিস্তানের গুজরাট শহরে দুই বোনকেই ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা হয়। কয়েক বছর আগে এই দুই বোনকে বাধ্য করা হয়েছিল তাদের চাচাতো দুই ভাইকে বিয়ে করতে। বিয়ের পরই শুরু হয় অত্যাচার।

কানাডায় বসবাসকারী দুই বোন ঠিক করে তারা তালাক দেবে। খবর পেয়েই তাদের ফাঁদে ফেলতে উড়িয়ে আনা হয় পাকিস্তানে। তারপর দাম্পত্য হিংসার বলি হন দুই বোন। ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাদের যে শাস্তি হবে না, এটা ডন-এর প্রতিবেদনেই স্পষ্ট। কারণ নারীকে হত্যা করাটাই এখন পাকিস্তানের নিয়ম হয়ে উঠেছে। ধর্মের দোহাই দিয়ে হোক বা দাম্পত্য জীবনের অশান্তি, নারী মানে শুধু ভোগ্যপণ্যই নয়, তাকে হত্যা করার অধিকারও পাকিস্তানি পুরুষদের রয়েছে বলে তারা মনে করে। এই ঘটনায় সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে মেয়ে দুটির আপন ভাইয়ের।

পাকিস্তানে নারীদের ওপর ভয়ঙ্কর আক্রমণ চলছে প্রতিনিয়ত। বেশিরভাগ ঘটনাই খবর হয় না। কারণ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বলে কিছু নেই। এমনকি, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদ করলেও অত্যন্ত প্রভাবশালীদের বন্দুক গর্জে উঠতে সময় লাগে না। পাকিস্তানের খাইবার পাখতুন এলাকায় তো প্রায়ই ঘটছে এ ধরনের ঘটনা। আদিবাসী বন্দুকবাজরা কথায় কথায় নারীদের গুলি করে মারাটা রীতিমতো অভ্যাসে পরিণত করেছে। প্রত্যন্ত এলাকার এ ধরনের ঘটনা পাশ্চাত্যের মিডিয়া জানতেই পারে না। তাই গোটা দুনিয়াকে অন্ধকারে রেখে পাকিস্তানি নারীদের মানবাধিকার লুণ্ঠিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সেটাই উঠে এসেছে ডন-এর প্রতিবেদনে।

আসলে মুখে ইসলাম ধর্মের কথা বললেও পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের পুরুষরা নারীকে মর্যাদা দিতে জানে না। চিরকালই তাঁরা নারীর অসম্মান করেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার ও আল-বদরদের সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশের নারীদের ওপর করা পাশবিক অত্যাচার তারই জ্বলন্ত উদাহরণ। পাকিস্তানি বর্বরতা জন্ম দিয়েছে তিন লাখেরও বেশি বীরাঙ্গনাকে। নিজেদের দেশেও তাঁরা নারীদের ওপর যথেচ্ছ পাশবিক অত্যাচার চালাচ্ছে।

নারীর যাবতীয় অধিকার হরণ করতে সক্ষম হয়েছে পাকিস্তানি পুরুষরা। ধর্মীয় মৌলবাদী ও মৌলভীর দল সক্রিয় মদদ জুগিয়েছে তাদের। অবশ্য পাকিস্তানের মৌলভি ও ইমামদের বিরুদ্ধেও রয়েছে কিশোর ও নাবালিকা ধর্ষণ থেকে শুরু করে একাধিক অভিযোগ। ধর্মের নামে তারা মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করে চলেছে। তারই কিছুটা আভাষ মিলেছে তাদের দেশেরই ডন পত্রিকায়। পাকিস্তানের গুজরাট, যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস কিম্বা কানাডার ঘটনা উদাহরণ মাত্র।

এই ঘটনাগুলি নিয়ে ডন-এর বিশ্লেষণ, নিজেদের দেশে নারীর ওপর অত্যাচারের অধিকার অর্জনের পর বিদেশেও পাকিস্তানি পুরুষরা একই অধিকার কায়েম করতে চায়। এর পিছনে মৌলবাদীদের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর হাতের পুতুল পাকিস্তান সরকারেরও প্রচ্ছন্ন মদদ রয়েছে।

ডন-এর মতে, আপত্তিজনক সম্পর্ক বিচ্ছেদের পরও পাকিস্তানি নারীদের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রাখা জরুরি। টেক্সাসের ভিন্টেজ পার্কের মতো অভিজাত এবং সুরক্ষিত আবাসনও বাঁচাতে পারেনি সাদিয়ার জীবন। সপরিবারে খুন হন সাদিয়া। এইসব ঘটনা থেকে পরিষ্কার, পাকিস্তানিরা যে কোনও সময়ে সহজেই ঘাতকে রূপান্তরিত হতে পারেন। ভাই-বোন কিম্বা স্ত্রী-কন্যাকে হত্যা করাটা তাদের কাছে কোনো বিষয়ই নয়। তাই খুব সহজে একজন নিকট আত্মীয় আরেক জন আত্মীয়কে খুন করছে। অপরাধীদের শাস্তিও হওয়ার নজির খুব কম।

খুব বেশি হইচই হলে গ্রেপ্তার হয় ঠিকই। কিন্তু বিষয়টি ধামাচাপা পড়তেই ঘাতকেরা জামিন পেয়ে যায়। তারপর ফের শুরু হয় নারী-হত্যা। এভাবেই পাকিস্তানের মাটিতে নারী হত্যা বেড়ে চলেছে। আর দেশের এই চর্চা এখন পাকিস্তানের সীমা পেরিয়ে বিদেশেও চলমান। পাকিস্তানি নারীদের হত্যা করতে হাত কাঁপছে না পাকিস্তানি ঘাতকদের।

পাকিস্তানে দীর্ঘ সময় জুড়ে চলমান মৌলবাদী আচরণ ও জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দেয়ার সঙ্গেও নারীদের ওপর চলমান নির্যাতনের সম্পর্ক রয়েছে। পাকিস্তানের ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে সহজে অস্ত্র উঠে আসছে পুরুষদের হাতে। ফলে নারীদের নিরাপত্তা আরো বিঘ্নিত হচ্ছে। সেই সঙ্গে পাকিস্তানের আদালত থেকে বোন হত্যা বা স্ত্রী হত্যার পর জামিন পেয়ে বের হয়ে আসার উদাহরণ দেশটির পুরুষদের জন্য 'উত্তম দৃষ্টান্তে' পরিণত হচ্ছে। ফলে নারী হত্যার ঊর্বর ভূমিতে পরিণত হয়েছে দেশটি।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/জেআইএম