সাহিত্য

ফোকলোর: বাঙালির শেকড়ের স্বরূপ- শেষ পর্ব

বিভিন্ন দেশে একই ধরনের প্রবাদ প্রচলিত। এক দেশের প্রবাদ যেমন অন্য দেশে প্রচলিত; তেমনই একই ভাব নিয়ে বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন প্রবাদ সৃষ্টি হয়। প্রবাদের মাধ্যমে মানুষের সামাজিক আচার-আচরণ, ধ্যান-ধারণার পরিচয় ফুটে ওঠে। বাংলা প্রবাদের উৎস অনেক। জীবনাচরণকে কেন্দ্র করে ক্ষেত্রবিশেষে এর সৃষ্টি। লোকমুখে প্রচলিত প্রবাদ কবি-সাহিত্যিকদের রচনায় বিশেষ স্থান করে নিয়েছে যুগের সঙ্গে সঙ্গে। এর মধ্য দিয়ে জীবনের একটি চিত্র ফুটে ওঠে। সত্য কথা বিশেষভাবে যখন প্রকাশ করা হয়, তখন সেটা প্রবাদে রূপ নেয়। যেমন আমরা বলি কোনো কাজ করার ইচ্ছাশক্তিটাই বড়। যদি ইচ্ছে থাকে পাহাড়সম কঠিন কাজ নিমিষেই সমাধান করা যায়। এত ব্যাখ্যা না দিয়ে আমরা বলি ‘ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়।’ এমন আরও অনেক প্রবাদ অহরহ আমাদের জীবনে ব্যবহার করে থাকি।              ★ নাম মানুষকে বড় করে না কর্মই মানুষকে বড় করে★ পরের পিঠে বড় মিঠে                               ★ দশের লাঠি একের বোঝা        ★ পরের মুখে ঝাল খাওয়া                            ★ কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ পাকলে করে ঠাস ঠাস              ★ যে সয় সে রয়                              ★ মুখে এক মনে আর    ★ নাচতে না জানলে উঠান বাঁকা              ★ পরের মাথায় কাঁঠাল ভাঙ্গা★ পরের ধনে পোদ্দারি  ★ পরের মুখে ঝাল খাওয়া            ★ ধান ভানতে শিবের গীত          ★ মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশী             ★ পরের ঘাড়ে বন্দুক রেখে শিকার করা ★ রাজার বাড়ীর হাতি নিত্য খায় লাথি     ★ বড়র পীরিতি বালির বাঁধ, ক্ষণে হাতে দড়ি ক্ষণেকে চাঁদ।

Advertisement

এ ছাড়া সমাজে প্রচলিত অসংখ্য প্রবাদ বিদ্যমান। যার মাধ্যমে বিশেষ একটি নির্দিষ্ট ভাব প্রকাশ পায়। ফোকলোরের অন্যান্য শাখার মতো এরও কোনো একক স্রষ্টা মেলা ভার। স্মৃতি ও শ্রুতিতে কালের পরিক্রমায় মানুষের মুখে মুখে আজও এগুলোর বাস। প্রবাদ এমন একটি সৃষ্টি যাকে বাঙালি জীবনাচরণ থেকে বাদ দেওয়া সম্ভব নয়। প্রবাদে জ্ঞানের পরিচয় অপেক্ষা অভিজ্ঞতার পরিচয় বেশি পরিলক্ষিত হয়। প্রাচীনকাল থেকে মানুষের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণে প্রবাদগুলো জীবন্ত রূপ পেয়েছে। কীভাবে প্রবাদের সৃষ্টি হয়েছে, তা বলা সহজ নয়। ইংরেজ শাসন প্রবর্তনের পর দেশ রক্ষার দায়িত্ব চলে যায় সামন্তরাজদের হাতে, তখন থেকেই ডোম জাতির সামাজিক পতন শুরু হয়। কিন্তু তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ছিল। তাই তারা তাদের জীবনের বহু রূপ সংরক্ষণ করে রাখতে সমর্থ হয়। সেজন্য ডোমজাতির মধ্যে কিছু প্রবাদের সন্ধান পাওয়া যায়। কিন্তু তাদের প্রতিবেশীদের মধ্যে কিছুই রক্ষিত হয়নি। যে সব জাতির নিজস্ব প্রচীন ঐতিহ্য নাই তাদের মধ্যে এদের ব্যবহার নেই বললেই চলে। মূলত যে জাতির ভাষার সমৃদ্ধি যত বেশি তাদের মধ্যেই প্রবাদগুলো বেশি সংরক্ষিত হতে দেখা গেছে। প্রবাদগুলোতে অন্তঃপুরের জীবন প্রাধান্য লাভ করেছে এবং মেয়েলি ভাষারই একটি বিশেষ শক্তি এর মধ্যে ফুটে উঠেছে। নিরক্ষর বা অর্ধশিক্ষিত নারীসমাজেই প্রবাদের প্রথম উদ্ভব হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। কেননা প্রাচীনকালে নারীরা একইসঙ্গে বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণ করতো, যেমন ধান ভানা, চিড়া কোটা, মুড়ি ভাজা, ধান মাড়ানো, কাঁথা সেলাই, পিঠা বানানো, গল্প-গুজবে অংশগ্রহণ করা প্রভৃতি। এ সময় স্ত্রীসমাজের মধ্যে পরস্পরের কথায় কথায় এমন একটি বাক্য সহসা বের হয়ে আসতো যা একটি চমক সৃষ্টি করতো এবং পরবর্তীকালে সবার মধ্যে এই চমৎকারিত্বের গুণ মনে গেঁথে যায়। এভাবে বংশ পরম্পরায় যুগ থেকে যুগান্তরে মুখে মুখে তা লোকসাহিত্যের স্বাভাবিক ধারা হয়ে উঠেছে। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম অংশ ফোকলোরে রূপ লাভ করেছে।  

