মতামত

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গানটি শহীদ রফিকের লাশ দেখে লেখা’

গত চার দশকে যখনই লন্ডন গেছি তখনই আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেছি। তিনি আমার বাবার সঙ্গে চাকরি করেছেন। আমার বড় চাচা প্রয়াত বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের কৈশোরের বন্ধু। আমাকে দেখেছেন জন্ম থেকেই। সুতরাং আমি তাঁর স্নেহের পাত্র। কিন্তু তাঁর গুণেই আমাদের সম্পর্কটা হয়ে গেছে বন্ধুর মতো। আমি অনেকদিন তাঁকে বলেছি, একটি স্মৃতিকাহিনি লেখার জন্য। এর অনেকটাই তিনি লিখেছেন। প্রকাশিতও হয়েছে কাগজে। এসব মিলিয়ে একটি পাণ্ডুলিপি তৈরি করা এখনও তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি।

Advertisement

২০০১ সালের এপ্রিলে লন্ডনে গিয়েছিলাম কয়েকদিনের জন্য। তখন ঠিক করি তাঁর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করব। প্রথাগত সাক্ষাৎকার নয়। আমাদের সংস্কৃতির আন্দোলনকে সামনে রেখে পঞ্চাশ দশকের কথা জানতে চাইব। অন্য কথায় এই সাক্ষাৎকারটি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাসের উপাদান।

সময়ের টানাটানি আমাদের দুজনেরই ছিল। তবে, আমার অনুরোধ তিনি উপেক্ষা করেননি। ২৮ এপ্রিল থেকে ৩১ এপ্রিল (২০০১) এই তিন ঘণ্টার একটি সাক্ষাৎকার প্রদান করেন। তারই অংশ এখানে প্রকাশিত হলো। (ক্যাসেট থেকে অনুলিখন করেছেন জামালউদ্দিন ও শরীফা বুলবুল)

২৮ এপ্রিল শনিবার ২০০১ আজকের আলোচনায় আমরা প্রধানত জনাব চৌধুরী’র কাছে কয়েকটি বিষয়ে বিশেষভাবে জানতে চাইব। একটি হচ্ছে পঞ্চাশের সাহিত্য সাংস্কৃতিক আন্দোলন, তার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ বিশেষ করে ফেব্রুয়ারির আন্দোলন, তাঁর সেই বিখ্যাত গানের রচনাকাল, এরপর সাংবাদিক হিসেবে তিনি ’৭১ সাল পর্যন্ত যে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেটি, তৃতীয় পর্বে আমরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর যে যোগাযোগ ছিল দীর্ঘকাল সে বিষয়ে আমরা তাঁকে জিজ্ঞেস করব।

Advertisement

প্রথম পর্ব পড়ুন এখানেদ্বিতীয় পর্ব পড়ুন এখানে

মুনতাসীর মামুন: আমরা এতক্ষণ পঞ্চাশ দশকের সাহিত্য-সংস্কৃতিসেবীদের নিয়ে আলোচনা করেছি। এখন আলোচনা করতে চাই- একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলনে রাজনৈতিক ব্যক্তি বাদ দিয়ে সাহিত্য সংস্কৃতিসেবীদের অংশগ্রহণ, আপনার গান রচনা, গান রচনার পটভূমি এবং এর প্রতিক্রিয়া, এই বিষয়গুলোর ওপরে এক কথায় ভাষা আন্দোলনের সময় যখন আন্দোলন শুরু হয়, তখন আপনি যে গানটা রচনা করেছিলেন, তখন আপনার সহকর্মীরা বা শিল্পী সাহিত্যিকরা কী ভূমিকা পালন করেছিলেন?

