ভ্রমণ

হিচহাইক করে ভারতের ৭ রাজ্য ঘুরে এলেন আবু বকর

মুহম্মদ আবু বকর সময় পেলে লেখালেখি করেন, শখের বশে ছবি আঁকেন। আবার সুযোগ পেলে ভ্রমণ করতে বেরিয়ে পড়েন। মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার উত্তর উড়ারচর গ্রামে তার জন্ম। পড়াশোনা করছেন শরীয়তপুর সরকারি কলেজে। রইচ উদ্দিন বেপারির প্রথম সন্তান আবু বকর সম্প্রতি ঘুরে এসেছেন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে। যাকে অনেকটা হিচহাইক বলা যায়।

Advertisement

দেশে ফিরে জাগো নিউজকে শুনিয়েছেন তার ভ্রমণের গল্প। জানিয়েছেন ভ্রমণের অভিজ্ঞতার কথাও। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন লেখক ও সাংবাদিক সালাহ উদ্দিন মাহমুদ—

জাগো নিউজ: বাংলাদেশ থেকে কবে কীভাবে যাত্রা শুরু করেছেন?মুহম্মদ আবু বকর: ভারতে ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছা আমার বহু বছরের। আমি ফ্যান্টাসিতে ভুগতাম। কয়েকদিন আগে আমার একটু শারীরিক সমস্যা হয়েছিল। ভয়ে ছিলাম, কোনো খারাপ রোগ না ধরা পড়ে। তখন নামাজ পড়ে বলতাম, মরার আগে আমি যেন ভারতে অন্তত একবার যেতে পারি। হা হা, এরকম ছিল ভারত নিয়ে আমার কৌতূহল। আল্লাহর রহমতে পরীক্ষায় খারাপ কিছুই আসেনি। ভাবলাম ভারত এবার যেতেই হবে। তবে করোনার পর ট্যুরিস্ট ভিসা তো খুলেছে। কিন্তু তা বাই এয়ারে, ল্যান্ড বর্ডার তো এখনো খোলেনি। বাই এয়ারে তো আমি যেতে পারব না। আমার বাজেট তো খুবই সামান্য। খুবই সামান্য পয়সা নিয়ে যাব।

অবশেষে মার্চে খবর এলো, বাই রোডে ট্রাভেল ভিসা দেওয়া শুরু করেছে। এবার আর অপেক্ষা নয়, চলো ভিসা করা যাক। আমাদের একসঙ্গে তিন-চার জনের ঘুরতে যাওয়ার কথা ছিল। মূলত ভারত ঘুরতে যাওয়ার জন্যই আমরা একসঙ্গে পাসপোর্ট বানিয়েছিলাম। তা যখন ট্রাভেল ভিসা ওপেন হয়েছে; তখন কাউকেই পাওয়া গেল না। আমাকে একাই ভিসার অ্যাপ্লাই করতে হলো। বহু ঝামেলা, পাব কি পাব না; সে দ্বিধা-দ্বন্দের পর ভিসা পাওয়া গেল। এবার রওনা দেওয়ার প্রস্তুতি। এরই মধ্যে ঈদ চলে এলো। ঈদের সপ্তাহখানেকের মাথায় আমি রওনা দিলাম মহাভারতের দিকে। ৯ মে বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে স্বপ্নের দেশে প্রবেশ করলাম। যে দেশ একদিন আমারই ছিল; সেই দেশেই আজ আমাকে পাসপোর্ট, ভিসা নিয়ে ৩ ঘণ্টার অসহ্য ইমিগ্রেশন শেষে একজন বিদেশি হিসেবে প্রবেশ করতে হলো।

