দেশে করোনা রোগীদের চিকিৎসায় থাকা স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে ২৩ দশমিক ৫০ শতাংশ মানসিক রোগে ভুগছিলেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা ছিল চিকিৎসকদের। সরকারি একটি গবেষণায় এ তথ্য ওঠে এসেছে।
Advertisement
গবেষণা করে জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘বাংলাদেশে কোভিড-১৯ মহামারিকালে স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব, কুশলবস্থা, সংশ্লিষ্ট ফ্যাক্টরসমূহ ও মানিয়ে নেওয়ার কৌশল’।
বৃহস্পতিবার (২৬ মে) রাজধানীর মহাখালীর নিপসম মিলনায়তনে এই জরিপের ফল প্রকাশ হয়।
সেখানে বলা হয়, করোনা রোগীদের চিকিৎসায় থাকা স্বাস্থ্যকর্মীদের অনেকে পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারে (পিটিএসডি) ভুগছিলেন।
Advertisement
করোনায় মারা যাওয়া এক রোগীর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে
পিটিএসডি হলো মানসিক একটি অবস্থা। কোনো আঘাত বা দুশ্চিন্তাজনক ঘটনার সাক্ষী থাকার কারণে এটি হতে পারে। এর লক্ষণের মধ্যে রয়েছে পুরোনো কথা মনে পরা, দুঃস্বপ্ন, উদ্বেগ ও ঘটনা সম্পর্কে নিয়ন্ত্রণহীন চিন্তা। এছাড়া পিটিএসডিতে ভোগা মানুষ পরিবার বা অন্য সবার থেকে দূরে থাকে। কখনো চাকরি ছেড়ে দিতে পারে। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ হলো আত্মহত্যার প্রবণতা।
গবেষণায় ওঠে এসেছে, করোনার সময় স্বাস্থ্যসেবায় সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হয়েছিলো চিকিৎসকদের। এরপর রয়েছে, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও নার্স।
পিটিএসডিতে ভোগার মধ্যে চিকিৎসক ২৪ দশমিক ৩০ শতাংশ, টেকনোলজিস্ট ২৩ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং নার্স ২২ দশমিক ৮০ শতাংশ ছিল।
Advertisement
গবেষণা দলের প্রধান নিপসম’র পরিচালক অধ্যাপক ডা. বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ এ ফলাফল তুলে ধরেন।
করোনার সময় মুগদা হাসপাতাল
গবেষণাটি ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে করা হয়। যা পরিচালিত হয় এক হাজার ৩৯৪ জন স্বাস্থ্যকর্মীর ওপর। তাদের মধ্যে ছিলেন ৫৯৬ জন চিকিৎসক, ৭১৩ জন নার্স এবং ৮৫ জন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট। এসব স্বাস্থ্যকর্মীরা অন্তত এক মাস করোনা রোগীদের সঙ্গে কাজ করেছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন জরিপ কর্মীরা।
জরিপে দেখা গেছে, নারীদের পিটিএসডি’র ঝুঁকি ছিল বেশি। যাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে ৬২ দশমিক ৯ শতাংশেরই পিটিএসডি ছিল। এর মধ্যে ৮৩ দশমিক ৬ শতাংশ ছিলেন বিবাহিত। স্বাস্থ্যসেবা পেশাদারদের কাজের চাপ ছিল অনেক বেশি। তারা ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সামগ্রীর (পিপিই) অপ্রতুলতায় ছিলেন। এছাড়া ছিলেন করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিতে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই মানসিক চাপে ছিলেন, ছিলেন ক্লান্ত এবং অনেকেরই ঘুমাতে সমস্যা হচ্ছিলো। অনেকে তাদের পরিবার এবং আত্মীয়দের নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। এতে করে তাদের উত্তেজনা ও উদ্বেগ আরও বেড়ে যায়।
প্রতিবেদনে একজন অংশগ্রহণকারীর বরাত দিয়ে বলা হয়, সংক্রামক রোগ হওয়ায় রোগীদের মতো তাদেরও একই ভয় ছিল। অনেক কিছুই ছিল অজানা। হাসপাতালগুলো এই ধরনের নতুন রোগের চিকিৎসার জন্য ছিল না প্রস্তুত। রোগী, গণমাধ্যম ও গণমানুষসহ সমাজের নেতিবাচক মনোভাবের পাশাপাশি কাজের সময় সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি মানসিক চাপকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল।
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অনেকেই নিয়মিত প্রার্থনা, টিভি দেখা, বই পড়ার মতো কার্যক্রমে সময় ব্যয় করতেন, যাতে পিটিএসডির প্রভাব কম থাকে।
নিপসম মিলনায়তনে জরিপের ফল প্রকাশ করা হয়
ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে নিপসম’র পরিচালক অধ্যাপক ডা. বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ বলেন, পিটিএসডিতে ভোগা স্বাস্থ্যসেবা পেশাদাররা এখন কীভাবে কাজ করছেন সে সম্পর্কে তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। কেননা, গবেষণার তথ্যগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে গত বছর (২০২১ সাল)। তবে এই স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজর দেওয়া উচিত বলে জানান তিনি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবাবিষয়ক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সেবার পাশাপাশি গবেষণাও বাড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে গবেষণা ফলের ওপর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নির্ভর করে।
এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব মো. সাইফুল হাসান বাদল, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেন প্রমুখ।
এএএম/জেডএইচ/এমএস