মতামত

দেশে আসলে হচ্ছেটা কী?

সাংবাদিকদের যেমন আজকাল অনেক মানুষ অপছন্দ করেন, তেমনি কিছু মানুষ কিছু সাংবাদিককে পছন্দও করেন। ভালোমন্দ সব পেশায়ই আছে। সাংবাদিকদের মধ্যেও কিছু খারাপ সাংবাদিক নেই তেমন দাবি আমি করবো না। তবে সাংবাদিকদের ঢালাওভাবে দোষারোপের আগে এই পেশা বেছে নিয়ে আমাদের দেশে এখনও নিশ্চিন্তে জীবন কাটানোর অবস্থা কেন হয়নি, তার তত্ত্ব-তালাশ করা জরুরি। দেশে গণমাধ্যমের সংখ্যা বেড়েছে। বেড়েছে সাংবাদিকের সংখ্যাও। কিন্তু অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে চাকরির নিশ্চয়তা নেই, নেই নিয়মিত বেতন-ভাতার ব্যবস্থা। কিছু সাংবাদিক হয়তো ভালো জীবনযাপন করতে পারেন, কিন্তু বেশিরভাগই পারেন না।

Advertisement

বেঁচে থাকার তাগিদে তাই কেউ কেউ পথভ্রষ্ট হন। আমাদের দেশে একজন ভালো মানুষকে খারাপ পথে টানার অনেক ব্যবস্থা আছে, কিন্তু একজন খারাপ মানুষকে ভালো করার উপায় আছে বলে মনে হয় না। আমার আজকের লেখার বিষয় সাংবাদিকতা পেশার ভালো খারাপ নিয়ে নয়। আমি বরং এখনো যে কিছু মানুষের সাংবাদিকদের ওপর আস্থা-বিশ্বাস আছে তার দু-একটি নমুনা দিয়ে দু’কথা লিখতে চাই।

দুই. ২০ মে ছিল চুকনগর গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের ওই দিন খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার ভদ্রা নদীর তীরে সংঘটিত হয়েছিল বীভৎস হত্যাকাণ্ড, ঘটিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকেই পাকিস্তানি বাহিনী শুরু করেছিল নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ। তারা ভেবেছিল ব্যাপকভাবে নিধনযজ্ঞ শুরু হলে বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্ন ভেঙে খানখান হয়ে যাবে। কিন্তু হয়েছে উল্টোটা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে বাঙালি স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার জন্য মুক্তিযুদ্ধে শামিল হয়। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। সেজন্য মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে নিরস্ত্র বাঙালি প্রতিরোধ যুদ্ধে নামলেও সবাই তো আর যোদ্ধা হতে পারে না! কামান বন্দুকের গুলির মুখে প্রাণভয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজা ভিটেমাটি ছেড়ে লাখ লাখ বাঙালি রাস্তায় বেরিয়েছিল।

দেশের ভেতরে আসলে নিরাপদ জায়গা কম ছিল। তাই অনেকেই ছুটছিল সীমান্তের দিকে, সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয়ের আশায়। এপ্রিলের শুরু থেকেই চলছিল এই সীমান্ত অতিক্রম। মে মাসের মধ্যভাগে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের হিন্দু প্রধান এলাকাগুলো থেকে হাজার হাজার মানুষ ত্যাগ করেছিলেন। তেমনি কয়েক হাজার, কেউ মনে করেন, লক্ষাধিক নারী-পুরুষ-শিশু ১৯ মে সমবেত হয়েছিলেন ডুমুরিয়ার ভদ্রা নদীর তীরে, ছোট্ট একটি গ্রাম চুকনগরে। রাতটি কাটিয়ে সকালে তারা যাত্রা শুরু করবেন সীমান্তের দিকে।

Advertisement

২০ মে সকালেই এই মানুষদের ওপর আক্রমণ শুরু করে পাকিস্তানি বাহিনী। হয়তো স্থানীয় কোনো দালাল পাকিদের খবর দিয়েছিল। প্রায় ৫-৬ ঘণ্টা নির্বিচার গুলি চালিয়ে অগণিত মানুষের লাশের স্তূপ করে চলে গিয়েছিল পাকিস্তানি হার্মাদেরা। ভদ্রা নদীর পানি সেদিন সত্যি সত্যি রক্তে লাল হয়েছিল। কত মানুষকে একদিনে এক জায়গায় হত্যা করা হয়েছিল?