Advertisement

জাগো নিউজ: ভারতের কয়টি রাজ্য ঘুরেছেন এবং কতদিন ছিলেন?মুহম্মদ আবু বকর: আমি ৯ মে সকালে ভারতে প্রবেশ করি এবং মে মাসের ২১ তারিখ সকালে বাংলাদেশে ফিরে আসি। সেই হিসেবে আমি মোট ১৩ দিন ভারতে অবস্থান করি। এই ১৩ দিনে আমি মোট ৭টি রাজ্য ঘুরি, ঘুরি মানে ক্রস করি। পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, বিহার, উত্তর প্রদেশ, আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরা। প্রথম আমি ৮ মে বাড়ি থেকে রওনা হয়ে বেনাপোলের নাভারন বাজারে আমার এক বন্ধুর বাসায় রাত কাটিয়ে পরদিন ৯ মে ভোরে ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করে ওপারে প্রবেশ করি। প্রথমে তো বনগাঁ থেকে শেয়ালদহের ট্রেন ধরে কলকাতা পৌঁছাই। কলকাতায় একদিন থাকি। তারপরই দিল্লির উদ্দেশে বের হয়ে পড়ি। হাওড়া থেকে ডানকুনি গিয়ে আমার দিল্লির দিকে যাত্রা আরম্ভ হয়। আমার পরিকল্পনা ছিল দিল্লি যাওয়ার পথে যেসব উল্লেখযোগ্য স্থান পড়বে, সেসব দেখে যাওয়া। ঝাড়খণ্ডের রাঁচিতে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। যেহেতু লিফট নিয়ে চলছি এবং গাড়িটা সরাসরি বানারস যাবে। সুতরাং আমাকেও সরাসরি বানারস চলে যেতে হলো। বানারস পৌঁছলাম ১১ মে সন্ধ্যার একটু আগে। ফাঁকে ২ দিন গাড়িতে গাড়িতে গোসল হয়নি। সুতরাং পৌঁছেই গঙ্গাস্নান করে পবিত্র হলাম।

জাগো নিউজ: আপনি বেশিরভাগ সময়ই হিচহাইকের আশ্রয় নিয়েছেন, কেমন রেসপন্স পেয়েছেন?মুহম্মদ আবু বকর: আসলে বেশিরভাগ সময় নয়, পুরো যাত্রাটাই আমি হিচহাইক করে করে পার করি। মাদারীপুরে আমার বাসা থেকে বেনাপোল দিয়ে ভারতে ঢুকে এবং আগরতলা দিয়ে বের হয়ে ফের মাদারীপুর ফিরে আসা পর্যন্ত পুরোটা জার্নিতেই হিচহাইক চলেছে। ভারতে আমি যতদিন কাটাই; তাতে ট্রান্সপোর্ট কস্ট বলতে মাত্র ৩০০ রুপি খরচ হয়েছে। আর প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কিলোমিটার লিফট নিয়ে অতিক্রম করি। এই হিচহাইকিংয়ের ধারণাটা খুবই প্রাচীন। সব দেশের প্রাচীন পরিব্রাজকরা প্রায় সবাই হিচহাইক করেছেন। তখন তো এত এত গাড়ি ছিল না। তারা করতেন কী: বিভিন্ন বণিক কাফেলার সঙ্গে ঝুলে পড়তেন। দূরদেশগামী মার্চেন্ট জাহাজে উঠে পড়তেন। সোয়ান জাঙ (হিউয়েন সাঙ), ইবনে বতুতারা একটি মাত্র ঝোলা কাঁধে বেড়িয়ে পড়ে বহু বছর পর বহু দেশ ঘুরে বাড়ি ফিরেছেন। তারা পথে কী হবে, কীভাবে খাবেন, কোথায় থাকবেন তার চিন্তা তো করেননি! আর আমি মাত্র এক মাস এই মানুষের দুনিয়ায় বেঁচে থাকতে পারব না! আমি বিশ্বাস করি, মানুষের দুনিয়ায় মানুষ মরে না। যেনতেন প্রকারে চলে আপনার যাবেই।