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী: রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সঙ্গে আমি যুক্ত হই ১৯৪৮ সালে। ১৯৪৮ সালে জিন্নাহ সাহেবের সেই বহু কথিত উক্তির পরে ছাত্র সমাজে যে বিক্ষোভ দেখা দেয় বরিশালে তখন আমি স্কুলের ছাত্র। সেই বিক্ষোভ আমাদের স্পর্শ করেছিল। বিশেষ করে ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও আমরা ভেবেছি যে, যদি বাংলা ভাষাকে হারাতে হয় তাহলে আমাদের বাঙালি সত্তা থাকবে না। এই বোধটি যে কেমন করে আমাদের মাঝে জাগ্রত হয়েছিল ঠিক এখন তা আর ব্যাখ্যা করতে পারব না। উর্দুর প্রতি আমাদের কোনো ঘৃণা ছিল না। উর্দু পরিত্যাগ করতে হবে এ কথাও আমরা কিন্তু ভাবিনি। আমরা শুধু একটাই ভেবেছি যে, বাংলাকে হারানো চলবে না। ১৯৪৮ সাল গেল, ১৯৪৯ সালেও আমরা ৮ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করেছি। তখনও বাংলা ভাষার দাবিতে খুব মুষ্টিমেয় লোকে লেখা শুরু করেছেন। সরাসরি বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারটা তখনও তৈরি হয়নি। আমরা তখনও বাংলা প্রাদেশিক সরকারের ভাষা হবে এ ধরনের একটা দাবির ভেতরে ছিলাম। কালক্রমে পাকিস্তান সরকারের প্রচণ্ড বিরোধিতার মুখে এটা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হওয়ার দাবিতে পরিণত হয়। আসলে তখন বাংলাদেশের মানুষ চেয়েছিল বাংলা প্রাদেশিক সরকারের কাজকর্মের শিক্ষার ভাষা হোক, উর্দু হোক লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ শতাংশ অধিবাসী আমাদের ভাষাকে আমরা রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তুলি। প্রথমদিকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন নিয়ে যারা লিখেছেন তারা সবাই তরুণ লেখক। ড. শহীদুল্লাহ অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে বাংলা ভাষার দাবিকে সমর্থন করেছেন। তিনি প্রথমে একটু কূটনৈতিকভাবে কথা বলেছেন, ইসলামী ভাষাকে যদি করতে হয় রাষ্ট্রভাষা তাহলে আরবি করা হোক। আগা খান এসেছিলেন, এই আগা খান, নয় সেই পুরোনো আগা খান অতি বৃদ্ধ আগা খান কার্জন হলে বক্তৃতা দিয়ে বললেন উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করা যায় না, কারণ, ওটা পরাজিতদের ভাষা। মোগলরা ওটাকে তৈরি করেছিল এবং মোগল হচ্ছে ভারতের পরাজিত শক্তি এখন। এভাবে নানাভাবে উর্দুর ব্যাখ্যা চলল। মূলত পাকিস্তান সরকারের জেদের ফলে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে- বাংলাকে হিন্দু ভাষা প্রমাণ করতেই হবে, বাঙালি সংস্কৃতিতে আঘাত করতে হবে এবং বাঙালিকে মুসলমান বানানোর নামে তার নিজস্ব ভাষা এবং সংস্কৃতি থেকে দূরে ঠেলে দিতে হবে- এই একটি উন্মাদ গোয়ার্তুমি থেকে পাকিস্তানের তৎকালীন শাসকবর্গ চালিত হয় এবং তাদের পদলেহি কিছু বাঙালি যারা তখন মুসলিম লীগ করতেন তাদের অপচেষ্টার ফলে জনসাধারণের মনে ব্যাপকতর অংশে বাংলা ভাষার আবেদন, আবেগ ছড়িয়ে পড়ে।

ড. শহীদুল্লাহ লিখেছেন, বাঙলা ভাষার পক্ষে লিখেছেন মুহাম্মদ ওয়াজেদ আলী। সেই খুলনার প্রাবন্ধিক বাংলা ভাষার পক্ষে, জোরালো ভাষায় লিখেছেন, শিক্ষা কমিশনে বাংলা ভাষার পক্ষে সুপারিশ করেছেন তমদ্দুন মজলিশের অধ্যাপক কাসেম। তাদের সৈনিক পত্রিকায় বাংলা ভাষার পক্ষে লিখেছেন। শেষ পর্যন্ত ১৯৫২ সালে গুলি হওয়ার পরে দৈনিক আজাদের আবুল কালাম শামসুদ্দিনও বাংলা ভাষার পক্ষে জোরালো ভাষায় লিখতে শুরু করেছিলেন। বাংলা ভাষাকে নিয়ে একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলন দানা বাঁধে কিন্তু তরুণতর সাহিত্যিকদের বামপন্থি সাহিত্যিক, অগত্যা গ্রুপ, চট্টগ্রামের সীমান্ত গ্রুপ, বাংলা ভাষার পক্ষে একটা আপসহীন ভূমিকা নেয়। ঢাকায় আলাউদ্দিন আল আজাদ, হাসান হাফিজুর রহমান, তসিকুল আলম খাঁ, ফজলে লোহানী, বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর তখনকার যে গ্রুপটি এবং তখন প্রগতি লেখক সংগঠন ছিল মধুর রেস্টুরেন্টে। তারা বসতেন, ইউনিভার্সিটির টিনের ঘর ছিল, সেখানে সবাই এসে মাসে একবার জমায়েত হতেন। তার প্রতি সরকারের গোয়েন্দা বিভাগের নজর ছিল। এর পাশাপাশি আবার যদিও বাংলা ভাষাকে সরাসরি বিরোধিতা করে নয় ‘ইসলামী তমদ্দুন’ নামে একটা সাংস্কৃতিক সংঘ গড়ে ওঠে পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটির- সৈয়দ আলী আহসান, সৈয়দ আলী আশরাফ, মুজিবুর রহমান খাঁ, ফররুখ আহমদ এরা নিয়োজিত ছিলেন। তাঁরা কিন্তু বাংলা ভাষাকে আপস করেননি, বা বিরোধিতা করেননি কিন্তু বাংলা ভাষায় অনেক কথা, অনেক শব্দ মুসলমানি জীবন চর্চার বিরোধী একথাও হয়তো তাদের কেউ কেউ বিশ্বাস করতেন এবং ভাবতেন কমলা শব্দটি অরেঞ্জ এর বাংলা, সেটা লেখা ঠিক নয়, এটা হিন্দু দেব-দেবীর নামের সাথে সম্পর্কিত। তিনি লিখেছিলেন, নারং জীবনের কাছে সবুজ পাতা। কমলা লেবুর বর্ণনা বলে তিনি নারং লিখেছিলেন। এভাবে বাংলাকে ইসলামীকরণের নামে নানাভাবে বিকৃত করার চেষ্টা করা হয়েছে। আসলে কথা ছিল যে, এই বিকৃতির বিরুদ্ধে তরুণ বামপন্থি গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ লেখকরা সংঘবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। তাদের নিজেদের ভেতরে দলাদলি ছিল, ব্যক্তিগত দলাদলি, রাজনৈতিক দলাদলি।

