রবার্ট ব্রুসের কাহিনি শিহরিত করে পৃথিবীর সব মানুষকেই। বারবার যুদ্ধে হেরেও কখনও হাল না ছেড়ে সপ্তমবারের চেষ্টায় যুদ্ধে জয় লাভ করেন ব্রুস। বাংলাদেশের শিশু-কিশোরদের জন্য রবার্ট ব্রুসের এই কাহিনি আলাদা কোন আবেদন তৈরি করে না। কেননা মাশরাফিকে সবাই দেখছে চোখের সামনে। জীবন মানেই নিরন্তর লড়াই-সংগ্রাম। মানুষ কখনও হারতে পারে না, বারবার এই দৃষ্টান্ত সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেন মাশরাফি। হতাশা- ক্লান্তি শব্দগুলো মাশরাফির কাছে এসে মুখ লুকায় লজ্জায়। মাঠের মাশরাফি হয়ে ওঠেন সাধারণ মানুষের জীবন-সংগ্রামের আদর্শ। ক্রিকেট ক্যারিয়ারের অর্ধেকেরও বেশি সময ইনজুরির কারণে মাঠের বাইরে থেকেছেন মাশরাফি। এবারে বুঝি নটে গাছটি মুড়ালো, মাশরাফি অধ্যায়ের সমাপ্তি দেখছিলেন অনেকেই। কিন্তু সবাইকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে আবারও মাশরাফি খেলার মাঠে আলো ছড়িয়েছেন আপন মহিমায়। আর তাই ব্যক্তিগত অর্জনে, রেকর্ড-উপাত্তের মধ্যে আটকে থাকা নাম নয় মাশরাফি বিন মর্তুজা। গত সোমবার মোড়ক উন্মোচিত হয়েছে মাশরাফি বিন মর্তুজার জীবনী গ্রন্থ ‘মাশরাফি’। এই বই সম্পর্কে বইয়ের লেখক দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের ভাষ্য অনেকের জীবনেই লড়াই সংগ্রাম খুঁজে পাওয়া যাবে, কিন্তু বারবার লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শিখওে ওঠার গল্প খুবই কম। একটা সময় ক্রিকেট থেকেই ছিটকে গিয়েছিলেন মাশরাফি। কিন্তু মাশরাফি শুধু ফিরেই আসেননি, বাংলাদেশ ক্রিকেটকে উন্নীত করেছেন ভিন্ন এক মাত্রায়। মাশরাফির জীবন এক রোমাঞ্চকর উত্থান-পতনের গল্প। লেখক দেবব্রত বলেন, যারা জীবনে কিছু অর্জনের জন্য লড়াই করে ক্লান্ত হচ্ছেন, মাশরাফির জীবন কাহিনি তাদেরকে উজ্জীবিত করবে। বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের জীবনী গ্রন্থ লেখা নিয়ে দু`চার কথা না বললেই নয়। কিছুদিন আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের নিয়ে জীবনী গ্রন্থ লেখা যেতে পারে এমন ধারণাটাই ছিল দুঃসাহসের নামান্তর। ক্রীড়া ব্যক্তিত্বদের নিয়ে জীবনী গ্রন্থ বলতে আমরা বুঝতাম, দিয়েগো ম্যারাডোনা, পেলে, সুনীল গাভাস্কার, ইমরান খান কিংবা ব্রায়ান লারা, শচীনদের। এই সব বিশ্ব মাতানো খেলোয়াড়দের জীবনী গ্রন্থ অনুবাদ করা কিংবা তাদের বায়োগ্রাফির অংশ বিশেষ নিয়ে পত্রিকায় সংবাদ ছাপানোর মধ্যেই আমরা আটকে থেকেছি। এমনকি বিতর্কিত আম্পায়ার ড্যারিল হেয়ারের বায়োগ্রাফির অংশ বিশেষ নিয়েও আমরা সংবাদ পরিবেশন করেছি। আজ যে বাংলাদেশের ক্রীড়া ব্যক্তিত্বদের নিয়ে জীবনী গ্রন্থ প্রকাশ করা হচ্ছে এগুলোও এসেছে ক্রীড়া সাংবাদিকতার ধাপে ধাপে। একটা সময় সুনীল গাভাস্কারের সানি ডে’জ ইমরানের অলরাউন্ড ভিউ আমাদের আলোড়িত করেছে প্রবলভাবে। একটা উদাহরণ দেয়া যাক। আমার প্রথম চাকরি জীবনে আমাদের পত্রিকার নিউজ এডিটর গেলেন দেশের বাইরে। বললেন, তোমার জন্য ‘কাটিং এজ’ বইটা নিয়ে আসব। জাভেদ মিয়াদাঁদের ‘কাটিং এজ’ বই থেকে তখন আামাদের দেশের অনেক পত্রিকাতেই নিউজ ছাপানো হয়েছে। ধীরে ধীরে বিশ্বখ্যাত ক্রীড়াবিদদের নিয়ে জীবনী গ্রন্থের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ ছাপানো শুরু হল আমাদের দেশের পত্রিকায়। পত্রিকায় ছাপানো লেখাগুলা বইয়ের রূপ পেল। ধরা যাক সৌরভ গাঙ্গুলীর জীবনী গ্রন্থ ‘প্রিন্স অব ক্যালকাটা’র কথাই। বইটি বেরুনোর অল্প সময়ের মধ্যেই ধারাবাহিকভাবে ছাপানো শুরু হলো পত্রিকায়। খুবই দ্রুত ‘প্রিন্স অব ক্যালকাটা’ নাম দিয়ে ধারাবাহিক