‘ক্যাম্পাস মাদক সেবন ও বেচা-কেনার জন্য উত্তম স্থান। কারণ এখানে পুলিশ বা গোয়েন্দাদের তেমন কোনো ঝামেলা নেই।’ বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই কথাটি বললেন এক মাদকসেবী। তিনি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত একজন শিক্ষার্থী।
Advertisement
তিনি বলেন, ‘আমাদের যখন মাদক সেবনের প্রয়োজন হয়, আমরা ডিলারকে কল করি। তিনি ক্যাম্পাসে এসে দিয়ে যান। তবে তার সঙ্গে খুব সীমিত সংখ্যক মানুষের যোগাযোগ হয়। সবার কল তিনি রিসিভ করেন না।’
মাদকের ভয়াবহ ছোবলের বিষয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা হয় বেশ কয়েকজন মাদকসেবীর। তারা জানান, ‘শুধু ছাত্ররাই নয়। বেশ কয়েকজন ছাত্রী, শিক্ষক, কর্মচারীরাও মাদক সেবনের সঙ্গে জড়িত। গাঁজা কিংবা ইয়াবাতো মামুলি ব্যাপার। নাম না জানা আরো বিভিন্ন ধরনের মাদকের ব্যবহার করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেক হোল্ডাররা। এর মধ্যে রয়েছে স্ন্যাক শট, ওয়াইন, এলএসডিসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গভীর রাতে বঙ্গবন্ধু হলের সামনের পুকুর পাড়, মাঠের বিভিন্ন স্থান, হলের বিভিন্ন কক্ষ, ছাদ, ইবি লেক সংলগ্ন এলাকাসহ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে মাদক সেবনের আড্ডা চলে বলে জানা গেছে। চারদিকে মাদকের সয়লাবে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে যাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। মাদকে জড়িয়ে কেউ কেউ মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছেন আবার কেউ মাত্রাতিরিক্ত নেশা করে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে থাকছেন।
Advertisement
২৩ মে হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের এক শিক্ষার্থী মধ্যরাতে মাত্রাতিরিক্ত নেশা জাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করায় মাঠেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। পরে তার পরিবারকে বিষয়টি জানিয়ে চিঠি দেয় প্রশাসন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী বলছেন, মাদকাসক্তদের বড় একটি অংশ মাদকের টাকা জোগাড় করতে বিভিন্ন ধরনের অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের ভয়ে রাতের ক্যাম্পাসে ঘুরতে ভয় লাগে, যদি ছিনতাইয়ের শিকার হই।
এমনকি এক শিক্ষার্থী অভিযোগ করেন, ভাতের টাকা বাঁচিয়ে মাদকদ্রব্য গ্রহণ করেন মাদকসেবীরা।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, এসব বিষয়ে প্রশাসনের পদক্ষেপ যথাযথ নয়। ক্যাম্পাসে মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে তাদের অনীহা পরিলক্ষিত হয়। এমনকি কিছু শিক্ষকও রয়েছেন যারা মাদকাসক্ত। এমতাবস্থায় প্রশাসনের উচিত, মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান পরিচালনা করা।
Advertisement
অনুসন্ধানে জানা যায়, মাদকাসক্তদের একটি বড় অংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন শিক্ষার্থী। ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের বিভিন্ন নেতা কর্মীও জড়িত এসব কার্যক্রমের সঙ্গে। স্থানীয় কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ী এসব ছাত্রদের টার্গেট করে তাদের হাতে মাদক ছড়িয়ে দেন। মূলত তারাই বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থীও প্রত্যক্ষভাবে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। মাদকসেবীদের কাছে মাদকদ্রব্য পৌঁছে দেন তারা।
বেশ কয়েকজন মাদকসেবীর তথ্য মতে, মাদক ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের অধিকাংশ সদস্য ক্যাম্পাস পার্শ্ববর্তী শেখপাড়া বাজার, কুষ্টিয়া, হরিনারায়ণপুর, পদমদি, শৈলকূপাসহ ক্যাম্পাসের আশপাশে থাকেন। প্রয়োজনমতো তারা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিভিন্ন বেশ ধরে প্রবেশ করে মাদক পৌঁছে দেন। মাদক ব্যবসায়ীরা শুধু চিহ্নিত মাদকসেবীদের কাছেই মাদকদ্রব্য বিক্রি করেন। অপরিচিত কোনো ব্যক্তির কাছে তারা সহজে মাদক বিক্রি করেন না। তাদের সঙ্গে মাদকসেবীদের রয়েছে আলাদা সখ্যতা।
গত জানুয়ারিতে ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগের এক শিক্ষার্থীকে মাত্রাতিরিক্ত মাদক সেবনের ফলে আটক করে প্রক্টরিয়াল বডি। এরপর তাকে ঠাকুরগাঁওয়ের ‘পুনর্জন্ম মাদকাসক্তি চিকিৎসাসেবা ও পরামর্শ কেন্দ্রে’ পাঠানো হয়। কিন্তু ঈদের ছুটির পর ক্যাম্পাস খুললে তিনি আবার ক্যাম্পাসে ফিরে মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।
২৫ মে রাত ১০টায় আবারও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন ওই শিক্ষার্থী। পরে প্রক্টরিয়াল বডি তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে ভর্তি করে। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাকে আবারও পুনর্জন্ম মাদকসক্তি চিকিৎসাসেবা ও পরামর্শ কেন্দ্রে পাঠানো হয়।
ওই শিক্ষার্থী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে থাকতেন। হলটির আন্তর্জাতিক ব্লকসহ গণরুমগুলো মাদক সেবনের আখড়া বলে পরিচিত।
হলের প্রাধ্যাক্ষ অধ্যাপক ড. মাহবুবুল আরফিন জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। প্রচুর শিক্ষার্থীরা ড্রাগ নিচ্ছে। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। এগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য আমরা কিছু পরিকল্পনা করছি।
এ বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালাম বলেন, শিক্ষার্থীরা যদি সচেতন না হয়, কঠোর পদক্ষেপ নিয়েও মাদক বন্ধ করা কঠিন। আমরা চেষ্টা করছি বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে মাদকবিরোধী আন্দোলন তৈরি করার।
এফএ/জেআইএম