আন্তর্জাতিক

সারের দামে লাগাম নেই কেন?

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের শুরু করা যুদ্ধ ইউক্রেনে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ আনার পাশাপাশি বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে ক্ষুধার ঝুঁকিতে ফেলেছে। বিশ্বব্যাপী গম বাণিজ্যের ২৮ শতাংশ সরবরাহ করে রাশিয়া ও ইউক্রেন। বার্লির ক্ষেত্রে এর হার ২৯ শতাংশ, ভুট্টায় ১৫ শতাংশ ও সূর্যমুখী তেলে ৭৫ শতাংশ। যুদ্ধের জেরে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং ইউক্রেনের বন্দর অবরোধের কারণে এসব পণ্য কৃষ্ণসাগর অঞ্চল থেকে বেরোনো প্রায় বন্ধ। একই সময় সারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে অন্য অঞ্চলের কৃষকরাও ঘাটতি মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। কিন্তু সার হঠাৎ এত ব্যয়বহুল হয়ে উঠলো কেন?

Advertisement

সবুজ বিপ্লবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে সার। গত ছয় দশকে বেশিরভাগ দরিদ্র দেশে কৃষি উৎপাদন বেড়েছে। গবেষণা সংস্থা অক্সফোর্ড অ্যানালিটিকার তথ্যমতে, ১৯৬০ সালে সারবিহীন ফসল বিশ্বের ৮৭ শতাংশ মানুষের খাদ্য চাহিদা মেটাতো। ২০১৫ সালে এর হার ৫২ শতাংশে নেমে গেছে।

প্রধানত তিন ধরনের সার রয়েছে: নাইট্রোজেন-ভিত্তিক (যার মধ্যে একমাত্র ব্যয়বহুল উপাদান প্রাকৃতিক গ্যাস), পটাশ (যা পটাসিয়াম সরবরাহ করে) এবং ফসফেট।

বেশ কয়েকটি কারণে ২০২১ সালে সারের দাম অনেকটা বেড়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো করোনাভাইরাস মহামারির প্রভাবে জ্বালানি ও পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়া। তাছাড়া ইউরোপের অভিবাসী সংকটে প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বেলারুশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। বিশ্বের প্রায় ১৮ শতাংশ পটাশ উৎপাদন করে রাশিয়াপন্থি এই দেশটি। ফলে বেলারুশের ওপর নিষেধাজ্ঞায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।

Advertisement

তবে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশটির ওপর পশ্চিমারা যেসব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তাতে সারের দাম আকাশ ছোঁয়। ২০২১ সালে বিশ্বের অন্তত ২৫টি দেশ তাদের ৩০ শতাংশের বেশি সার সংগ্রহ করেছিল রাশিয়া থেকে। পূর্ব ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ার অনেক দেশের ক্ষেত্রে এর হার ৫০ শতাংশের ওপর।

সাম্প্রতিক জ্বালানি নিরাপত্তার দুশ্চিন্তায় নাইট্রোজেন-ভিত্তিক সার উৎপাদনে যেতে পারছে না ইউরোপ। আর নাইজেরিয়া ও কাতারের মতো প্রাকৃতিক গ্যাসের অভাব না থাকা দেশগুলোতে নতুন কারখানা চালু এবং কানাডার পটাশ উৎপাদন বাড়ানোও যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ফলে অদূর ভবিষ্যতে সারের দাম চড়া থাকারই আশঙ্কা বেশি।

সেটি হলে কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কৃষকরা কম সার ব্যবহারে বাধ্য হবেন, তাতে উৎপাদন এবং ফসলের মান কমে যাবে। বিকল্প হিসেবে কৃষকরা কম সার প্রয়োজন এমন ফসল চাষে আগ্রহী হবেন, যেমন- সয়াবিন। এর ফলে গম-ভুট্টার মতো ফসলের উৎপাদন আরও কমে যাবে।

প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধরনের রাসায়নিক সারের ব্যবহার কি কমানো সম্ভব? বর্ণালীবীক্ষণের (স্পেকট্রোস্কোপি) মতো আধুনিক কৃষি প্রযুক্তিগুলো মাটিতে পুষ্টির মাত্রা নির্ভুলভাবে পরিমাপ করতে পারে, যার ফলে আরও সুনির্দিষ্টভাবে সার ব্যবহারের সুযোগ পাওয়া যায়। তবে এসব প্রযুক্তি খুবই ব্যয়বহুল। তাই দরিদ্র দেশগুলোতে এর মাধ্যমে কৃষকদের উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা কম।

Advertisement

তবে সেসব ক্ষেত্রে নিম্নমানের কৃষিপ্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করা যায়। যেমন- মাটির গুণমান বজায় রাখা, চক্রাকারে ফসল চাষ বা ‘বনকৃষি’ (গাছের মধ্যে ফসল চাষ)। তবে এসব পদ্ধতিতে অনেক সময়, প্রচেষ্টা ও দূরদর্শিতার প্রয়োজন হয় এবং সেগুলো আধুনিক সারের মতো দ্রুত বা অতটা কার্যকর নয়।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কা সম্প্রতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, রাসায়নিক সার ছাড়া কৃষি উৎপাদন কতটা কঠিন। ২০২১ সালে শ্রীলঙ্কাকে বিশ্বের প্রথম শতভাগ জৈব খাদ্য উৎপাদক হিসেবে গড়ে তুলতে তাড়াহুড়ো করে রাসায়নিক সার আমদানি নিষিদ্ধ করে লঙ্কান সরকার। ফলশ্রুতিতে দ্রুত ফসল উৎপাদন কমে যায়, খাদ্যের দাম বেড়ে যায় এবং তার জেরে দেশব্যাপী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন লঙ্কান প্রেসিডেন্ট। ঘটনাক্রমে সেই নিষেধাজ্ঞা পরে প্রত্যাহার করা হয়। তবে এর মধ্যে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ থেকে রীতিমতো ভয়াবহ হয়ে ওঠে।

আপাতত পৃথিবীতে খাদ্য উৎপাদনের বর্তমান মাত্রায় বজায় রাখতে রাসায়নিক সারের সহজ কোনো বিকল্প নেই। যার অর্থ- খাদ্যের বাড়তি দাম এবং অগণিত মানুষের পেটে ক্ষুধা থাকছেই।

সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট

কেএএ/জেআইএম