চার.বাঙালি চিরকালই গীতিপ্রবণ জাতি। গানের সুর মানেই বাঙালির অন্তরের সুর। বাঙালি জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য তথা ফোকলোরের সঙ্গে পরিচয় হবে আর সেখানে গান থাকবে না তা হতেই পারে না! জয়দেব থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত তাঁর সর্বোত্তম ফলই তাঁর গীতি বা গীতি-কবিতা। বিশ্বকবি হয়েও রবীন্দ্রনাথ গীতিকবি হিসেবে খ্যাত। তবে বাংলা সহিত্যের প্রধান গীতিকবি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় বিহারীলাল চক্রবর্তীকে। যাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ভোরের বিহঙ্গী’ রূপে আখ্যায়িত করেছিলেন। তাঁর কবিতায় ছন্দের যে মূর্ছনা ফোটে তাতে গীতিপ্রাণ ছন্দ বিদ্যমান। যদিও গান আর কবিতার ছন্দ এবং সুরে ব্যাপক পার্থক্য বিদ্যমান। তবুও গীতি কবিতার এসব ছন্দের সুরই গানের উৎস হিসেবে মনে করা হয়। বাংলা সহিত্যের যে প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদ সেখানেও এই গীতিময়তা লক্ষ্য করা যায়। যদিও এটা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সাধন সংগীত। ধাঁধা, প্রবাদ-প্রবচনের মতো লোকসংগীত ফোকলোরের একটি সুবিশাল স্তর দখল করে আছে। বাংলা ও বাঙালির শেকড় এসব লোকসংগীতে নিহিত। জাত বাঙালির চিরন্তন মনোমুগ্ধকর শোভা এসব গানের মধ্যে ফুটে উঠেছে। লোকসাহিত্যের বিশেষ অংশ গানের মাধ্যমে বাঙালি জাতির জীবনাচরণ, তাদের নীতি-নৈতিকতা, ধ্যান-ধারণা, দুঃখ-সুখ, হাসি-কান্না, প্রেম-বিরহ, মরমি গীত সবই স্থান পেয়েছে। স্থানীয় বিশেষ আচারও গানের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে যার দ্বারা বাঙালি জাতির শেকড়ের সন্ধান মেলে। লোকসংগীত হলো লোকমানস থেকে উদ্ভূত সংগীত যা সাধারণ শ্রুতি এবং স্মৃতিকে নির্ভর করে বহমান। গীত, বাদ্য ও নৃত্য; এসবের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে সংগীত। অন্যদিকে লোকগীত, লোকবাদ্য ও লোকনৃত্যকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয় লোকসংগীত। লোকসংগীতে কাহিনি থাকে না বরং বিশেষ বিশেষ ভাব অবলম্বনেই এ গানগুলো রচিত হয়। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানবজীবনের প্রতিটি অবস্থাই গানে প্রকাশিত হয়। শ্রেষ্ঠত্বের দিক থেকে অন্যান্য লোকসাহিত্যের চেয়ে কয়েকগুণ ওপরে অবস্থান লোকসংগীতের। হৃদয় মন ব্যাকুল করা এ সংগীতগুলো মানব মনের খোরাক। লোকসংগীত সম্পর্কে বিশিষ্ট ফোকলোর গবেষক আশুতোষ ভট্টাচার্য মনে করেন, ‘লোকসংগীতের একটি প্রধান বিশেষত্ব এই যে, কোন দেশে কোনোকালেই লোকসংগীত অনুশীলনের কোনো বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা থাকে না। কিভাবে ইহা রচনা করিতে হয়, কিভাবে ইহাকে স্মৃতিপথে রক্ষা করিতে হয়, কিংবা কিভাবে ইহার সুর ও তাল শিক্ষা লাভ করিতে হয়, তাহার সুনির্দিষ্ট প্রণালী নাই। যাহারা ইহা আয়ত্ত করে, স্বভাব-দত্ত ক্ষমতার গুণে কেবল মাত্র কানে গুনিয়াই তাহা আয়ত্ত করিয়া থাকে। লোক সামাজের মধ্যে এই প্রণালীতেই ইহা চিরকাল ধরিয়া প্রচলিত হইয়া আসিতেছে। সেইজন্য পল্লী সমাজ হইতে যখন আমরা আজ এক নূতন সমাজ জীবনের মধ্যে উত্তীর্ণ হইলাম, তখন ইহাকে রক্ষা করিবার কোন বর্হিমুখী প্রণালীও অনুসরণ করিতে পারিলাম না।’৯