আপনি ইন্টারনেটে বিভিন্ন জায়গায় দেখবেন, এতদিনে সিকিম, কাশ্মীর, অমুক অমুক জায়গায় ট্যুর দিয়ে আসুন মাত্র কুড়ি হাজার টাকায়। দশ হাজার টাকা খরচ করে ভারতে এক সপ্তাহ কাটিয়ে আসুন ইত্যাদি ইত্যাদি। এমনকি বাংলাদেশের রাঙ্গামাটি বান্দরবান ঘুরতে গেলেও দেখবেন হাজার পাঁচেকের নিচে বাজেট হয় না। কিন্তু সত্যি বলতে, আমার পক্ষে পাঁচ হাজার টাকা জোগাড় করাও দুরূহ ব্যাপার। তাই বলে ঘুরব না! যেখানে বান্দরবানের থানচি, আলীকদম, রুমা, সাজেক ইত্যাদি জায়গায় ঘুরতে গেলে চার-পাঁচ হাজার টাকার কমে চিন্তাও করা যায় না; সেখানে আমার ৩০০-৪০০ টাকায় তিন-চার দিনের সফর হয়ে গেছে। হা হা। ভারত যাওয়ার আগে আমি বাংলাদেশের বহু জায়গায় হিচহাইক করে ঘুরেছি। সেই থেকেও আমার আত্মবিশ্বাস হয়েছে বলতে পারেন, যে আমি ভারতেও বিনা টাকায় অর্থাৎ হিচহাইক করে ঘুরতে পারব। আমার মনে হয়েছিল, ভারতে হিচহাইক করাটা আরও সহজ হবে। আপনি যত উন্নত স্থানে যাবেন; সেখানে তুলনামূলক লিফট তত সহজে মিলবে। অনুন্নত অশিক্ষিত অঞ্চলে হিচহাইক ব্যাপারটা তেমন বোঝে না। বাংলাদেশে অনেক জায়গায় লিফট চেয়ে গাড়িতে উঠেছি, পরে সে আমার কাছে টাকা চেয়েছে। তখন তো আমি তার সাথে তর্ক করতে পারি না। তাকে বলতে পারি না, আরে আমি তো আপনার কাছে লিফট চেয়েছি ফ্রিতে! আমাকে তখন ভাড়া দিতে হয়েছে। এ কারণে পরে আমি বেশিরভাগ সময়ই ড্রাইভারের কাছে জিজ্ঞেস করে নিয়েছি লিফট তো, ফ্রি তো। ভারতের শান্তিনিকেতনে, দার্জিলিংয়ে সবচেয়ে সহজে লিফট পেয়েছি। আসামের দিকে লিফট পেতে একটু অসুবিধা হয়েছে।

জাগো নিউজ: ভ্রমণের সময় কোনো প্রতিবন্ধকতা বা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন?মুহম্মদ আবু বকর: না, এই ভ্রমণকালে আমি তেমন কোনো সমস্যার সম্মুখীন হইনি। তবে যেদিন শান্তিনিকেতন থেকে দার্জিলিংয়ের উদ্দেশে রওনা হই, তার আগে চেয়েছিলাম তামিলনাড়ুর দিকে যাব। তা মেদিনীপুর যাওয়ার পথে দুর্গাপুর পর্যন্ত গিয়ে আমি ফিরে আসি। এত গরম! তার মধ্যে রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে লিফ্ট খোঁজা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই মন ঘুরিয়ে আবার দার্জিলিংয়ের দিকে রওনা হই। সেদিন রামপুরহাট পার হয়ে তারাপীঠের কাছে একটি ধাবা পর্যন্ত আসতে আসতেই সন্ধ্যা হয়ে যায়। যে লোকটি তার মাহিন্দ্রায় আমাকে শেষ লিফ্টটা দিয়েছিল; সে বলেছিল, এই ধাবায় নাকি বর্ধমান না কলকাতা থেকে আসা বালির ট্রাকগুলো রাত করে খেতে থামে। যেসব ট্রাক সরাসরি শিলিগুড়ি যায়, সেগুলোর একটাতে দেখবেন চলে যেতে পারেন কি না। আমি ওই ধাবাতেই সবজি দিয়ে ভাত খেয়ে অপেক্ষা করছি। কোনো ট্রাক থামলে, খেতে এলে তাদের জিজ্ঞেস করছি, কোথায় যাবে? কেউ শিলিগুড়ি যাবে শুনলে বলছি, ‘আমাকে নেওয়া যায় কি না।’ তাদের উত্তর, ‘না নেওয়া যাবে না দাদা, মালিকের নিষেধ আছে। দিন হলে নিয়ে যেতাম। কোনো কথা ছিল না।’