Advertisement

আমি সেদিনও আলোচনা করেছি শামসুর রাহমানের কবিতার কথা, যে তিনি ঈশ্বর, জল এসব শব্দ ব্যবহার শুরু করেন। তার একটি গ্রুপ তৈরি হয়েছিল, তখন তারাও তাকে অনুকরণ করে, তারা কিছুটা সংস্কৃতঘেঁষা, মানে বাংলাদেশের আদি সাহিত্যের ধারাটি পূর্ণ প্রবর্তনের চেষ্টা করেন, যেমন- শামসুর রাহমান তার প্রথম কবিতার বইয়ের নাম রাখতে চেয়েছিলেন ‘মাধবী রাতের নদী’। এর আগ পর্যন্ত নানাভাবে কিছুটা উর্দু, ফার্সিঘেঁষা নাম রাখার যে প্রবণতা ছিল, যেমন- শওকত ওসমানের বনি আদম, ফররুখ আহমদের সিরাজুম মনিরা, এর বাইরেও বাংলা ভাষায় বের হতো কবিতার বই, গল্পের নাম যেমন আবুল হোসেনের নব বসন্ত, আহসান হাবীবের রাত্রি শেষ- তা সত্ত্বেও প্রবল ধারাটি ছিল ওই ধরনের ইসলামী নামকরণের দিকে বা উর্দু-ফার্সিঘেঁষা নামকরণের দিকে। পত্রিকা তো সবই তখন বাঙালি মুসলমানের পত্রিকা হলেই সেটা উর্দু, ফার্সি নাম হতে হবে, মোহাম্মদী, সওগাত, বুলবুল, আজাদ, ইত্তেহাদ, ইত্তেফাক সব নামই ছিল প্র্যাকটিক্যালি উর্দু-ফার্সিঘেঁষা। তা না হলে মনে হতো এটা বাঙালি মুসলমানের কাগজ নয়। দু-একটা ব্যতিক্রম ছিল সেগুলো জনপ্রিয় হয়নি, যেমন- জয়শ্রী, কবি আবদুল কাদির সম্পাদিত একটি পত্রিকা বা তমদ্দুন মজলিশের মাসিক দ্যুতি, এসব কাগজ তখন জনপ্রিয় হয়নি। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের বড় অবদান এই যে, শুধু দেশে তরুণ সমাজকে আন্দোলিত করল তা নয়, আমাদের সব সাংস্কৃতিক অবয়বটাকেই পরিবর্তিত করে দিল, যেমন- মুসলিম লীগের কাগজ, কিন্তু সে নাম নিয়ে বের হলো দৈনিক সংবাদ।

প্রথম যে সাহিত্য মাসিকটি বের হলো ঢাকা থেকে তার নাম সংকেত, কামরুল হাসান, আবদুল গণি হাজারীর গ্রুপ থেকে বের হলো ‘চন্দ্রবিন্দু’ অগত্যা, সীমান্ত। সব পত্রিকা কিন্তু ধীরে ধীরে বাংলা নামকরণের দিকে চলে গেল। আমাদের বাঙালি চেতনাকে তৈরি করার ব্যাপারে ধীরে ধীরে সেগুলো কাজ করতে শুরু করল। এমনকি পারিবারিক জীবনে সন্তানের নামকরণও বাংলায় এসে যেতে লাগল যেমন- বকুল, মুকুল, জোৎস্না, আফিয়া, বন্যা এসব নাম বাঙালি মুসলমানদের ঘরে ঢুকতে শুরু করল। আগের সেই আরবি শাস্ত্রের নামগুলো চলে গেল। সিনেমা হলের নাম পর্যন্ত বাংলা হওয়া শুরু করল। সেই ঢাকার নাগর মহল, মুকুল, মায়া এসব নাম তো দেশ ভাগ হওয়ার আগেই, পাকিস্তান হওয়ার আগেই ছিল। পত্রিকার নামও ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে গেল, সেটাকে আমি মনে করি যে বাংলা ভাষার আন্দোলনের পাশাপাশি একটা বড় রকমের সাংস্কৃতিক রেনেসাঁ। এটা পরবর্তীকালে বাঙালি জাতীয়তায় স্পষ্ট রূপ নিয়েছে। পঞ্চাশের শেষ দিকের যেই নতুন সাহিত্যগোষ্ঠী তৈরি হয় তার নাম তো আগেই বলেছি এবং সেটা মূলত তৈরি হয়েছিল পত্রিকার দিক থেকে।

মুনতাসীর মামুন: যে সময়টার কথা বললেন, সে সময় আমরা রাজনৈতিক বিষয়টিকে বড় করে দেখেছি, সাংস্কৃতিক কর্মীদের বিষয়টি নয়, যে কারণে মনে হতে পারে তাদের ভূমিকা ছিল গৌণ, ফলে এ দিকটায় গুরুত্ব দিয়ে যদি আলোচনা করেন, তাহলে ভালো হয়।