বিষয় ও বৈচিত্র্যের দিক থেকে লোকসংগীতসমূহ কতকগুলো বিশেষ ভাগে বিভক্ত। সব ভাগই নিত্যদিনের জীবনযাত্রার সঙ্গে সম্পৃক্ত। ড. আশরাফ সিদ্দিকী তাঁর ‘লোকসাহিত্য’ গ্রন্থে লোকগীতির বিশেষ ছয়টি ভাগ উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে আঞ্চলিক গীতি যা প্রকৃতপক্ষে অঞ্চলবিশেষে প্রচলিত। বিবাহ উৎসব প্রভৃতি উপলক্ষে যা গীত হয় তাই ব্যবহারিক গীতি। এ ছাড়া আনুষ্ঠানিকভাবে বা হাসির বিষয় নিয়ে যেগুলো গাওয়া হয় সবই হাসির গান। যা নানা কাজ অর্থাৎ কৃষিকাজ, নৌকাবাইচ, ছাদ পিটানো, ধান কাটা, ঘর ছাওয়া প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে গীত তাই কর্মসংগীত বা শ্রম সংগীত। সবিশেষ প্রেমসংগীত এবং বারমাসী গান বলতে মূলত বিরহী নারী-পুরুষের নানা হৃদয়বেদনা ও চিরন্তন প্রেম সম্ভাষণ নিয়ে রচিত গান। বিরহবেদনার রূপ এ সব গানে প্রকাশ পায়। লোকসংগীতের দিক থেকে বাংলাদেশকে চারভাগে ভাগ করা যায়। রাঢ়, পশ্চিম বঙ্গ, উত্তর বঙ্গ, উত্তর-পূর্ববঙ্গ। বাংলার লোকসংস্কৃতির রূপ আজও প্রান্তিক অঞ্চলগুলোতে রক্ষিত আছে।

Advertisement

আঞ্চলিক সংগীতের মধ্যে রয়েছে পটুয়া গান। গ্রামাঞ্চলে পটুয়া নামক এক শ্রেণি সম্প্রদায় পট এঁকে গৃহস্থের বাড়িতে বাড়িতে সংগীতসহ তার প্রদর্শনী করতো। মেদিনীপুর জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমে এ রীতির প্রচলন ছিল কিন্তু কালের পরিক্রমায় এখন তা বিলুপ্তির পথে। রাঢ়ের বীরভূম অঞ্চলে খুঁজলে হয়তো এখনো কিছু অস্তিত্ব পাওয়া যেতে পারে। তৎকালীন সমাজের এ সব গানের মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠেছে বাঙালি জাতির সমাজব্যবস্থার গোড়ার কথা।গরু নাড় গরু চাড় গরু বড় ধন   যার ঘরে গরু নাই তার বৃথাই জীবন।        গরুর সেবা করেছিলেন প্রভু নারায়ণ        ইন্দ্র রাজা দেবগণ বসিয়া আকনে              কপার পৃষ্ঠ কথা কহেন সেখানে।কপিলা ডাকিয়া তবে বলিছে বচন             তোমায় যেতে হবে মা রবনী মণ্ডল।         আমি তো যাবো না রবনী মণ্ডলেআমার মহিমা নরলোকে কিবা জানে।১০

বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের গরুর প্রতি যে শ্রদ্ধা তা আলোচ্য গানে পরিলক্ষিত। তৎকালে এগুলোর মাহাত্ম্য কীর্তন করে চিত্র ফুটিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতো কিছু মানুষ। মুসলমান সমাজে এগুলো গাজীর গান নামে পরিচিত। আঞ্চলিক সংগীতের একটি বিশেষ শাখা ভাদু গান। ভাদ্র মাসে রাঢ় অঞ্চলে যেসব গান গাওয়া হতো সেগুলোকে ভাদু গান বলা হতো। এই আঞ্চলিক সংগীতের মধ্যে আরও আছে টুসু গান, সাথী গান, গম্ভীরা যা এখনো রাজশাহী অঞ্চলে বিশেষভাবে গীত হয়, ভাওয়াইয়া রংপুর এবং ভারতের কোচবিহার অঞ্চলের গান, চটকা, জাগ গান, ঝুমুর গান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া ব্যবহারিক গান পারিবারিক জীবনের ব্যবহারিক প্রয়োজনে গাওয়া হয় এর মধ্যে রয়েছে বিবাহের গান, রাম-সীতার গান, শকুন্তলার গান, সাধ খাওয়ানোর গান, সন্তান জন্মকালীন গান, সুভদ্রা সাবিত্রীর গান, বর সাজানো, কনে সাজানো, হলুদ কোটা এবং বাটার গান, ভাত কাপড়ের গান, পাশা খেলার গান, বধূবরণের গান, কন্যা বিদায়ের গান প্রভৃতি। হাসির গানগুলো মজার সব বিষয় নিয়ে রচিত। পার্বণ সংগীত, মনসা পূজার গান, জন্মাষ্টমীর গান, দুর্গাপূজার গান, রামলীলা, কালীপূজা, দুর্গাপূজা, ভাইফোঁটা, শীতল পূজা প্রভৃতি। লৌকিক পৌরাণিক, বারমাস্যকে কেন্দ্র করে রচিত প্রেমসংগীত। কর্মসংগীত বলতেই কাজ করার সময় যেগুলো গাওয়া হয় তাকে বোঝায়। এগুলো শুধু লোকগানই নয় বরং বাঙালি জাতির ভিত্তিমূল। পরিপূর্ণভাবে এ জাতিকে চিনতে বা জানতে বার বার আমাদের শেকড়ের সন্ধান করতে হয়। কালের পরিক্রমায় এগুলোরই কিছু পরিমার্জন বা সংযোজন ঘটে গড়ে উঠেছে আজকের জাতিসত্তা ও ফোকলোরের উপাদান।

লোকসংগীতের মতো ফোকলোরের আরও একটি বিস্তৃত অংশজুড়ে আছে লোকনাট্য। মানুষের মধ্যে গল্পে গল্পে যে নাটক গড়ে ওঠে, তাই সাধারণত লোকনাট্য। আরও পরিষ্কার করে বলা যায়, সাধারণ মানুষের মধ্যে কথ্যরীতিতে যে নাটক গড়ে ওঠে, সেগুলোই মূলত লোকনাট্য। নাটক ও লোকনাট্যের কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তাই দুটোকে মিলিয়ে ফেললে চলবে না। লোকনাট্য সাধারণত মুক্তমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয়। এখানে সংশ্লিষ্ট সবাই অভিনয়ে অংশগ্রহণ করে। এছাড়া লোকনাট্য আঞ্চলিক ভাষায় দর্শক মহলে অভিনীত হয়। সব লোকনাট্যে একটি ভাঁড় চরিত্র থাকে, যার সাক্ষাৎ পাওয়া মাত্র সামনে উপবিষ্ট দর্শকরা হাসিতে ফেটে পড়ে। লোকনাট্যের আরও একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, এগুলো একান্তভাবে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় চিত্রায়িত হয়। লোকনাট্যের নির্দিষ্ট কোনো রচিয়তার পরিচয় মেলে না। এগুলো অঙ্ক বা দৃশ্যে বিভক্ত নয়। কুশীলবরা অতি সাধারণ পোশাক, যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে এগুলোর চিত্রায়ণ করেন। রাম-সীতা, অর্জুন-  দ্রৌপদী, রাধা-কৃষ্ণ, নিমাই-সন্ন্যাস, বেহুলা-লখিন্দর, ঈসা খাঁ, দেওয়ান, ফিরোজ দেওয়ান, সখিনা-কাসেম প্রভৃতি পৌরাণিক, ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও লৌকিক কহিনির বিষয় নিয়ে রচিত ও পরিবেশিত হয় লোকনাট্য। এর দুটি অংশ থাকে। একটি প্রস্তুতিপর্ব, অন্যটি মূলপর্ব। লোকনাট্য যে সব বিষয় নিয়ে রচিত, তার সবই প্রায় বাঙালির আবহমান সংস্কৃতির অংশবিশেষ।