একবারে কম হিসাব যারা বলেন তারাও এই সংখ্যা সাড়ে চার হাজারের কম বলতে পারেন না। তবে হানাদারদের চলে যাওয়ার পর যারা ওই লাশের স্তূপ দেখেছিলেন কিংবা যারা লাশগুলো নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছেন, তারা মনে করেন ১০-১২ হাজারের কম হবে না সেই সংখ্যা। পৃথিবীর আর কোথাও এত অল্প সময়ে একস্থানে এত মানুষ হত্যার নজির নেই। এটা ছিল আসলে একটি জেনোসাইড, একটি জাতিগোষ্ঠীকে নির্মূল করার পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ। কিন্তু দুঃখের বিষয় স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও এই জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের কোনো উদ্যোগ সেভাবে নেওয়া হয়নি।

এ বছর সাবেক ছাত্র ও যুব নেতা মাহবুব জামান ও মুহম্মদ হিলালউদ্দিনের নেতৃত্বে ‘আমরা একাত্তর’ নামের একটি সংগঠন চুকনগর জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। ওই কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার জন্য আমিও এবার চুকনগর গিয়েছিলাম। ঢাকা থেকে যেমন কয়েকজন গিয়েছিলেন, তেমনি খুলনা যশোর থেকেও এসেছিলেন অনেকে। স্থানীয় লোকজন তো অবশ্যই ছিলেন।

৩.চুকনগরে একদিন ছিলাম। একদিন মানে ১২ ঘণ্টা, সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা। এই সময়ে ওই এলাকার বেশকিছু সাধারণ মানুষের সঙ্গে যেমন কথা হয়েছে, তেমনি অন্য পেশার মানুষ, কলেজ শিক্ষক, সাংস্কৃতিক কর্মী এবং অবশ্যই গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গেও কথা বলার সুযোগ হয়েছে। সকালে আমাদের কর্মসূচি শুরু হয় সকাল ১০টায় চুকনগরের শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর মাধ্যমে। এরপর বেলা ১১টায় ভদ্রা নদীতে হাজার হাজার ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে হাজার হাজার মানুষের রক্তদানের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। বিকেলে ছিল আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। দুপুরে খাওয়ার বিরতি ও অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে কথা হয় অনেকের সঙ্গে। সেসব কথা নিয়েই এখন আমার কথা।

Advertisement

একটি বিষয় লক্ষ করেছি, আমি ঢাকা থেকে গিয়েছি এবং সাংবাদিকতা করি জেনে অনেকেই আমার কাছে ‘ভেতরের খবর' জানতে চেয়েছেন। দু-একজন এমনও বলেছেন, আপনারা সাংবাদিকরা সব জানেন। আমি বিনয়ের সঙ্গে বলেছি, আসলে সবাই তো আর সব কিছু জানেন না, সেটা জানা সম্ভবও নয়। সাংবাদিকরা খবর তৈরি করেন না, খবর তৈরি হলে তা পরিবেশন করেন।

একজন আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, বুঝেছি, আপনি বলতে চান না কিছু। ভয়ে আছেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বাধা পড়ার। যিনি এটা বললেন, তার দিকে তাকিয়ে তাকে কোনো কেউকেটা ধরনের নয়, একজন সাধারণ মানুষ বলেই মনে হলো। তাহলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বিষয়টি দূরগ্রামেও পৌঁছেছে।

এই বিষয়ে না গিয়ে হঠাৎ একজন অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক বললেন, আপনার লেখা আমি অনেকদিন থেকেই পড়ি। কিন্তু যায়যায়দিনে আপনি যেমন কড়াভাবে লিখতেন, এখন তেমন লেখেন না কেন? আমি বলি, তখনকার পরিস্থিতি আর এখনকার পরিস্থিতি এক নয় বলে! তিনি পাল্টা জানতে চান, পরিস্থিতির কী বদল হয়েছে? আমি বলি, তখন ক্ষমতায় ছিল সামরিক স্বৈরাচারী শাসক। দেশের সব রাজনৈতিক দল এবং সাধারণ মানুষ মোটামুটি এক হয়ে এরশাদের বিরোধিতা করেছে। এখন... আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে আরেকজন বলেন, এখন কি দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? এখন কি অনেকেই সরকারের বিরোধিতা করছে না?