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী: বায়ান্ন সালের দিকে একটা চরম পরিণতি লাভ করে ভাষা আন্দোলন, তার মূল কারণ, এসময় নাজিম উদ্দিন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল। তিনি জিন্নার উত্তরসূরি, জিন্না বলেছিলেন উর্দু রাষ্ট্রভাষা হবে। এই নাজিম উদ্দিন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ছাত্র আন্দোলনকারীদের সাথে চুক্তি করেছিলেন তিনি বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য চেষ্টা করবেন। কিন্তু তিনি গভর্নর জেনারেল হয়ে যখন পাকিস্তানি গ্রুপের হাতে পড়লেন, তখন ঢাকায় এসে বললেন উর্দুই রাষ্ট্র ভাষা হবে। ফলে আবার আন্দোলন উগ্র হয়ে দাঁড়াল, যার পরিণতি আমি আর বিস্তারিতভাবে বলতে চাই না- যার পরিণতি হলো ২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখের সৃষ্টি, গুলিবর্ষণ এবং আমাদের বেশ কয়েকজন ভাষাসৈনিকের আত্মাহুতি। এর পরে ২১ শে ফেব্রুয়ারির ঘটনা কবিতা এবং গানের ভিতর দিয়ে প্রচারিত হতে থাকে। কারণ খবরের কাগজগুলো প্রথমে অতটা গুরুত্ব দিতে চায়নি সরকারের ভয়ে। এই যে সাধারণ পল্লীকবি, ভাষা আন্দোলনের কর্মী এদের ছড়া, গান সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। যেমন- একটি গান গুলিবর্ষণের সময়ে তৈরি হলো সেটি গাজিউল হকের- ‘ভুলবো না ভুলবো না, লাল ঢাকা রাজপথ ভুলবো না। ভুলবো না।’ এই গানটি কিন্তু জনপ্রিয় হয়েছিল। কিন্তু প্রভাতফেরিতে এই গানটি আসতে পারেনি তার একটি কারণ গানটার সুর ছিল হিন্দি সুরে। ‘দূর হতো ভাই দুনিয়া আলো-হিন্দুস্থান হামারা হ্যায়।’ এই গানের সুরটি এই গানে আসায় অনেকে আপত্তি করলেন যে, হিন্দু গানের সুরে রাষ্ট্রভাষার গান হতে পারে না। তখন কিন্তু অনেক গান, অনেক কবিতা লেখা হয়েছিল।

জার্মানির হানোভারে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সঙ্গে মুনতাসীর মামুন

আলাউদ্দিন আল আজাদ লিখেছেন, ‘স্মৃতির মিনার ভেঙেছো বন্ধু আমরা তো আছি সাত কোটি পরিবার’, খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল তার কবিতাটি, লিখলেন আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, কুমড়ো ফুলে ফুলে নুয়ে পড়েছে- তার সেই কবিতা এত আবেদনশীল হয়েছিল যে, পাড়ায় পাড়ায় আবৃত্তি করা হতো। ওবায়দুল্লাহ একটা গানও লিখেছিলেন- সেটা হচ্ছে, ‘আজি কে স্মরিও তারে- যারা প্রাণ দিল ভাষা বাঁচাবার তরে’। এই গানটি ১৯৫৩ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরিতে গাওয়া হয়। আমার গানটি যদিও ১৯৫২ সালে লেখা- শহীদ রফিকের লাশ দেখে ঢাকা মেডিকেল কলেজের আউটডোরের বারান্দায়। কিন্তু এটা কবিতা হিসেবে ছিল। আবদুল্লা আল মুতি শরফুদ্দিন গেণ্ডারিয়ার ধূপখোলার মাঠে- গোপন একটা বৈঠক করেন। সেখানে এই কবিতাটি পড়া হয়। এবং তারা একটি গোপন লিফলেট বের করেছিলেন। সেই লিফলেটে কবিতাটি ছিল। কি করে জানি না- বর্তমানে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম সাহেব এই কবিতাটি আমাদের সুরকার এবং শিল্পী আবদুল লতিফকে দেন। আবদুল লতিফ এই গানে সুর দেন। ওই বছরই ঢাকা কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের অভিষেক উৎসব। এবং অভিষেক উৎসবটি হয়েছিল এখন যেখানে গুলিস্তান সিনেমা হল তার পাশে কাঠের ঘরের মতো একটা সিনেমা হল ছিল। খুবই অভিজাত সিনেমা হল। নাম ছিল ‘ব্রিটানিয়া’। ইংরেজি ছবি দেখানো হতো। তার হলে ঢাকা কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের বার্ষিক উৎসব। সেখানে শিল্পী আব্দুল লতিফ এ গানটি গান। ফলে ১১ জন ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয়। তার মধ্যে আমি একজন, অবশ্য পরে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়। আমাদের বিরুদ্ধে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু ওই গানকে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। এই সভায় হাসান হাফিজুর রহমান, একুশের আন্দোলনের ওপরে একটি স্মরণিকা বের করার প্রচেষ্টা নেন এবং তার সঙ্গে যুক্ত হন ইয়ুথ লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নেতা মোহাম্মদ সুলতান। তার একটা ছোট লাইব্রেরি ছিল বকশিবাজারে। বর্তমান শহীদ মিনারের কাছে একটা ছোট টিনের ঘরে ‘পুঁথিপত্র’ নামে লাইব্রেরি ছিল। এই পুঁথিপত্রের নামে হাসান হাফিজুর রহমানকে যথেষ্ট কষ্ট করতে হয়েছে এই বই ছাপানোর টাকা সংগ্রহের জন্য।