ফোকলোরের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা লোককাহিনি। সাধারণ মানুষের মুখে মুখে রচিত হয়ে বংশপরম্পরায় প্রবহমান থাকে। লোককাহিনির প্রতিশব্দ হিসেবে ইংরেজি Folktales-কে নির্দেশ করা হয়। বাংলায় একে রূপকথা বা পরী কাহিনি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। লোককাহিনিগুলো পরী, রাক্ষস খোক্কস, রাজপুত্র, রাজকন্যার উদ্ধার ও বিবাহ, ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতা, দৈব সাহায্য ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। জার্মান ভাষায় এরূপ কাহিনিকে Marchen নামে অভিহিত করা হয়েছে। বাংলায় দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের সম্পাদিত ঠাকুরমার ঝুলি, ঠাকুরদাদার ঝুলি, ঠানদিদির থলে প্রভৃতি এই গল্পের সংকলন। যেসব গল্পে জীবজন্তুকে প্রধান করে উপদেশ বা নীতিকথা প্রচারিত হয়েছে সেগুলিকে ইংরেজিতে Fable বলা হয়। ইংরেজি ঈশপের গল্প, সংস্কৃত পঞ্চতন্ত্র ও হিতোপদেশ এরূপ নীতিকথার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ইংরেজিতে যাকে Anecdote বলা হয়। Fable এসকল নীতিকথা থেকে মানুষ বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষালাভ করতে পারে এজন্য একে উপদেশকথাও বলা যেতে পারে। গ্রিক সাহিত্যে Hercules, Prometheus, আরব্য উপন্যাসের সিন্দাবাদ প্রভৃতি বীর চরিত্রের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। বাংলায় যাকে বীরকথা বলা হয়। আর একপ্রকার লোককাহিনি সমাজে প্রচলিত আছে যেগুলো বুদ্ধি পরীক্ষার জন্য। এগুলোকে বাংলায় ধাঁধামূলক গল্প বলা হয় এবং ইংরেজিতে Enigma বলা হয়। নতুন বর-কনে, রাজসভায় বুদ্ধি পরীক্ষার জন্য এগুলো রচিত হতো। এধরনের একটি অতি সুপরিচিত চরিত্র গোপাল ভাঁড়। যার অসাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল শিশু- কিশোর এমনকি বড়দেরকেও আকৃষ্ট করে। আমাদের সমাজের টুকরো টুকরো নানান উপাদানের সমন্বয়ে ফোকলোরের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়েছে। জীবনযাত্রার সঙ্গে এগুলো মিশে আছে ওতোপ্রোতোভাবে। বাঙালির আবহমান ইতিহাস ঐতিহ্যের সমন্বিত রূপ এই লোককাহিনিগুলো।

