কোভিড মহামারি শেষ হতে না হতেই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার ঘটনা পৃথিবী বিশেষ করে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর জন্য নতুন ও ভয়াবহ আতঙ্ক নিয়ে হাজির হয়েছে। বাস্তবতা হলো এই যুদ্ধের ফলে ধনী দেশগুলো আরও ধনী হচ্ছে আর গরিব দেশগুলোতে খাদ্য-আতঙ্ক শুরু হয়েছে।
Advertisement
অক্সফাম বলছে খাদ্যপণ্য ও জ্বালানি তেল ব্যবসায়ীদের এখন রমরমা অবস্থা, আর কে না জানে যে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় খাদ্যপণ্য ব্যবসায়ী পরিবার যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটাভিত্তিক কারগিল ইনকরপোরেশন আর এদের পরিবারে এই করোনাকাল ও যুদ্ধের মধ্যে আরও চারজন বিলিয়নিয়ার বেড়েছে, করোনার আগে ছিল আটজন।
সুইজারল্যান্ডের দাভোসে চলমান ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সম্মেলনে অক্সফাম আরও জানায় যে, গত ২৪ মাসে ৬২ জন ব্যক্তি শতকোটিপতি বা বিলিয়নিয়ার হয়েছেন। খাদ্যপণ্য ও জ্বালানি- এই দুই খাতে ব্যবসায়ীদের সম্পদ বেড়েছে ৪৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বা ৪৫৩ বিলিয়ন ডলার।
মজার ব্যাপার হলো, কারগিলসহ চারটি কোম্পানি বিশ্বের কৃষিপণ্যের বাজারের ৭০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। মহামারি ও যুদ্ধের কারণ দেখিয়ে এসব কোম্পানি বিশ্বে খাদ্যশস্যের দাম ৩০ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছে এবং অক্সফামের মতে এর ফলে বিশ্বে আরও ২৬ কোটি ৩০ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে।
Advertisement
আরও দুঃখজনক কথা হলো, এর ফলে চলতি বছরের মধ্যেই ৮৬ কোটি মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনের ব্যয় ১ দশমিক ৯০ ডলারের নিচে চলে যেতে পারে। এই ভয়ঙ্কর চিত্র যখন বিশ্বের অর্থনীতি নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সভায় উপস্থাপন করা হচ্ছে তখন ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আসলে কী ভাবছে সেটা আমাদের জানা দরকার।
আমাদের আরও জানা দরকার যে, দুই যুযুধান প্রতিপক্ষ ইউক্রেন-রাশিয়াই বা এই যুদ্ধ শেষ করা বিষয়ে কিছু ভাবছে কি না। যদিও আজকের লেখার বিষয় এসব নয়, বাংলাদেশের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক এবং মাত্র গতকালই বাংলাদেশের জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী যে তথ্য গণমাধ্যমকে দিয়েছেন তা নিয়ে আলোচনাই এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমস এবং আমরা সবাই জানি যে, এই দৈনিকটি মার্কিন নীতিনির্ধারকদের মতামতকেই তার পাঠকের সামনে হাজির করে। গত ১৯ মে প্রকাশিত পত্রিকাটির সম্পাদকীয় পর্ষদ স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছে যে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের একতরফা জয় পাওয়া সম্ভব নয়। তারা স্পষ্ট করেই বলছে যে, রাশিয়ার সঙ্গে সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়াটা আমেরিকার জন্য যুক্তিযুক্ত হবে না, বরং সর্বাত্মক ছাড় দিয়ে হলেও এই যুদ্ধের একটি ইতি ঘটানো আবশ্যক হয়ে পড়েছে।
শক্তি বিবেচনায় রাশিয়ার শক্তি ‘অতুলনীয়’, ফলে ইউক্রেনের অবস্থান বদল করাই হবে বাস্তবসম্মত কাজ। সম্পাদকীয় পর্ষদ কোনো রাখঢাক না রেখেই বলছে যে, ইউক্রেনকে দিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ‘প্রক্সি ওয়ার’ বা ‘ছায়া যুদ্ধ’ চালিয়ে যাওয়াটা এখন আর কারও কাছে অজ্ঞাত কোনো বিষয় নয়।
Advertisement
যদিও প্রেসিডেন্ট বাইডেন বা তার পারিষদবর্গের কোনো স্পষ্ট ‘গোলপোস্ট’ নেই, তারা কখনও বলেছেন ‘পুতিনকে ক্ষমতায় রাখা যাবে না’ কিংবা ‘রাশিয়াকে দুর্বল করে দিতে হবে’, কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হলো যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো মিলেই যে এই ‘প্রক্সি ওয়ার’ চালাচ্ছে সে বিষয়ে আর সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