তার বাবা জমিদার শ্রেণির লোক। চকবাজারে গুড়ের ব্যবসাও ছিল। সেখান থেকে টাকা এনে এবং প্রেসে টাকা বাকি রেখে নানারকম গালিগালাজ শুনে এই বইটি বের করেন। এবং তাতে রাষ্ট্রভাষার ওপরে, বাংলা ভাষার ওপর সবার লেখা কালেকশন করা হয়। কাগজটির প্রচ্ছদের বৈশিষ্ট্য ছিল মুর্তজা বশিরের উডকাঠ। ভাষা আন্দোলনের ওপরে তার আঁকা উডকাঠ। আমার গানটিও দেওয়া হয়। আমি নিষেধ করেছিলাম যে, এটা তো নিষিদ্ধ গান। এই বইটি বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নূরুল আমীন সরকার এটি নিষিদ্ধ করেন। পুঁথিপত্রের সেই টিনের ছাপড়া ঘরে পুলিশ হানা তল্লাশি করে সব বই নিয়ে যায়। কয়েকটি বই মাত্র ছিল। হাসানকে কিছুদিন পালিয়ে থাকতে হয়েছে। যারা লিখেছেন তাদের প্রতি গোয়েন্দা দপ্তর থেকে নামে এবং হুমকি প্রদর্শন এসব হয়েছে। এই যে কাজটি করলেন নূরুল আমিন সরকার- তাতে এই হলো একুশের এই স্মরণিকা গ্রন্থটি আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একটা প্রধান স্তম্ভ হয়ে গেল। নতুন কবিতা যেমন- চল্লিশের প্রভাবকে উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকাকেন্দ্রিক একটা নতুন কাব্যধারা তৈরি করেছিল। আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘ধানকন্যা’ একটা নতুন গল্পের মুড তৈরি করেছিল। হোক তা কাঁচা। তা ছিল মাটির রসে সিক্ত এবং তাতে তখনকার পূর্ব বাংলার মাটির গন্ধটা বেশ পাওয়া যেত। কবিতাও পাওয়া গেছে আজাদের গল্পও পাওয়া গেছে এবং এই একুশের গ্রন্থটি আরও বেশি সে সময়ে সেটি উজ্জীবিত করেছে। এবং এই গ্রন্থটি কেন্দ্র করে যে আন্দোলন হলো, সরকার নিষিদ্ধ করলেন তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হলো। তার মারফত বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনাটি ধীরে ধীরে অংকুরিত হতে শুরু করে। আমরা বাঙালি। এই যে আমরা পাকিস্তানি ছিলাম, আমরা পাঞ্জাবি, পাঠানদের সাথে একত্রে একটা জাতিসত্তায় মিলিত হতে পারি তাও যে অবাস্তব এই চেতনাটি আমাদের ভেতরে আসতে থাকে।

মুনতাসীর মামুন: আচ্ছা এখানে একটা প্রশ্ন করি। কথা হচ্ছে যে, আপনি তো বললেন যে, কবিতাটি গানে রূপান্তরিত, কবিতাটি আপনি কী পটভূমিতে লিখলেন, আপনি কীভাবে উজ্জীবিত হয়েছিলেন? আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর গান সম্পর্কে যেই তথ্যটি ছিল এটা আমাদের অনেকেরই জানা ছিল না। আপনার গানটি কবে থেকে প্রচারিত হতে শুরু করেছিল, কবে থেকে এবং তারপর থেকে নিয়মিত গাওয়া হতো প্রভাতফেরিতে এবং কি ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়েছিল বলে আপনি তখন মনে করেন?