Advertisement

লোককাহিনির মতো আরও একটি সমৃদ্ধ শাখা লোকগাথা। ইংরেজিতে একে Ballad বলে। শব্দটি ফরাসি Ballet থেকে গৃহীত। যার অর্থ নৃত্য। একটি বিশেষ কাহিনি সুদৃঢ়ভাবে এতে স্থান করে নেয় বলে একে কাহিনি প্রধান রচনাও বলা চলে। ক্রিয়া বা Action এ সব গীতিকার প্রধান উপজীব্য। কাহিনির মাধ্যমেই গাথাগুলোর রস পাঠক বা শ্রোতার কাছে ফুঠে ওঠে। নাথগীতিকা, ময়মনসিংহ গীতিকা এবং পূর্ববঙ্গ গীতিকা বাংলাদেশ থেকে সংগৃহীত গীতিকাগুলো মূলত এ ক’ভাগে বিভক্ত। শতাব্দীর পর শতাব্দী খেটে খাওয়া মানুষের মুখ থেকে মুখে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এগুলো টিকে আছে। গ্রামকে নিয়েই যেহেতু আমাদের অস্তিত্ব তাই পল্লি জীবনের সঙ্গে মিশে থাকা এসব উপাদান ফোকলোরের শেকড়ের সন্ধান দেয়। আমরা খুঁজে পাই বাংলা ও বাঙালির আবহমান ঐতিহ্য।

লোকসংস্কৃতির শেকড় থেকেই আবহমান জনসংস্কৃতির অংশ গড়ে উঠেছে। লোকসংস্কৃতিতে আবহমান মানুষের সমষ্টিগত মনের ছাপ বিদ্যমান। মানুষ যা কিছু উত্তরাধিকার-সূত্রে লাভ করে তাই লোকসংস্কৃতি। গ্রহণ ও বর্জনের মাধ্যমে লোকসংস্কৃতি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে। বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে যে সংমিশ্রণ পরিলক্ষিত হয় সবই ফোকলোরের অংশ। সংস্কৃতি সম্পর্কে ড. ওয়াকিল আহমদ বলেন, ‘জীবন ছাড়া সংস্কৃতির বিকাশ নেই। এ জীবন অচল, অবাক, অক্ষম হলে চলে না, সজীব, সবাক ও সক্ষম হওয়া আবশ্যক। প্রাণহীন জড় প্রকৃতির সংস্কৃতি নেই, প্রাণী হয়েও অচল, অবাক উদ্ভিদের সংস্কৃতি নেই।... মোট কথা সংস্কৃতি জীবনসম্পৃক্ত, বস্তু সংলগ্ন এবং মানস ফসল। সংস্কৃতি একাধারে জীবনযাত্রার নিয়ম-পদ্ধতি, যথা: আচার-ব্যবহার, রীতিনীতি, উৎসব-অনুষ্ঠান, ধর্মকর্ম, প্রাত্যহিক ক্রিয়াকলাপ, শিক্ষাদীক্ষা, খেলাধূলা, আমোদ-প্রমোদ প্রভৃতি ;  অন্যদিকে জীবনযাপনের যাবতীয় বস্তু ও উপকরণ, তথা-ঘরবাড়ি, খাদ্যদ্রব্য, আসবাবপত্র, যানবাহন, যন্ত্রপাতি, বস্ত্র, অলংকার ইত্যাদি। তৃতীয়ত মানসফসল যথা সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা, মূর্তি, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, দর্শন, বিজ্ঞান প্রভৃতি। এসব কিছুর সমন্বয় হলো সংস্কৃতির সাধারণ পরিচয়।’১১ 

ফোকলোরের আরও একটি বিশেষ অংশ লোকশিল্প। এটি মূলত চারু ও কারুশিল্প নির্ভর। কামার-কুমার, কাঁসারি, তাঁতি, ঘরামি, গৃহশিল্প, আল্পনা, দেওয়াল চিত্র, মুখোশ, বাঁশ-বেত শিল্প, ডালা, কুলা, পাটি, নকশীকাঁথা, নকশী পাখা, সোনা-রুপার বিভিন্ন অলংকার, পিঠা-পুলি, মাটির পুতুল এবং বিভিন্ন এলাকার বিখ্যাত জিনিসপত্র সবই লোকশিল্পের অন্তর্গত। আর এগুলো বৃহত্তর অর্থে সবই ফোকলোরের অংশ। লোকশিল্পের মতো লোকবিজ্ঞানও ফোকলোরের বিশেষ অংশজুড়ে আছে। যার মধ্যে বাঙালির আদিমযুগ থেকে সভ্যতার আলোয় আসার পথে সব লোক বিজ্ঞানসম্পৃক্ত। গুহাবাসী মানুষ একসময় ছালবাকল পরে লজ্জা নিবারণ করতো। পাথরে পাথর ঘর্ষণের ফলে যে বিজ্ঞানের সূচনা তা আজও অব্যাহত তবে কালের পরিক্রমায় তার ব্যাপক পরিবর্তন সাধন হয়েছে। গ্রামীণ জীবনে যে সব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হতো সবই লোকবিজ্ঞানের অংশ। লাঙল, মই, কোদাল, জোয়াল, গোখাদ্য সংরক্ষণের ভাঁড়া, বিভিন্ন রকম জাতা, হামানদিস্তা, ঘানি, বিভিন্ন ধরনের চুলা, গ্রামীণ চিকিৎসা সবই লোকবিজ্ঞান। বাংলা সাহিত্যের একটি বলিষ্ঠ অংশজুড়ে আছে ফোকলোর। যদিও বাংলাদেশে ফোকলোরের চর্চা বেশি দিনের নয়। উনিশ শতকের শেষের দিকে এবং বিশ শতকের শুরুতে ফোকলোর সংগ্রহ ও সম্পদনায় মনোনিবেশ করেন পণ্ডিতগণ।

