মতামত

উত্তম আচরণ ও সম্প্রীতি ইসলামের শিক্ষা

প্রতিটি ধর্মই উত্তম আচরণ এবং সম্প্রীতির শিক্ষা দেয়। মারামারি, হত্যা, নৈরাজ্য যেন দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। বিবেকের যেন আজ মৃত্যু ঘটেছে। আল্লাহপাকের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলো মানুষ। এই শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিকেও নির্মমভাবে হত্যা করতে বিপথগামীরা আজ দ্বিধা করছে না। সমাজ ও দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কোন শিক্ষা ইসলামে নেই।

Advertisement

ইসলাম এমন এক শান্তিপ্রিয় ধর্ম যেখানে আত্মীয়স্বজন, পরিচিত-অপরিচিত, প্রতিবেশি, মুসলমান-অমুসলমান সবার সাথেই উত্তম ব্যবহার আর শান্তির শিক্ষা দেয়। একজন মানুষ সে যে ধর্মের অনুসারীই হোক না কেন তার সাথে সুন্দর ব্যবহারের শিক্ষা আমরা মহানবীর (সা.) পবিত্র জীবনার্দশ থেকেও পেয়ে থাকি। যেভাবে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যার আচার-ব্যবহার সুন্দর, সে আমার সবচেয়ে বেশি প্রিয় এবং কিয়ামতের দিন সে আমার সবচেয়ে কাছে থাকবে’ (সুনানে তিরমিজি)।

তিনি (সা.) আরো বলেছেন, ‘সুন্দর আচরণই নেক আমল’ (সহিহ মুসলিম)। তাই তো ইসলাম এমন এক ধর্ম, যা পূর্ণভাবে অনুসরণ করলে কারো মাথায় অন্যের কোনো ক্ষতির চিন্তা আসতেই পারে না। অথচ আজ কতই না এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে, ভাই ভাইকে হত্যা করছে, ছেলে পিতামাতাকে হত্যা করছে, নিষ্পাপ শিশুদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হচ্ছে, বন্ধু বন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করছে। আবার শুধু ধর্মীয় মতপার্থক্যের কারণে অন্যের ওপর অন্যায় আক্রমণের ঘটনাও ঘটে। অথচ আল্লাহপাকের আদেশ হচ্ছে তোমরা সবার সাথে উত্তম আচরণ এবং সদয় ব্যবহার কর।

আমরা যদি আল্লাহ ও তার রসুলের শিক্ষা অনুযায়ী নিজেদের জীবন পরিচালনা করি তাহলে সমাজ ও দেশে কোনো ধরনের অন্যায় কাজ সংঘটিত হওয়ার প্রশ্নই উঠে না। যত ধরণের অন্যায় কাজ হচ্ছে এর মূল কারণ হল আমরা পবিত্র কুরআনের শিক্ষা ভুলে বসেছি। কুরআনকে বাদ দিয়ে জাগতিকতায় মত্ত হয়েছি। যে যেভাবে পারছি বৈধ অবৈধ কোনো চিন্তা না করে সম্পদের পিছনে ছুটছি আর এ সম্পদ অর্জনে কাউকে হত্যা করতেও দ্বিধা করছি না।

Advertisement

আমরা যদি সকল প্রকার অন্যায় কাজ থেকে নিজেকে দূরে রাখি এর ফলে আমরা নিজেরা যেমন আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি লাভ করব তেমনি এর ফলে একটি সুন্দর ইসলামি সমাজ গড়ে ওঠবে। আর এমন অনুপম একটি সমাজ গঠিত হবে যেখানে স্বামীস্ত্রীর বিবাদ থাকবে না, শাশুড়ি-বউয়ের ঝগড়াও থাকবে না, ভাই-ভাইয়ের মাঝে কোনো দ্বন্দ্ব-কলহ থাকবে না, প্রতিবেশির সাথে প্রতিবেশির কোনো ঝগড়া-বিতণ্ডা থাকবে না। এক ধর্মের অনুসারীর সাথে অপর ধর্মের লোকের মাঝে রেষারেষি থাকবে না। আমরা সবাই যদি কেবলমাত্র আল্লাহতায়ালার প্রীতি ও ভালোবাসা লাভের জন্য এসব কাজ সম্পাদন করার চেষ্টা করি তাহলে সৃষ্টিকর্তাও আমাদের সাহায্য করবেন।

উত্তম আচরণের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন হয় এবং পরকালের জান্নাত নিশ্চিত হয়। যেভাবে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন মোমেনের আমলনামায় সুন্দর আচরণের চেয়ে অধিক ভারী আমল আর কিছুই হবে না। যে ব্যক্তি অশ্লীল ও কটু কথা বলে বা অশোভন আচরণ করে, তাকে মহান আল্লাহতায়ালা ঘৃণা করেন। আর যার ব্যবহার সুন্দর, সে তার ব্যবহারের কারণে নফল রোজা ও তাহাজ্জুদের সাওয়াব লাভ করবে’ (সুনানে তিরমিজি)। মহানবী (সা.) আরও বলেছেন, ‘সবচেয়ে বেশি যা মানুষকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে তা হলো, আল্লাহতায়ালার ভয় ও সুন্দর আচরণ। আর সবচেয়ে বেশি যা মানুষকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবে তা হলো (মানুষের) মুখ এবং লজ্জাস্থান’ (সুনানে তিরমিজি, হাকিম আল মুসতাদরাক)।