নিউ ইয়র্ক টাইমস শুরুতে যতোটা এই যুদ্ধের পক্ষে মার্কিন অবস্থানকে সমর্থন দিয়েছে তার ঠিক উল্টোটা বলছে সম্পাদকীয় পর্ষদের এই বক্তব্য। এর কারণ কী? এর কারণ হয়তো এটাই যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলো ভেবেছিল যে, বহুপাক্ষিক স্যাংকসন আরোপের ফলে রাশিয়া তথা পুতিনকে খুব সহজেই দুর্বল করে ফেলা সম্ভব হবে এবং দ্রুত এই যুদ্ধে রাশিয়াকে পরাজয় স্বীকার করে নিয়ে ইউক্রেনের দখলকরা অংশ ফেরত দিয়ে একটি দুর্বল রাষ্ট্রে পরিণত হবে রাশিয়া এবং পুতিনকে তো যেতেই হবে, এমনকি আন্তর্জাতিক আদালতে তার বিচারও করা যাবে। কিন্তু পরিস্থিতি বলছে, রাশিয়া দুর্বল তো দূরের কথা, রাশিয়া আসলে ক্রমাগত সবল হচ্ছে। যুদ্ধের আগে যেখানে এক ডলার দিয়ে ১৫০ রুবল পাওয়া যেতো সেখানে এখন এক ডলারে পাওয়া যাচ্ছে ৫০ রুবলের কিছু বেশি।
তার মানে রুবল এখন আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় শক্তিশালী মুদ্রা। শুধু তাই-ই নয়, রাশিয়ার কাছ থেকে তেল আমদানি বা রাশিয়ার তেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের আমেরিকান চাপ ইউরোপ গ্রহণ করেনি, করলে যে তাদের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যেতো এ কথা তো ইউরোপের শিশুমাত্রেরই জানা। চীন ও ভারতের কাছে ‘রুবল’-এ তেল বিক্রি করে রাশিয়া তার অর্থনীতিকে টিকিয়ে রেখেছে বেশ শক্তপোক্তভাবেই।
এশিয়ান টাইমসে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বিশ্লেষক জন ওয়ালশ দাবি করছেন যে, এবছর রাশিয়ায় বাম্পার ফলন হওয়ায় দেশটিতে খাদ্যাভাব দেখা দেয়া তো দূরের কথা খাদ্যপণ্য রফতানিতেও রাশিয়া এগিয়ে থাকবে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় নেতাগিরি করতে গিয়ে নিজের দেশের অর্থনৈতিক দুর্দশা ডেকে আনছে, নানা পন্থায় সেটা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলেও সেটা আসলে সম্ভব হচ্ছে না। কারণ পরিস্থিতি দ্রুতই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
সাধারণ জনগণ তথা নীতিনির্ধারকদের মধ্যে যুদ্ধবিরোধী অবস্থান বাড়ছে এবং তার ফল মধ্যবর্তী নির্বাচন ও পরে ২০২৪ সালে জাতীয় নির্বাচনে পড়বে এবং জন ওয়ালশের মতে, বাইডেন আসলে এতে ক্ষমতা হারাবেন। ডেমোক্রেটদের এই যুদ্ধপ্রীতি ও দেশে দেশে যুক্তরাষ্ট্রকে অজনপ্রিয় করে তোলার নীতির সমালোচনা এখন খুব জোরেশোরেই শোনা যাচ্ছে।
যে কথা বলার জন্য এতো কথা বলা, রাশিয়া বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের যেসব পদক্ষেপ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের জন্য বিরাট সহায়ক ভূমিকা রেখেছিল সেই অবস্থান থেকে নতুন রাশিয়া সরে এসেছে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই।
বাংলাদেশেও যখন মহামারি ও যুদ্ধের ঢেউ এসে লেগেছে তখন এখানেই অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়ছে, জিনিসপত্রের মূল্য লাগামহীন হয়ে উঠছে। ঠিক এখানেই ভারতকে আমরা একটি উদাহরণ হিসেবে দেখতে পারি যে, মার্কিন চাপ উপেক্ষা করেই ভারত রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল আমদানি করছে এবং এর ফলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী হলেও ভারত জ্বালানি তেলে শুল্ক কমিয়ে দিয়ে বাজারকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছে। ফলে কমেছে নিত্যপণ্যের দাম এবং অন্যান্য ক্ষেত্রেও অর্থনীতিকে কম চাপের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
পাকিস্তানের সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানতো ভারতের এ অবস্থানের প্রশংসা করে বলেছেন যে, মার্কিন চাপের কাছে মাথানত না করে ভারত যে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছে সেটাই আসলে যোগ্যতম কাজ।
আমাদের জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন যে, বাংলাদেশের কাছেও রাশিয়া অপরিশোধিত জ্বালানি তেল বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছে। সরকার এ বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি; তবে এ নিয়ে পর্যালোচনা চলছে। প্রশ্ন হলো, এই পর্যালোচনায় বাংলাদেশ আসলে সবচেয়ে কোন্ বিষয়টি নিয়ে ভাবছে?
