দেশজুড়ে

স্বপ্নের চার লেন প্রকল্প: ৬ বছরে অগ্রগতি ৪৩ ভাগ

স্বপ্নের চার লেন প্রকল্পের কাজ দ্বিতীয় মেয়াদের মধ্যে শেষ করা নিয়ে শংকা দেখা দিয়েছে। এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেন উন্নীতকরণ প্রকল্পে এখন পর্যন্ত সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৪৩ ভাগ। সামনে বর্ষা মৌসুমে অতিবৃষ্টির কারণে কাজ আরও পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর প্রধান কারণ হিসেবে বৃহৎ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আবদুল মোনেম লিমিটেডকে দায়ী করা হচ্ছে।

Advertisement

প্রতিষ্ঠানটি থেকে সময় মতো অর্থছাড় ও প্রয়োজনীয় মালামাল না থাকায় মহাসড়কের তিন বড় স্পটে বিগত এক বছর ধরে কোনো কাজ হয়নি। বাকি ছয়টি স্পটে কাজ চলছে ঢিমেতালে। সরেজমিনে পরিদর্শন ও প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে মিলেছে এসব তথ্য।

সড়ক ও জনপথ বিভাগ সূত্র বলছে, মোনেম গ্রুপের মূল উদ্যোক্তা বিশিষ্ট শিল্পপতি আবদুল মোনেম মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রতিটি প্রকল্পের কাজ যথাযথভাবে হয়েছে। ২০২০ সালের ৩ মে তিনি মারা যাওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব বর্তায় মোনেমের দুই ছেলে এ এস এম মাঈনুদ্দিন মোনেম ও এ এস এম মহিউদ্দিন মোনেমের ওপর। তারা চলমান কাজের যথাযথ দেখভাল করেন না। এ কারণে দুই মাস আগে আবদুল মোনেম লিমিটেডকে নোটিশ টু কারেক্ট (সতর্কবার্তা) দেওয়া হয়েছে। এটি সতর্কতামূলক চিঠি। সঠিক সময়ে সঠিকভাবে কাজ না করলে জরিমানাসহ চুক্তি বাতিল হতে পারে।

এশিয়ান হাইওয়ে সাউথ এশিয়া সাব-রিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশন (সাসেক) ও বাংলাদেশ, ভারত, চীন এবং মিয়ানমারের মধ্যে প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক করিডোরে (বিসিআইএম) নতুন করে বাংলাদেশের ৮টি মহাসড়ক যুক্ত হবে। ওই সড়কগুলোর মোট দৈর্ঘ্য হবে ৬০০ কিলোমিটার। ১৯০ কিলোমিটারে এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়কটি এর একটি অংশ। প্রকল্পটি টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, গাইবান্ধা ও রংপুর জেলায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। ওই সড়কের মাধ্যমে রংপুর-সৈয়দপুর-বাংলাবান্ধা হয়ে ভারতে প্রবেশ করা যাবে। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বাণিজ্য সহজ করতেও রুটটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

Advertisement

প্রকল্পের আওতায় রুটের উভয় পাশে স্লো মুভিং ভেহিক্যাল ট্রাফিক (এসএমভিটি) লেন নির্মাণ করা হবে। ১৯০ কিলোমিটার রুটের যেখানে যানজট বেশি এমন স্থানে ছয়টি ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হবে। ফ্লাইওভারের দৈর্ঘ্য হবে দুই হাজার ৬৩৫ মিটার। এছাড়া ৫০ কিলোমিটার কংক্রিট পেভমেন্ট, ২৬টি সেতু, ৩৯টি আন্ডারপাস, ১৮০টি কালভার্ট এবং পথচারী পারাপারের জন্য ১১টি পথচারী সেতু নির্মাণ করা হবে।

প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে। মেয়াদ ছিল ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত। এই সময়ে প্রকল্পের আর্থিক ও ভৌত অগ্রগতি সন্তোষজনক হয়নি। এজন্য প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। আগে মূল প্রকল্পের ব্যয় ছিল ১১ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা। এখন আরও চার হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা বাড়িয়ে ১৬ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে এ কাজ শেষ করার কথা রয়েছে।

কিন্তু প্রকল্প এলাকা ঘুরে ও প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত সার্বিক অগ্রগতি মাত্র ৪৩ ভাগ। সামনে বর্ষা মৌসুম। অতিবৃষ্টির কারণে কাজ আরও পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

সরেজমিরে ঘুরে দেখা গেছে, হাটিকুমরুল থেকে বগুড়ার বনানী পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার সড়কের কাজ করছে আবদুল মোনেম লিমিটেড। শেরপুর উপজেলার মধ্যে দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা ঘোগাব্রিজ, ছোনকা বাজার ও মীর্জাপুর এলাকায় ওভারপাস ও আন্ডারপাসের কাজ এক বছর ধরে বন্ধ। এগুলো অসমাপ্ত অবস্থায় পড়ে থাকায় চলাচলে দুর্ভোগ বহুগুণ বেড়েছে।