আসলে মুসলমানদেরকে পুনরায় বিশ্বের বুকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সমাসীন হতে হলে, পুরোনো গৌরব ফিরে পেতে হলে সবার উচিত ধনী-গরীব, জাতি, ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে সবার সঙ্গে সুন্দর আচরণ ও উত্তম ব্যবহার করা।মহানবীর (সা.) আদর্শ এতটাই অতুলনীয় ছিল যে তিনি ইহুদীর লাশকেও সম্মান দেখিয়েছেন। হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, একবার এক ইহুদীর লাশ বিশ্বনবীর (সা.) সামনে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল আর এতে মহানবী (সা.) সেই লাশের সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে ছিলেন ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না লাশটি তার সামনে থেকে চলে যায়।

পাশ থেকে হজরত জাবের (রা.) বলেছিলেন, হে আল্লাহর রাসুল! এটি তো ইহুদীর লাশ। এতে আল্লাহর রাসুল উত্তর দিয়েছিলন, সে কি মানুষ ছিল না? (সহিহ বোখারি, হাদিস নং ১৩১১)। যে নবী (সা.) এক ইহুদীর লাশকে সম্মান জানানোর জন্য তার সাথিদেরকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন সেই নবীর উম্মতের পক্ষে কিভাবে সম্ভব শুধু ধমীর্য় মতপার্থক্যের কারণে কারো ওপর অন্যায় অত্যাচার করা।

Advertisement

হজরত সুফিয়ান ইবনে সালিম (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘মনে রেখো যদি কোনো মুসলমান অমুসলিম নাগরিকের ওপর নিপীড়ন চালায়, তার অধিকার খর্ব করে, তার কোনো বস্তু জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেয়, তাহলে কিয়ামতের দিন আমি আল্লাহর আদালতে তার বিরুদ্ধে অমুসলিম নাগরিকদের পক্ষাবলম্বন করব’ (আবু দাউদ)।

আমরা যদি সেই সময়ের ঘটনা লক্ষ্য করি যখন মক্কার লোকেরা মহানবীর (সা.) কোন কথাই যখন শুনতে চাচ্ছিল না, তখন তিনি (সা.) তায়েফের দিকে দৃষ্টি দিলেন। যখন তিনি (সা.) তায়েফ পৌছলেন, তখন সেখানকার নেতৃবৃন্দ তার সাথে দেখা করার জন্য আসতে লাগলো। কিন্তু কেউই সত্য গ্রহণ করতে রাজী হলো না। সাধারণ লোকেরাও তাদের নেতাদেরই অনুসরণ করল এবং খোদার বাণীর প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করতে লাগলো।

এখানে ঘটনা সংক্ষেপ করছি, কেননা-আপনাদের সকলেরই এ ঘটনা জানা আছে। পরিশেষে তারা সব ভবঘুরে ছেলে ছোকরাদেরকে একত্রিত করলো। তারা প্রত্যেকেই ঝোলা ভর্তি পাথরের টুকরা নিল। তারা নির্মমভাবে মহানবীর (সা.) ওপর পাথর ছুঁড়তে থাকে।

অবিশ্রান্তভাবে পাথর মারতে মারতে মহানবীকে (সা.) শহর থেকে বাইরে নিয়ে গেল। শ্রেষ্ঠ রাসুলের দু’টি পা রক্তাক্ত হয়ে উঠলো। তারপরও তারা ঠান্ডা হলো না, যতক্ষণ না তিনি (সা.) শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে একটি পাহাড়ে এসে পৌঁছলেন। এই লোকগুলো যখন তার পিছু পিছু ধাওয়া করছিল, তখন তিনি এই ভয়ে ভীত হয়ে পড়েছিলেন যে, আল্লাহর গজব না আবার তাদের ওপর পড়ে। তিনি আকাশের দিকে মুখ তুলে দেখছিলেন এবং কাতর প্রাণে প্রার্থনা করছিলেন, ‘হে আল্লাহ!

তুমি এদেরকে ক্ষমা করে দাও! কেননা এরা জানে না, এরা কি করছে।’ একটু ভেবে দেখুন, আঘাতে জর্জরিত ও লোকদের তাড়া খেয়ে তার শরীরে চলার মত আর শক্তি ছিল না। এত কিছুর পরও তিনি (সা.) তাদের অভিশাপ দেননি বরং তাদের জন্য দোয়াই করেছেন।

এমনই ছিলো মানবদরদী রাসুল, শ্রেষ্ঠ রাসুল মহানবীর (সা.) আদর্শ। আমরা যদি মহানবীর (সা.) জীবনাদর্শ পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখতে পাই, তিনি কতইনা উত্তম আচরণ করেছেন অন্যান্যা ধর্মাবলম্বীদের সাথে আর একই শিক্ষা আমাদেরকে দিয়ে গেছেন। তিনি (সা.) যে দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, এরূপ দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে বিশ্বনবী ও শ্রেষ্ঠনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনাদর্শ অনুসরণ করে জীবন পরিচালনার তৌফিক দান করুন, আমিন।

এইচঅার/জিকেএস