Advertisement

তারপর রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নেড়ে অনেক রাত হয়ে গেল, কেউ আমাকে নিলো না। একসময় ধাবার মালিক আমার কর্মকাণ্ড দেখে ব্যাপার জানতে চাইল। বলল, ‘আপনি রামপুরহাট থেকে ট্রেন দিয়ে শিলিগুড়ি চলে যান। এখন কেউ আপনাকে নেবে না। ওই পেছনেই রামপুরহাট। সেখানে গিয়ে দেখেন কোনো ট্রেন আছে কি না।’ এক ভাই ধাবাতে খাওয়া-দাওয়া করে এখন ওদিকেই যাচ্ছিল মোটরসাইকেল নিয়ে। ধাবার মালিক বলল, ‘ওর সাথে চলে যান রামপুরহাট।’ ভাই আমাকে একেবারে রামপুরহাট স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে এলো। বলল, ‘টিকিট কেটে দেব?’ বললাম, ‘আরে না না।’ তখন রাত সাড়ে দশটা-এগারোটার মতো। তথ্যকেন্দ্রে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, সাড়ে বারোটার দিকে ট্রেন আছে। আমার খুব ক্লান্ত লাগছিল। ওয়েটিং রুমে গিয়ে চেয়ারে টান হয়ে শুয়ে পড়লাম।

যখন উঠলাম; তখন বারোটা দশ-পনেরো বেজে গেছে। তাড়াতাড়ি বের হয়ে প্লাটফর্মে চলে গেলাম। শিলিগুড়ির ট্রেন কোন দিকে যাবে জিজ্ঞাসা করে অপেক্ষা করতে থাকলাম। ট্রেন এলো। কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস। উঠে পড়লাম। টিকিট ছাড়া। উঠে তো এক জায়গায় বসে পড়লাম। খানিক বাদেই টিকিট চেকার এলো। আমি তো ভয়ে আছি। বললাম, ‘ভাইসাব, মেরে পাস তো টিকিট নেহি হ্যায়’। ‘টিকিট নেহি হ্যাঁ মাতলাব! টিকিট ছাড়া কেন উঠেছেন! আচ্ছা ঠিক আছে, আমি অফিসারের কাছে তুলে দিচ্ছি’। আমি বললাম, ‘সরি স্যার, ভুল হো গায়া, মাফ কার দো’। পরে তিনি বললেন, ‘পেছনে চলে যান’। কিন্তু আমি ঠিক বুঝতে পারিনি, আমি পেছনের কামরা পার হয়ে দরজার পাশে বসে থাকি, বসে বসে চোখ বুঁজে তন্দ্রা এসে গেল। হঠাৎ কে যেন আমার গা ঝাঁকাচ্ছে, চেয়ে দেখি আবার সেই চেকার। একটু ঝাড়ি দিয়ে বলল, আপনার সমস্যা কী? আপনাকে পেছনে চলে যেতে বললাম না? ফাইন করে দেব ৫৫০ টাকা।