পাঁচ.

মানুষের মুখে মুখে প্রবহমান নদীর স্রোতের মতো ভেসে চলেছে ফোকলোরের নানামুখী উপাদান। ফোকলোর বাঙালির পরিচয়কে সুস্পষ্ট করে তুলেছে। এর সঙ্গে আমাদের নাড়ির সম্পর্ক। মা যেমন সন্তানকে ভুলতে পারে না ঠিক তেমনি ফোকলোরের অস্তিত্ব প্রত্যাখ্যান করলে বাঙালি জাতিসত্তাকেই অস্বীকার করা হয়। ছড়া, প্রবাদ-প্রবচন, ধাঁধা, লোকনাট্য, লোকসংগীত, লোকগীতিকা, লোককাহিনি প্রভৃতির সংমিশ্রণে একক সত্তা হিসেবে রূপলাভ করেছে ফোকলোর। ফোকলোর বাঙালি জীবনাচরণের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। এগুলো বাঙালির চিরায়ত সম্পদ। গ্রামকে কেন্দ্র করেই আমাদের সভ্যতা গড়ে উঠেছে। পল্লিজনের সঙ্গে মিশে থাকা লোকাচার, লোকবিশ্বাস, লোকবিজ্ঞান, লোকসংস্কৃতিই বাঙালির অস্তিত্ব। নগরজীবনের আড়লে যতই এগুলো চাপা পড়ে থাক। তবু শেকড়ের টান আমরা অনুভব করি প্রতিনিয়ত। সেদিক থেকে ফোকলোর মূলত বাংলা ও বাঙালির শেকড়ের আত্ম-অনুসন্ধান ও কালের বিবর্তনে তার রূপভেদ।

গ্রন্থপঞ্জি১. আশুতোষ ভট্টাচার্য, বাংলার লোকসাহিত্য, ৩য় সং, ১৯৬২, ক্যালকাটা বুক হাউস, কলিকাতা, পৃ. ৫-৬  ২. Alan Dundes, Floklore as a mirror of culture, National Council of teachers of english, 1996, p.471৩. মযহারুল ইসলাম, ফোকলোর পরিচিত ও পঠন- পাঠন, অবসর, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ৮-১১            ৪.আশুতোষ ভট্টাচার্য, বাংলার লোকসাহিত্য দ্বিতীয় খণ্ড: ছড়া, ক্যালকাটা বুক হাউস, কলিকাতা, ১৯৬২, পৃ. ০১   ৫. তদেব, পৃ. ৭৯             ৬. তদেব, পৃ. ৮৩            ৭. আশুতোষ ভট্টাচার্য , বাংলার লোকসাহিত্য পঞ্চম খণ্ড: ধাঁধা, ক্যালকাটা বুক হাউস, কলিকাতা, ১৯৬৬, পৃ. ০৪ ৮. তদেব, বাংলার লোকসাহিত্য ষষ্ঠ খণ্ড : প্রবাদ, ক্যালকাটা বুক হাউস, কলিকাতা, ১৯৭২, পৃ. ১-২৯. তদেব, বাংলার লোকসাহিত্য তৃতীয় খণ্ড : গীত ও নৃত্য, ক্যালকাটা বুক হাউস, কলিকাতা, ১৯৫৪, পৃ. ০৪১০. তদেব, পৃ.৬৯১১. ড. ওয়াকিল আহমদ, বাংলার লোক- সংস্কৃতি, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৬৫, পৃ. ২-৩ 

এসইউ/জিকেএস