মতামত

আমরা মরবো, কিন্তু কেমনে?

আমরা সবাই জানি মৃত্যু অনিবার্য সত্য। এই সত্যকে কেউ এড়াতে পারে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আমরা, এই বাংলাদেশিরা কীভাবে মরবো? সে কেবল সড়কে-মহাসড়কে অ্যাক্সিডেন্টে, লঞ্চ দুর্ঘটনায়, হাসপাতালের অপচিকিৎসায়, ভুল অপারেশনে, দূষিত পানি পান করে, কলেরা-ডায়রিয়ায়, বায়ুদূষণে, গাড়ির কালো ধোঁয়ায়, কার্বন নিঃসরণের ফলে, কল-কারখানার রাসায়নিক দূষণে, কর্মক্ষেত্রের দূষণে নাকি স্থবির হয়ে পড়তে থাকা মহানগর ঢাকার উন্নয়নের ধুলাবালি আর বায়ুতে জমে থাকা মিশ্রিত বস্তুকণায় ফুসফুস বন্ধ হয়ে? কোনভাবে আপনি মরতে চান আজই ঠিক করুন।

Advertisement

আপনি, আপনারা কোন পথে মৃত্যু চান আজই ঠিক করুন। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের (যদি স্বীকার করে কেউ তারাই ওই সব উপকরণের মৌলিক ও একমাত্র উৎপাদক ও এজেন্ট) কাছে নিবন্ধিত হোন মৃত্যুর পরোয়ানা চেয়ে। ঢাকাকে আমরা মৃত্যুর একটি অনন্য ফাঁদ হিসেবেও গণ্য করতে পারি।

কেন পারি, সে কথায় আসিবিজ্ঞান সাময়িকী ল্যানসেট চলতি সপ্তাহে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে `গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিজ ’ শিরোনামে। শুধু পরিবেশ দূষণের কারণে বিশ্বব্যাপী ২০১৯ সালে মারা গেছে ৯০ লাখ মানুষ। এর মধ্যে বাংলাদেশে মারা গেছে ২ লাখেরও বেশি মানুষ। দূষণে মৃত্যুর দিক থেকে বাংলাদেশ ছয় নম্বরে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১ বা ২ নম্বরে আছে। আমরা যে শীর্ষস্থান দখলে রাখতে চাই, এটা তারই একটি লক্ষণ! আমরা এই চেতনাকে `ওয়া ’ বলে অভিনন্দিত করতে পারি।

মানুষ বাঁচাতে না পারি, মারতে তো পারি আমরা হাজারে বিহাজারে, লাখে লাখে। এমনিতেই জনসংখ্যা বেশি হয়ে গেছে- এ-পথেও তো কিছু লোক কমানো যেতে পারে। আগে লাইগেশন, ভ্যাসেকটমি করে জনসংখ্যা রোধ করার চেষ্টা চলছিলো, নগরে-মহানগরে সুশিক্ষিত মানুষজন জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল খেয়ে বা কনডম ব্যবহার করে নিজেদের পরিবার ছোটো করেছেন। সেই পদ্ধতি মহানগরে আজো সচল বলেই মনে করি বা ভাবতে ভালো লাগে।

Advertisement

গ্রামে বা মহানগরের বস্তিগুলোতে, দরিদ্র পল্লীর নিরক্ষর, অশিক্ষিত, অর্ধমিক্ষিত মানুষেরা কিন্তু জন্মনিয়ন্ত্রণের ধার-ধারছেন না। মাত্র ৫০/৫১ বছরে ৭ কোটি মানুষ কিভাবে ১৭/১৮ কোটিতে পৌছালো? একবার ভাবুন। আজ ঢাকা মহানগরে কোটি কোটি মানুষের বসবাসের কারণ কী? কেন ৮৫ হাজার গ্রামের মানুষ কাজের সন্ধানে ঢাকায় আসছে? গবেষণা করে বের করতে হবে এবং ঢাকার পরিবেশ রক্ষার একটি আয়োজন করতে হবে।

এটা হলো আমাদের আশার কথা। আমরা বাঁচতে চাই, তাই এ-ধরনের বাণী লালন করি এবং তা পাঠক জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে চাই। এই পাঠকই একমাত্র সেতু হতে পারেন আমাদের কথাগুলোকে নিরক্ষর মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে। প্রতিবেদনে পরিবেশদূষণকে বিশ্বে রোগ বিস্তারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ঝুঁকির কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। মাটি, পানি ও বায়ুদূষণের কারণে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ক্ষতি ও স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাবগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে প্রতিবেদনে। (প্রথম আলো/০৫/২১/২২)