এর উত্তরে কোনো কিছু না ভেবেই বলা যায় যে, বাংলাদেশ যদি রাশিয়া থেকে তেল ক্রয় করে তাহলে সবচেয়ে বড় চাপটি আসবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকেই। ভারত যে চাপ সহ্য করতে পারছে বাংলাদেশ সেটা পারবে কি না? এরই মধ্যে আমরা জানি যে, ‘মানবাধিকার’ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ একটি ‘নিষেধাজ্ঞা’ আকারে বাংলাদেশের ওপর ঝুলিয়ে দিয়েছে।
চাপ রয়েছে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত আকসা ও জিসোমিয়া নামে দুটি চুক্তি সইয়ের ব্যাপারে। কোনো রকম রাখঢাক না রেখেই যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তি সইয়ের ব্যাপারে বাংলাদেশের ওপর চাপ প্রয়োগ করছে। আগামী নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যেটুকু উদ্বেগ দেখাচ্ছে তা এসব চুক্তি সই হলে আর থাকবে বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত এসব চাপ সহ্য করছে এবং এসব চাপকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে তুলেছে। ফলে এর মধ্যে রাশিয়ার তেল বিক্রির প্রস্তাবে বাংলাদেশ সাড়া দিলে পরিস্থিতি কতোটা ভয়াবহ হতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি ও বাজারে যদি ধস নামে তাহলে সেটাও কি সরকার সামাল দিতে পারবে? সেক্ষেত্রে রুশ তেল-প্রস্তাব গ্রহণ করে জাতীয় স্বার্থ রক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে মার্কিন চাপ মোকাবিলায় কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে আরও জোরদার করাই কি সমীচীন হবে না?
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের প্রশংসায় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা প্রায়ই একথা বলেন যে, বাংলাদেশ কখনোই এরকম ‘ব্যালেন্স ডিপ্লোমেসি’ দেখেনি, সব পক্ষকে ‘পাশে’ রেখে চলা শেখ হাসিনার সরকার এখন কী করে সেটাই দেখার বিষয়। কিন্তু আমাদের সাধারণ মন বলে যে, একজন পরীক্ষিত ও ঐতিহাসিক বন্ধুর প্রস্তাবকে রক্ষা করাটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
আর বন্ধুত্বের প্রশ্নে বার বার হোঁচট খাওয়া সম্পর্কের কাছ থেকে আসা চাপ মোকাবিলার প্রস্তুতি রেখে যদি বিষয়টিকে সামলানো যায় তাহলে বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা কাটানো বাংলাদেশের পক্ষে সহজ হবে। যে কথা নিউ ইয়র্ক টাইমস খোদ বাইডেন সরকারকে বলছে, একই ধরনের কথা বাংলাদেশের সরকারকেও বলতে চাই যে, রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার না রাখাটা ‘লোকসান’-কেই আরও বেশি বাস্তবানুগ করবে এবং সেটা বাংলাদেশ আসলে ‘এফোর্ট’ করতে পারবে না।
ঢাকা ২৪ মে, মঙ্গলবার ২০২২
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট। masuda.bhatti@gmail.com
এইচআর/জিকেএস/ফারুক