Advertisement

অন্যদিকে, শেরপুর থেকে বগুড়া শহরের বনানী পর্যন্ত চলমান কাজের গতিও খুবই মন্থর। নির্মাণকাজ করতে আবদুল মোনেম লিমিটেডের মালামাল রাখার বেজক্যাম্পটি হলো শেরপুরের ছোনকা বাজার এলাকায়। সেখানে দেখা গেছে সব ধরনের মালামালের স্বল্পতা। সড়ক নির্মাণকাজের অন্যতম উপকরণ নুড়িপাথরের স্টক নেই বললেই চলে।

কাজের ধীরগতি প্রসঙ্গে আবদুল মোনেম লিমিটেডের প্রকৌশল বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, আমার চুক্তির সময়ের মধ্যেই সব কাজ শেষ করে ফেলবো। করোনায় কাজে কিছুটা ভাটা পড়েছিল। এছাড়া বিশ্ববাজারে নির্মাণ সামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় একধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়। এরপরও চেষ্টা করছি সবকিছু ঠিকমতো চালানো। এছাড়া মহাসড়কের তিনটি বড় স্পটে কাজ বন্ধ করা হয়নি, গতি কম হয়েছে বলে জানান তিনি।

প্রকল্পের পরিচালক ওয়ালিউর রহমান বলেন, এখন পর্যন্ত সার্বিক অগ্রগতি মাত্র ৪৩ ভাগ। কাজের ধীরগতি জন্য আবদুল মোনেম লিমিটেডকে দুই মাস আগে চিঠি দিয়েছি। এরপরও কাজের গতি আশানুরূপ নয়। প্রকল্পের স্বার্থে আরও কিছুদিন দেখবো। অগ্রগতি না হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

একই প্রকল্পের অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক হামিদুল হক বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে আগামী নির্বাচনের আগে এ মেগা প্রকল্পের বেশির ভাগ অংশ শেষ করার নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু আবদুল মোনেম লিমিটেডের কাজের অগ্রগতি নিয়ে আমরা বেশ চিন্তিত। তাদের তাগাদা দিয়েও লাভ হচ্ছে না। অন্যান্য স্থানে যে সমস্যা রয়েছে সেগুলো নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করা যাবে বলে মনে করছি।

সড়ক বিভাগ সূত্র বলছে, ১৯০.৪ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে আবদুল মোনেম লিমিটেড, মনিকো লিমিটেড, কনকর্ড প্রগতি কনসোর্টিয়াম লিমিটেড এবং চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড কাজ করছে। এর মধ্যে আবদুল মোনেম লিমিটেড ছাড়া অন্যদের কাজের গতি ভালো।

হাটিকুমরুল ইন্টারসেকশন কাজ শুরু হয়নি

ফরিদপুরের ভাঙ্গার মতো হাটিকুমরুল মোড়ে হবে ইন্টারসেকশন। গাড়িগুলো কোনো রকম বাধা না পেয়ে সোজা চলতে পারবে। কিন্তু এ কাজ শুরুই হয়নি। ইন্টারসেকশন নির্মাণে ব্যয় হবে ৭৪৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা। প্যাকেজ-১৩ এর আওতায় চীনের প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড এটি করবে। এ কাজের চুক্তিও হয়েছে।

এ প্রকল্পের কর্মকর্তা জয় প্রকাশ চৌধুরী বলেন, হাটিকুমরুল গোলচত্বরে ইন্টারসেকশনের সঙ্গে চার লেনের যে সংযোগ হবে, তাতে ঢাকা-রাজশাহী, ঢাকা-রংপুর এবং পাবনা-ঢাকার জন্য পৃথক লেন থাকবে। ইন্টারসেকশনে দূরপাল্লার যানবাহনের পাশাপাশি ধীরগতির পরিবহনের জন্যও থাকছে আলাদা লিংক রোড। প্রকল্প এলাকায় বেজক্যাম্প নির্মাণ করে সেখানে কিছু কাজ চলছে। এগুলো মহাসড়কে এনে যুক্ত করা হবে।

ঝামা ইটের খোয়ার মান নিয়ে প্রশ্ন

মহাসড়ক নির্মাণে ঝামা ইটের খোয়ার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সরকারের প্রকল্প তদারকি প্রতিষ্ঠান পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। আইএমইডি বলেছে, সড়ক নির্মাণে কোনো কোনো স্থানে ঝামা ইটের (পুড়ে কালো হওয়া) খোয়া ব্যবহার হচ্ছে। ফলে মহাসড়ক টেকসই হবে না। আইএমইডি ২০২০ সালের ২৭ নভেম্বর প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে এই প্রতিবেদন দেয়।

এতে উল্লেখ করা হয়, ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) লক্ষ্য অনুযায়ী কাজের অগ্রগতি না হওয়ায় সরকারের সময় ও অর্থের অপচয় হয়েছে। নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যে কাজ শেষ করতে হলে ঠিকাদারকে জনবল ও নির্মাণ সামগ্রীর মোবিলাইজেশন বাড়াতে হবে।

আইএমইডি রিপোর্ট প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক ওয়ালিউর রহমান বলেন, আইএমইডিকে প্রতিবেদনের জবাব দেওয়া হয়েছে। আইএমইডি কর্মকর্তারা সাইটে গিয়ে কিছু পোড়া ইট দেখেছেন। কিন্তু আমরা সেসব সড়কে ব্যবহার করিনি। ভালো ইটের মধ্যে কিছু পোড়া ইট পাওয়া যায়।

এএইচ/এএসএম