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী: ১৯৫২ সালে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর গানটি গাওয়া হয় ‘ভাষা বাঁচাবার তরে’, কিন্তু গানটির প্রতি খুব একটা উদ্দীপনা ছিল না, লোকে খুব একটা আগ্রহবোধ করেনি। ওদিকে গাজী ভাইয়ের গানটি তো হিন্দিগানের সুরে থাকায় তখন নতুন গান খোঁজা হয়। তখন লতিফ ভাই গানটি সুর দিয়েছেন, এদিকে অনেক চেষ্টা করেছেন গাওয়া যায় কি না। এই সময়ে আকস্মিকভাবে করাচি থেকে আমাদের আলতাফ মাহমুদের আগমন ঘটে বরিশাল বাড়ি উনি এসে আমাকে বললেন যে, আমি গানটায় সুর দিতে চাই। আমি বললাম, লতিফ ভাই আপত্তি না করলে তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। লতিফ ভাই বললেন, হ্যাঁ আমার কোনো আপত্তি নাই, আমি কবিতা থেকে গানই করেছিলাম, এটা গৃহীত হয় সবার কাছে। উনি গানটার সুর দিলেন, সুরটা তাৎক্ষণিকভাবে সবার ভালো লেগেছে। সুরটা তার নিজের নয়। এই সুরটা চার্চ সঙ্গীত থেকে দেওয়া। এখন তার নয় বলাটা ধৃষ্টতা, কারণ, মুখবন্ধটা চার্চ সঙ্গীত থেকে নিয়ে বাণীটা বাঙালিকরণ করা হয়েছে। মুখবন্ধটা আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘তোমার হল শুরু- আমার হল সারা’, গানটার সংগীতি। মুখবন্ধটা চার্চ সংগীত থেকে সুর বাকিটা উনি নিজে দিয়েছেন। কিন্তু এটা সাংস্কৃতিকভাবে আদৃত হয়েছে। ১৯৫৪ সাল থেকে এই যে শুরু হলো এই গানটি (আমার ভাইয়র রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি) গাওয়া আর বন্ধ হয়নি। তারপর অবশ্য জহির রায়হান ভাষা আন্দোলন, আমাদের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন- স্বাধীনতার আন্দোলন, ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি করবে- তারা আমাকে বললেন যে, আমি দুটি গান মাত্র নেবো, ছবিতে, অভিনয় মঞ্চে আমার সোনার বাংলা এবং আপনার এই গানটি। ওই সময় উনি পর্দায় লিখলেন সংগীত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর- আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। আমি খুব লজ্জা পেয়েছিলাম। আমি বললাম এভাবে নাম দেওয়া ঠিক হয়নি। তা হয়ে গেছে দেওয়া হয়েছে- ওই ছবিতে দেওয়ার পর গানটি আরও পপুলার হয়। এতে আমার কোনো কৃতিত্ব নেই, Poet are Nothing but the Echo of the time. বোধহয় কোনো কারণে ওই বছরটিতে আমি অতি সাধারণ লোক হওয়া সত্ত্বেও Echo of the time হয়েছিলাম।

এটাই আমার ধারণা- যাক এই গানের কোনো কৃতিত্ব থাক বা না থাক আন্দোলনটা বাঙালি সংস্কৃতিকে নতুন জীবন দিয়েছে। ১৯৪০ সাল থেকে বাঙালি মুসলমানদের যে পশ্চাদপদতা শুরু হয়েছিল ধর্মের নামে, সংস্কৃতির নামে, যে আমরা নিজের দেশের আলো-বাতাসকে রেখে দিয়ে খেজুর বাগান দিয়ে কবিতা লেখা শুরু করা মরু আবাদ নিয়ে কবিতা লেখা শুরু করা, যা আমাদের জীবনে নেই, সে সব থেকে আমরা আবার আস্তে আস্তে নিজের মাটির দিকে নজর দিলাম। এটা বদরুদ্দীন উমর সঠিকভাবে বলেছে, বাঙালি মুসলমানের ঘরে ফেরা বা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন।

মুনতাসীর মামুন: এতক্ষণ আপনি ভাষা আন্দোলন এবং ৫০ দশকের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক আন্দোলন নিয়ে বললেন, ৪৭ থেকে ৬০ দশক পর্যন্ত ১৩ বছর, এই ১৩ বছর আপনি লেখালেখি করেছেন, যদিও কিছুদিন সে সময়ে সাংবাদিকতায় জড়িত ছিলেন, কিন্তু আপনার প্রথম পরিচয় ছিল যে ৫০ দশকের একজন ঔপন্যাসিক, কবি, সাহিত্যিক হিসেবে। কিন্তু এখন এই ৫০ দশকের অর্থাৎ যখন থেকে আপনি লেখালেখি শুরু করলেন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছাপা শুরু হলো, ৬০-দশক পর্যন্ত আপনার লেখালেখি সম্পর্কে যদি বলেন...

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী: আমার নিজের বা সে সময়কার লেখালেখির কথা বলতে গেলে বলব যে, আমি ষাটের দশককে একটা চূড়ান্ত ক্রান্তিকাল হিসেবে দেখি, পঞ্চাশ দশককে দেখি সৃষ্টির সূচনা। ষাট এবং সত্তর দশকটাকে একটা চূড়ান্ত পরিণতির দিকে দেখি। যেমন- বাংলা সাহিত্য রবীন্দ্রনাথের যুগে ত্রিশের দশকে বাংলা সাহিত্য একটা আধুনিক চেহারা নেয়। বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত, তারাশংকর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়- কথাশিল্পে কবিতায় একটা নতুন ধারা আসে, যাকে আমরা আধুনিক সাহিত্য বলি- রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক সাহিত্য। এই ধারাটা প্রথমে বাঙালি মুসলমানরা গ্রহণ করেনি। শিল্প সাহিত্যের ব্যাপারে তারা ধর্ম এবং সাম্প্রদায়িক গণ্ডির ভেতরে থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু কিছু আধুনিক কবিতা ভেঙেছেন, আহসান হাবীব, আবুল হোসেন, কিছুটা ফররুখ আহমদও এই ধারার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান। এই ৩০-এর ধারাটি পরিপক্বতা লাভ করার আগেই একটা বিরাট গণসাহিত্যের প্লাবন আসে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ভাঙাগড়ার ধাক্কায় সুকান্তের আবির্ভাব হয়। সুভাষ মুখোপাধ্যায়। ত্রিশের দশকের পরই আসলো গণসাহিত্যের ধারা। এটা মূলত যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তর এগুলোকে ভিত্তি করে সাহিত্যিকরা খুব বেশিভাবে গণজীবনের কাছাকাছি এলেন। তখনকার জয়নুল আবেদিনের যে দুর্ভিক্ষের ওপর আঁকা ছবি বা তারাশংকরের উপন্যাস, মানিক বন্দোপাধ্যায়ের গল্প এসবের পটভূমিতে আমাদেরও তিনজন কথাশিল্পী দাঁড়িয়ে গেলেন শওকত ওসমান, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এবং শামসুদ্দিন আবুল কালাম। শামসুদ্দিন আবুল কালামের ‘ভাঙন’ গল্পটি রীতিমতো চমক সৃষ্টি করেছিল, যুদ্ধ ও মন্বন্তরের ওপরে।