বায়ু, পানি, সিসা ও কর্মক্ষেত্রে দূষণে মৃত্যু বেশি। এই চার উপকরণ-উপাদানে ওই বছর বাংলাদেশে মারা গেছে ২ লাখ ১৫ হাজার ৮২৪ জন। বাকি বছরের খবর তাদের হাতে নেই হয়তো। এই চারপ্রকার দূষণে ভারত শীর্ষে। তাদের মৃতের সংখ্যা ২৩ লাখ ৫৭ হাজার ২৬৭ জন। বায়ু দূষণে ভারত শীর্ষে, দ্বিতীয় বাংলাদেশ, তৃতীয় নেপাল, চার নম্বরে পাকিস্তান। পানিতে আর্সেনিক সমস্যায় বাংলাদেশ শীর্ষে, ভারত দ্বিতীয় আর তিন নম্বরে রয়েছে চীন। আর্সেনিকের কারণে ক্যান্সার, স্নায়ুজনিত রোগ, কিডনিজনিত রোগ ও হৃদরোগে প্রধানত মারা যাচ্ছে মানুষ। রিচার্ড ফুলার, যিনি এই প্রতিবেদনের প্রধান লেখক, তিনি বলেছেন নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো এই দূষণ ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি বয়ে বেড়াচ্ছে।

মি. ফুলার যে সব তথ্য দিয়ে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছেন, তাকে আমরা হেলা করতে পারি না। আমরা তো এর আগেই জেনেছি ঢাকার বায়ু দূষণের দিক থেকে এক নম্বর ছিলো, এখন দিল্লি মহানগর তা দখলে নিয়েছে। তবে আর্সেনিকের ক্ষতিটা আমরা ধরে রেখেছি এক নম্বরেই।, জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকিকে তোয়াক্কা না করেই। আর্সেনিকের শিকার মূলত দেশগ্রামের মানুষ। খাবার পানিতেই আর্সেনিকের থাবা গোটা দেশের মাটি আর পানিতেই। উৎপাদক কৃষকরাই এর থাবার নিচে।

Advertisement

আমরা জানি আর্সেনিক মিটিগেশেনের একটি প্রবল প্রচারণা চলছিলো দুই তিন দশক আগে। কিন্তু এখন ওই রকম কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি দু/চার বছরের মধ্যে। দেশের এনজিওগুলোর একটি প্রোগ্রামই তো ছিলো এই আর্সেনিক বিষ প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার। আর্সেনিকাক্রান্ত খাবার পানির টিউবওয়েলে লালরঙ দিয়ে চিহ্নিত করা তার একটি। আর সেই টিউবওয়েল যেন কোনো গ্রামীণ নারী-পুরুষ ব্যবহার না করেন, তার প্রচারণাও ছিলো ওই কাজে। কিন্তু আসের্নিকমুক্তকরণ বিষয়ে কি কি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিলো এবং তা আজো চলছে কি না, তার কোনো খোঁজ আমরা জানি না কেন? আমার ধারণা জনস্বাস্থ্য রক্ষার্থে সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় কি কোনো সচেতনতার কাজে যুক্ত নেই? নেই যে তা বোঝা যায়। না হলে দেশের সার্বিক আর্সিনিকিকরণের বিপদের এই চিত্র কেন বিজ্ঞান সাময়িকী ল্যানসেটের গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে আসবে? আমাদের সরকারের এই সচেতনতাটুকু থাকতে হবে যে, কৃষির মানুষজনেরাই আর্সেনিকের শিকার।

কৃষির উৎপাদন সচল, অব্যাহত ও পরিকল্পিত উন্নয়ন ধারণাকে বাস্তবায়ন করতে হলে, কৃষকের স্বাস্থ্য রক্ষা করা সব থেকে জরুরি কাজ। স্বাস্থ্যমন্ত্রী কি এটা জানেন না? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাগণ কি আর্সেনিকের বিষাক্ত থাবা নিয়ন্ত্রণে বা কমিয়ে আনার কাজে নিযুক্ত নেই? নাকি তারা কেবল এমন সব কাজে ব্যাপৃত, যেখান থেকে তারা ব্যক্তিগত লাভ অর্জন করবেন? তাদেরও মনে রাখা জরুরি যে উৎপাদক কৃষকেরাই তার বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশি, গ্রামের মানুষ এবং তারাই দেশের অর্থনৈতিক শক্তির প্রধান উৎস। কৃষকের স্বাস্থ্য মানেই দেশের কৃষির স্বাস্থ্য। কৃষির উন্নতি মানেই অধিকাংশ মানুষের সুস্বাস্থ্য ও জননিরাপত্তা ঝুঁকিমুক্ত।