উঠে পরপর কামরা পার হয়ে পেছনে যাচ্ছি, একটা কামরা পার হতে গিয়ে কে একজন পা দিয়ে ঠেলা দিলো আমার পায়ে। চেয়ে দেখি পুলিশ, আমি তো খুব ভয় পেয়ে গেলাম। আমার কাছে তো টিকিট নেই। যদি পাসপোর্টে অফলোড মেরে দেয়! কোথা থেকে এই অফলোড শব্দটা শুনেছি কে জানে? জানি না। যদি অফলোড মেরে দেয়। আর কখনো যদি ইন্ডিয়ায় ঢুকতে না দেয়। যদিও জানি না কেন অফলোড মারে, কোন জায়গায় মারে, কিন্তু শব্দটার ভয় ইন্ডিয়ায় থাকতে সারাক্ষণ তাড়া করছিল। সুতরাং ভাবি, আমি যে অন্য দেশের পাসপোর্টধারী লোক তা বলা যাবে না। পুলিশ আমাকে বলল, ‘টিকিট হ্যাঁয়, হ্যাঁয়, কাঁহা হ্যায়? নিকাল কারো!’ ‘সরি সার, নেহি হ্যাঁয়।’ ‘তো ঝুট কিউ বোলা? কাঁহা সে আয়া?’ ‘রামপুরহাট।’ ‘ঘার কাঁহা?’ ‘কলকাতা।’ ‘কলকাতা মে কাঁহা?’‘দক্ষিণেশ্বর।’ ‘আধার কার্ড নিকাল কার।’‘সরি সার, ম্যায় তো ভুল গায়া। I forgot the aadhar card to bring with me.’এরপর কী করি তা জিজ্ঞাসা করল। ‘পড়াশোনা।’ ‘তাহলে কলেজ আইডি কার্ড কই?’ ‘সেটাও নেই।’ এতক্ষণে সন্দেহ করতে শুরু করেছে। মোবাইল বের করতে বলল। মোবাইলে আইডি কার্ডের ছবি আছে কি না। আসলে একজনের ফোনের গ্যালারি ঘাঁটলেই সব জেনে যাওয়া যায়। সে জন্যই নিশ্চয়ই ফোন চেয়েছে। দিলাম। ও ব্যাটা মোবাইলের গ্যালারি দেখছে আর নারী পুলিশ আমার ব্যাগপত্র বের করতে বলছে। আমার সঙ্গে একটা লেখার খাতা ছিল। সেটা দেখল।

লোকজন চারদিক থেকে ঘটনা দেখছে। এত অপমানিত বোধ করছিলাম! পুলিশ ফোনের গ্যালারি ঘাঁটতে ঘাঁটতে পাসপোর্টের ছবি পেয়ে গেল। আমি বললাম, ‘স্যার আমি তো ভড়কে গায়া। যদি আপনি ফাইনটাইন করে দেন।’ ওই পাসপোর্টের অফলোড আর উল্লেখ করলাম না। এসব কর্মকাণ্ডে এক-দেড় ঘণ্টা চলে গেল। তারপর তাদের অফিসার এলো। আমার পাসপোর্ট নেড়েচেড়ে বলল, ‘সব কুচ তো সহীহ হ্যায়’। তাহলে ঝুট কেন বললাম। আমি ওই একই কথা বললাম। ‘আরে আমি কেন ফাইন করব। ফাইন তো চেকার করবে’। শেষে আমাকে ফাইনটাইন কিছু নয়, পেছনের মালগাড়িতে গিয়ে বসতে বলল। মালগাড়িতে নয়, আমি পেছনের দুটো কামরা পর একটা সিট পেয়ে সেখানে বসে পড়ি। রাত শেষে সকাল হয়ে শিলিগুড়ি জংশন আসা পর্যন্ত কেউ আমাকে আর টু শব্দটিও করেনি। কিন্তু আমার মনটা বিষিয়ে গেল। সবচেয়ে দুঃখ হলো, ওই মেয়ে পুলিশটা আমায় তুই করে বলল! তখন মনে হয়েছিল, দূর কখনো ভারত আসব না।