এই গণসাহিত্যের প্লাবনের মাঝামাঝি আমাদের সাহিত্য দ্বিখণ্ডিত হয়। একদিকে যারা জনগণের সঙ্গে খুব ঘেঁষাঘেঁষি ভালো পছন্দ করতেন না বুদ্ধদেব বসুর বা জীবনানন্দ দাশের কবিতার বেলায় অনুরাগী। ঢাকায় থেকে শামসুর রাহমান তার নেতৃত্ব দিতেন। অন্যদিকে সুকান্ত, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের গণজীবনের কাছাকাছি বলিষ্ঠ ধারাটিতে আসলেন হাসান হাফিজুর রহমান এবং তাঁর সঙ্গী যারা ছিলেন তাঁরা। কিন্তু প্রকরণের দিক বা ইমেজের দিক থেকে আলাদা হলেও গণচেতনার দিক থেকে এরা খুব কাছাকাছি ছিলেন। হাসানের বিরুদ্ধে যেমন অভিযোগ উঠতো দুর্বোধ্য কবিতা লেখার, শামসুর রাহমানের সম্পর্কেও তেমনি প্রশংসা হতো উনি জনগণের কবিতা লেখার চেষ্টা করছেন। তিনি লিখলেন ফুল পাখি চাঁদ নিয়ে অনেক কবিতা লিখেছি মানুষের কথা কখনও ভাবিনি। এ সময় আমাদের বুদ্ধিজীবীদের ওপর বাংলাদেশের ও কলকাতার প্রগতিশীল লেখক আন্দোলনের যে বিরোধ তা অনেক প্রভাব বিস্তার করে। আবু সৈয়দ আইয়ুব, গোপাল হালদার এঁরা প্রগ্রেসিভ রাইটার এসোসিয়েশন থেকে সরে যান। তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়রা সরে যান অন্যদিকে। একটা উগ্র মার্কসবাদী সাহিত্যধারা তৈরি হয়।

তাদের সঙ্গে গোলাম কুদ্দুসসহ আরও অনেকে ছিলেন। বাংলাদেশে, যদিও তখন আমরা পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আলাদা হয়ে গেছি, প্রভাব কিন্তু আমাদের ওপরও বর্তেছে। শামসুর রাহমান জীবনানন্দের ধারায় এগিয়েছেন, হাসান আরেক ধারায় গিয়েছিলেন, যদিও তারা দুজনে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। ষাটের দশকে এসে দেখা গেল বাংলাদেশে এই যে দুটি ধারা একদিকে জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, আরেক দিকে সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুকান্ত, এই ধারাটি এসে কিন্তু একটা স্রোতে একটা আধুনিক বেগবতি ধারা হয়েছে, যার সঙ্গে জনজীবনেরও সম্পর্ক আছে আবার নান্দনিক তাৎপর্যও আছে। শামসুর রাহমানের কবিতায় যেমন শাসকদের প্রতি প্রতিবাদ আছে জনগণের প্রতি ভালোবাসা আছে, তাদের সংগ্রামের প্রতি আনুগত্য আছে, তেমনি আবার তার কবিতায় শিল্পের বোধ, সেটি অটুট আছে। হাসান হাফিজুর রহমানের কবিতায়ও দেখা গেল, আলাউদ্দিন আল আজাদের কবিতায়ও দেখা গেল এবং এই ধারার সম্মিলনের ফসল হিসেবে এক নতুন শক্তিশালী তরুণ কবি গোষ্ঠী তৈরি হলো। এদের ভেতরে আমরা বলতে পারি ষাটের দশকে যারা এসেছিলেন নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা।

মুনতাসীর মামুন: এখানে আমি একটু বলি- আপনার ইনভল্বম্যানটা, আপনি এই যে ’৪৭ সাল থেকে ৬০ পর্যন্ত ১৩ বছরে কী ধরনের লেখালেখি করেছিলেন, কোন কোন কাগজে ছাপানো হয়েছিল, কারা উৎসাহ দিয়েছিলেন, ওই সময় কোনো গ্রন্থ বের হয়েছিল কি না, এই ধরনের অর্থাৎ আপনার সম্পৃক্ততার কথা জানতে চাচ্ছি।