আমরা জানি, প্রজ্ঞাবান কর্মকর্তারা এ-সবই জানেন, কেবল মানেন না, বা তার দায়িত্ব পালন করেন না বা করতে দেবার কোনো প্লান-পরিকল্পনা সরকারের নেই। ঠিক এ-কথাগুলোই বলা যায় ঢাকার বায়ুদূষণের ব্যাপারেও। কারণ ঢাকার বায়ু এতোটাই দূষিত যে তা নির্মল করতে বন্ধ করতে হবে এর উৎসপথগুলো। ল্যানসেটের রিপোর্টে যে সব ক্ষেত্র চিহ্নিত করা হয়েছে, তার মধ্যে কালো ধোয়া একটি। এর অন্যতম উৎস রাস্তায় চলাচলকারী গাড়ি, যাদের অধিকাংশই মেয়াদোত্তীর্ণ, লাইসেন্সবিহীন এবং ঘুষ দিয়ে সড়কে চলাচল করে। এরাই অ্যাক্সিডেন্টের হোতা। এরাই সড়কের হত্যাযজ্ঞের হোতা। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে কালো ধোয়ার উৎস বন্ধ করা যাবে না।

রাসায়নিক কারখানাগুলোও বায়ু দূষণের আরেক উৎস। সরকার ওই সব কেমিক্যাল কল-কারখানার ব্যাপারে নতুন প্রয়ুক্তির মাধ্যমে রিনোভেশনে আনার ব্যবস্থা নিলে বোধহয় এক্ষেত্রে কাজ হবে। উন্নয়ন প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রিতার কারণেও ঢাকার বায়ুতে ধুলাবালিসহ বস্তুকণার এতো বেশি আধিক্য। এই বস্তুকণা আমাদের নাগরিকের স্বাস্থ্যঝুঁকির প্রধান কারণ। রাজধানীর সরকাররি ও ব্যবসায়িক হাসপাতালগুলোর আর রোগী ধারণের কোনো ক্ষমতাই নেই। ব্যবসায়িক হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে রোগীকে বেডের বাইরে, ফ্লোরে বা বারান্দায় রাখে না। কিন্তু ঢামেকে বা সরকারি হাসপাতালগুলো বলতে গেলে টৈ-টুম্বুর অবস্থা।

এটা রোগাক্রান্ত জাতির পূর্বলক্ষণ কেবল নয়, আমরা যে স্বাস্থ্য নিরাপত্তার ব্যাপারে অসচেতন, এটা তারই প্রমাণ। আমরা যে স্বাস্থ্য সচেতন জাতি নই, হাজার হাজার সরকারি বেসরকারি বা ব্যবসায়িক হাসপাতাল ও বিপুল সংখ্যক ক্লিনিক, ডাক্তার থাকলেও স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত হয় না, মানুষ যাতে রোগাক্রান্ত না হয়, সেই সব উৎস পথ বন্ধ করতে হবে সব কিছুর আগে।

পুঁজিবাদী সমাজের প্যাটার্নটাই এমন যে একটার সঙ্গে অন্যটাকে যুক্ত করে ব্যবসাকে লাভের মৌলিক উৎকর্ষে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেবা যে বিক্রিযোগ্য পণ্য, তা যে জব ক্রিয়েটর ও প্রমোশনালও, সেটা আমরা আজো বুঝিনি। সয়াবিন তেলের ক্ষতি যে শর্ষের তেলের চেয়েও বেশি সেটা আমরা আজ মানবো না। হার্টের রোগ বা তেলের কারণে যে আমাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেড়েছে, সভ্য শিক্ষিত সমাজ এটা বোঝে না, মানেও না। বায়ুদূষণ, আর্সেনিক, সিসা ও কর্মক্ষেত্রে দূষণ ইত্যাদিই কেবল নয়, আমোদের জাতির স্বাস্থ্য রক্ষা করে একটি শক্তিশালী, সুস্থ জাতির মেরুদণ্ড পোক্ত করে গড়তে হলে এ-কাজগুলোই সবার আগে করা উচিত।

কী বলেন আপনারা প্রিয় পাঠকমহল, রাজনীতি সজাগ-সচেতন জনগণ?লেখক: কবি, সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/জিকেএস