আমি একটু হকচকিয়ে যাই না তা নয়, তবে সামলে নিয়ে বলি, কিছু সমস্যা থাকলেও দেশে এখন স্বৈরাচারী শাসক ক্ষমতায় আছে বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না। নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক থাকলেও নির্বাচন প্রক্রিয়ার বাইরে এই সরকার ক্ষমতায় আসেনি। সরকারের বিরুদ্ধে যেমন দল ও মানুষ আছে, তেমনি সরকারের পক্ষেও আছে।

তাছাড়া আমি শেখ হাসিনার চেয়ে ভালো শাসন উপহার দেওয়ার মতো কোনো রাজনৈতিক নেতা দেখি না। শেখ হাসিনা যে বলেছেন, তাকে ছাড়া তার দলের অনেককেই কেনা যায়, এটাও আমি ঠিক মনে করি। আমাদের দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতা নিজেদের কেনাবেচার পণ্যে পরিণত করেছেন বলেও আমি মোটা দাগে বিশ্বাস করি।

আমার কথা শেষ না হতেই যশোরের একজন সাংস্কৃতিক কর্মী বললেন, এই যে শেখ হাসিনানির্ভরতা এটা কি ভালো কিছু? একজন মানুষের ওপর নির্ভর করার ফল ভালো হয় না! আমি বিষয় পরিবর্তন করার জন্য এবার পাল্টা জানতে চাই, আপনারা আপনাদের এলাকার কথা কিছু বলেন। এখানে আওয়ামী লীগের অবস্থা কি? দু-তিনজন একযোগে বলে উঠলেন, আমাদের এখানে আওয়ামী লীগ নেই, আছে নারায়ণ লীগ। আমাকে সন্দেহের চোখে তাকাতে দেখে একজন বললেন, আওয়ামী লীগ বলতে এখানে চলছে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দের একক রাজত্ব। উপজেলা নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল প্রার্থী হেরেছেন নারায়ণ চন্দের পছন্দের প্রার্থীর কাছে বেশিরভাগ উপজেলায়।

আগামী নির্বাচনে কী হবে? আমার এই প্রশ্নের জবাব দিতে সঙ্গে সঙ্গে কেউ মুখ খুললেন না। একজনের দিকে তাকিয়ে আমি জানতে চাই বিরোধী কোন দল এখানে প্রবল? তিনি কি একটু ভেবে বললেন, কোনো দলেরই তেমন তৎপরতা চোখে পড়ে না। তবে সবাই বলাবলি করে, ভোট নিরপেক্ষ হলে আওয়ামী লীগ সারাদেশে ১০-১৫টির বেশি সিট পাবে না। সবাই বলে? আমি জানতে চাই। হ্যাঁ, একজন বললেন, আপনি একা একজনকে জিজ্ঞেস করেন, দেখবেন, তিনি এই কথা বলবেন। একটি কথা চাউর হয়ে গেছে যে শেখ হাসিনা দেশটাকে শেষ করে দিয়েছেন। আমি জানতে চাই, আপনিও কি মনে করেন, শেখ হাসিনা দেশটাকে শেষ করে দিয়েছেন?

তিনি চুপ থাকেন। অন্য আরেকজন মুখ খোলেন, আমাদের এই এলাকাটা হিন্দুপ্রধান। এখানেই যখন আওয়ামী লীগবিরোধী সংগঠিত অপ্রচারের জবাব আওয়ামী লীগ দিতে পারে না, তখন অন্য এলাকায় কি হয় বা হচ্ছে তা বুঝতে কি খুব কষ্ট হয়?

আমাদের অনুষ্ঠান শুরুর কথা মাইকে ঘোষণা হয়। সবাই উসখুস করতে থাকেন। একজন উঠতে উঠতে বলেন, আপনাকে কাছে পেয়ে জানতে চাইছিলাম, দেশে আসলে হচ্ছেটা কী? কিন্তু আপনি তো ভেতরের কথা কিছুই বললেন না।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/ফারুক/জেআইএম