জাগো নিউজ: ভিন দেশে মানুষের সাহায্য এবং ভালোবাসা কেমন পেয়েছেন?মুহম্মদ আবু বকর: সাহায্য তো খুব পেয়েছি। সাহায্যের উপরেই তো আমার এই যাত্রা। লিফট দেওয়াটা তো সাহায্যের মধ্যেই পড়ে তাই না। তবে তা ছাড়াও অনেক লোকাল লোক আমার এ রকম ভ্রমণের ব্যাপারটা শুনে খুব কৌতূহলী হয়ে কত লোক যে আমাকে খাইয়েছে হোটেলে নিয়ে! ট্রাকে তো দু-আড়াই দিনের পথ, সেখানে তো খেতে হবে। কোনো ড্রাইভার আমাকে চায়ের বিলটা পর্যন্ত দিতে দেয়নি। দুজন লোক আমাকে টাকাও দিয়েছে। আমি নেব না কিন্তু তারা জোর করে, ‘আরে রাখুন। এর জন্য হয়তো আপনার যাত্রাটা আরেকটু দীর্ঘায়িত হবে।’ আমার এক বন্ধু, বন্ধু মানে কি, সে আমার বাবার তুল্য, অরিন্দমদা, আমাকে শান্তিনিকেতনে হোটেল বুক করে দিয়েছে সেই সুদূর মহারাষ্ট্র থেকে। শিলিগুড়ি থেকে আমাকে যে ভাইটি তার মোটরসাইকেলে লিফট দেয়, সে পরে আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে যায়। সে রাত তার বাড়িতে থাকি। ভালোবাসা প্রচুর পেয়েছি ভাই, সে ভোলার নয়। প্রথম দিনে কলকাতা গিয়ে তো আমার মারাত্মক খারাপ লাগছিল। টাকা থাকলে ফ্লাইট ধরে ঢাকা চলে আসতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু পরে ভারতটাকে আমার খুব ভালো লাগতে শুরু করে।

জাগো নিউজ: আপনার এই ভ্রমণের কি কোনো উদ্দেশ্য ছিল? নাকি মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ানো?মুহম্মদ আবু বকর: আমার যতদূর মনে পড়ে, আমি একজনকে ফেসবুকের কমেন্টে লিখেছিলাম। সে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘আপনি কেন বই পড়েন?’ আমি লিখেছিলাম: একজনের কেন পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরতে যায়, একজনের কেন ট্রেকিং করতে ভালো লাগে, তা যেমন বলতে পারে না; তেমনই একজন কেন বই পড়ে, তা-ও সে বলতে পারে না। ওই আর কি! বলতে পারেন, আপনার ওই মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ানো।

জাগো নিউজ: ভ্রমণকালে উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা থাকলে পাঠকের উদ্দেশে বলুন—মুহম্মদ আবু বকর: সবই তো উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ঘুরতে বের হওয়ার পর যা দেখবেন তাই পরম। সামান্য জিনিসও খুব অমূল্য হয়ে ওঠে। তবে গৌহাটি থেকে আগরতলা আসার পথে যে ট্রাকটি আমাকে শেষ লিফট দেয়, তাদের সঙ্গে ত্রিপুরার আমবাসায় পাহাড়ের পাদদেশে ট্রাক থামিয়ে রান্না করে খাওয়ার স্মৃতিটা আজীবন ভোলার নয়। অত আহ্লাদ আর কোথায়ও হয়নি আমার। সম্ভবত পাঠক জানতে কৌতূহলী হবে যে, এই ভ্রমণে আমার কত টাকা খরচ হলো। আমার এই ১৩ দিনের গোটা ভারত ভ্রমণে ভিসা ফি, ট্রাভেল ট্যাক্স ইত্যাদি বাদে সর্বমোট বাংলা টাকার দুই হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে।

এসইউ/জেআইএম