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী: আমার একটা খুবই কষ্টসাধ্য ভূমিকা ছিল, আমি ঠিক হাসান হাফিজুর রহমানদের উগ্র মার্কসবাদী ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম না। আবার শামসুর রাহমানদের একেবারে নান্দনিক ধারার সঙ্গেও যুক্ত হতে পারিনি। এর মাঝামাঝি ধারাটি আমি পছন্দ করতাম। সেজন্য গ্রাম জীবন নিয়ে চেষ্টা করতাম। যেন স্লোগানভিত্তিক না হয়ে যায়। যেন তাতে কিছু শিল্পরস থাকে। যতটুকু পারি আমার সাধ্যমতো আমি চেষ্টা করেছি। তার ফলে এই নতুন মার্কসবাদী গ্রুপও আমার খুব সমালোচক ছিল, শামসুর রাহমানদের গ্রুপেরও ছিলেন, আমি মাঝখানে তাদের মতো শক্তিশালী কবি, সাহিত্যিক না হওয়া সত্ত্বেও আমি আমার স্বাতন্ত্র্য নিয়ে তা লিখেছিলাম। ১৯৫২ সালের আগে থেকে আমি গল্প লিখি, কবিতাও লিখি। বিভিন্ন কাগজে। তবে সাংবাদিকতা আমার গৌণ কাজ ছিল, মুখ্য কাজ ছিল না। ওইটা জাস্ট জীবিকা অর্জনের জন্য সেখানে সাংবাদিকতা করতাম। কলামিস্ট তখনও হইনি। প্রতি মাসে আমার গল্প ঢাকার কাগজ সওগাত, মোহাম্মদী, ‘মাহে নও’তে বের হতো। ‘সমকাল’ বের করলেন সিকান্দর আবু জাফর, তখন সব ধরনের লেখা শুরু করি এবং সমকাল থেকেই আমার বই বের হয়। সমকাল বের করল আমার ‘সম্রাটের ছবি’ আর প্রথম গল্প গ্রন্থ ‘কৃষ্ণপক্ষ’ বের হলো ইস্টবেঙ্গল পাবলিশার্স থেকে। আমার প্রথম দুটি বই একসঙ্গে বের হয় ১৯৫৮ সালে। তারপর আমার প্রথম উপন্যাস ‘চন্দ্রদ্বীপ উপাখ্যান’ ঢাকার দিলরুবা নামে একটি পত্রিকায় ১৯৫২ সালে বের হয়। তারপর শেষ হলো নির্যাস আরও অনেক উপন্যাস লিখেছি। আমার লেখার মূল উপজীব্য ছিল যে, আমরা আমাদের গ্রামকেন্দ্রিক জীবনটা ভাঙছি এবং শহরে এসে একটা নতুন মধ্যবিত্ত জীবন তৈরি হচ্ছে, এর মাঝামাঝি অবস্থার চিত্র আমার লেখায় আছে। ঠিক পুরো মধ্যবিত্ত জীবন নিয়ে লেখার তখনও আবহ তৈরি হয়নি, কারণ তখন বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণিই তৈরি হয়নি- ঢাকা শহর তখন ওই যে বড় গ্রাম-ফুটপাত ছিল না দুটো বাস ছিল। এই অবস্থার ভেতর আমরা কিছুটা কল্পনা, কিছুটা বাস্তব মিলিয়ে একটা মধ্যবিত্ত সমাজের ছবি আঁকার চেষ্টা করতাম, তা করেছি। আমাদের মধ্যে বোধহয় প্রথম পুরোপুরি মধ্যবিত্তভিত্তিক গল্প লেখা শুরু করেন সৈয়দ শামসুল হক তাঁর ‘তাস’ এবং অন্যান্য গল্পে। তার আগ পর্যন্ত মোটামুটি গ্রামীণ মধ্যবিত্ত নিয়ে এবং স্বল্পবিত্তের লোক নিয়ে, কৃষিজীবী লোক নিয়ে বেশি গল্প লিখেছি। আবার সম্রাটের ছবি থেকে গ্রামীণ মধ্যবিত্ত থেকে ধীরে ধীরে শহরের মধ্যবিত্তের ছবি আঁকার চেষ্টা করি। এবং জয়নুল আবেদিনের ছবি, পরে কামরুল হাসান আস্তে আস্তে শহরে মধ্যবিত্ত জীবনে চলে আসেন। আমার সম্পৃক্ততা সাহিত্য জগৎ থেকে কমতে শুরু করে যখন আমি রাজনৈতিক কলামিস্ট হিসেবে আবির্ভূত হই। এটা ওই ষাটের দশকে। আমি যখন আজাদে কাজ করি তখন এই ‘তৃতীয় মত’ লেখা শুরু করি। এই রাজনৈতিক কলাম জনপ্রিয় হয় এবং জীবিকা নির্বাহের জন্য এতবেশি তার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ি যে কারণে গল্প কবিতা লেখা অনেক কমে যায়।

[চলবে...]

এইচআর/জিকেএস