লেখাগুলোকে বই আকারে বের করলেন সাংবাদিক রঞ্জন সেন। অর্জনে, আদর্শে ক্রিকেট আর শচীন মিলেমিশে একাকার। বাংলাদেশ ক্রিকেট সাংবাদিকতার কিংবদন্তী উৎপল শুভ্র লিখলেন ‘শচীন রূপকথা’। এটা কোন অনুবাদ নয়। সুদীর্ঘ সময় ধরে মাঠের শচীনকে দেখার অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ বই এটি। বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদদের নিয়ে বইয়ের কথা বললে প্রথমেই আসে ইমরুল সুমনের ‘কিং ব্যাক মুন্না’। ফুটবলে বাংলাদেশের মান যাই হোক না কেন, উপমহাদেশের ফুটবলে মুন্নাকে উপেক্ষা করার সাধ্য নাই কারও। কলকাতা লীগে ‘আকাশবাণী কলকাতা’র ধারাভাষ্যকারদের সেই উচ্ছ্বাস... আবারও মুন্না। সেই মুন্নার পায়ে বল এখনও অনেকের স্মৃতিতেই টাটকা। একটা সময়ে কলকাতায় আজহারউদ্দীন আর মুন্নার সমান সমান পোস্টার বিক্রি হয়েছে। বাংলাদেশে ক্রীড়াবিদদের নিয়ে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে মহত্তম কাজটি করেছেন নিবেদিতপ্রাণ ক্রীড়া সাংবাদিক দুলাল মাহমুদ। মহৎপ্রাণ মুক্তিযোদ্ধা সাতারু অরুণ নন্দীর জীবনী গ্রন্থ... ‘আমার সাঁতার জীবন’ বইটি লিখেছেন দুলাল মাহমুদ। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রচার ও মুক্তিযুদ্ধের ফান্ড গঠনের জন্য ১৯৭১ সালের ৮ অক্টোবর থেকে ১১ অক্টোবর টানা চারদিন সাঁতার কেটেছিলেন অরুণ নন্দী। নন্দীদার এই কীর্তি বিভিন্ন ফ্রন্টে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছিল দারুণভাবে। আগামী প্রজন্মের হাতে অরুণ নন্দীর কীর্তি গাঁথা তুলে দেয়ার থেকে বড় কাজ আর কী হতে পারে? তারপরও বলতে দ্বিধা নাই, নিজেদের ক্রীড়াবিদদের মলাটের মধ্যে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে আমাদের উদ্যোগের ঘাটতি আছে যথেষ্ট। বাংলাদেশের ফুটবল মানেই সত্তর-আশির দশক। বাংলাদেশের ফুটবলের এই তুমুল জনপ্রিয়তার প্রায় সবটুকু জুড়েই ফুটবলার কাজী সালাউদ্দীন। উদাহরণটা এভাবে দেয়াই যায় যে ভারতীয় ফিল্ম স্টারদের চেয়েও বড় সেলিব্রিটি শচীন। আর সত্তর ও মধ্য আশি পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সেলিব্রেটির নাম সালাউদ্দীন। আমার জানা মতে সালাউদ্দীনকে নিয়ে কোন পূর্ণাঙ্গ জীবনী গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। একই কথা খাটে ক্রিকেটার মোহাম্মদ রফিকের বেলায়ও। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম জয়ের নায়ক রফিক। শুধু এটুকু বললে মোটেও সুবিচার করা হবে না ক্রিকেটার রফিকের নামের প্রতি। লড়াই শব্দটা বাংলাদেশ ক্রিকেটে সবচেয়ে মানানসই রফিকের সঙ্গেই। ১৯৯৯ এর বিশ্বকাপের আগে বিমানবন্দরে রফিকের সেই কথা, ‘মামু জান দিয়া দিমু’। দেশের জন্য জীবনশক্তির সবটুকু উজাড় করে দেয়ার মানসিকতায় রফিকের তুলনা শুধু রফিকই। এখনও রফিককে নিয়ে কোন জীবনী গ্রন্থ আমরা লিখতে পারিনি, এ ব্যার্থতার দায় আমাদেরই। সেই দিক থেকে বিবেচনা করলে দেবব্রতের ‘মাশরাফি’ জীবনী গ্রন্থটি সন্দেহাতীতভাবেই একটা মাইলফলক। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ক্রিকেটের যে আন্তর্জাতিক সাফল্য তার নিউক্লিয়াস মাশরাফি। সতীর্থদের আগলে রেখেছেন বড় ভাই সুলভ মানসিকতা দিয়ে। এক সুতোয বেঁধে রেখেছেন পুরো দলকে। সর্বোপরি বাংলাদেশের ড্রেসিংরুমকে একটা শান্তির জায়াগা হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন মাশরাফি। এমন একজন ব্যক্তিত্বকে ভবিষ্যতের জন্য ফেলে না রেখে চটজলদি করণীয় সম্পাদন করার জন্য আলাদাভাবে ধন্যবাদ পেতেই পারেন ‘মাশরাফি’ বইয়ের লেখক দেবব্রত মুখোপাধ্যয়।এআরএস/পিআর
Advertisement