বিশেষ প্রতিবেদন

এবারও বাড়ছে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা, প্রণোদনায় বাড়তি নজর

করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও দেশের অর্থনীতি এখনো পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এর মধ্যে ওলট-পালট করে দিয়েছে পুরো বিশ্বের অর্থনীতি। এ অবস্থায় খাদ্যপণ্য ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এরই মধ্যে বেড়েছে মূল্যস্ফীতি। চাপে রয়েছে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি। এমন বাস্তবতায় দরজায় কড়া নাড়ছে আগামী (২০২২-২৩) অর্থবছরের বাজেট। শুরু হয়েছে বাজেটের নানা দিক নিয়ে আলোচনা।

Advertisement

অর্থ মন্ত্রণালয় ও রাজস্ব বোর্ড সূত্রে জানা যায়, বরাবরের মতো নতুন অর্থবছরের বাজেটেও বাড়ানো হচ্ছে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা। এবারও থাকছে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ, যদিও চলতি অর্থবছরে এটাতে খুব বেশি সাড়া মেলেনি। আগামী অর্থবছরের বাজেটে রেমিট্যান্সের ওপর প্রণোদনা বাড়ানোর প্রস্তাব এসেছে। পাশাপাশি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে যোগাযোগ ব্যবস্থায়।

চলতি (২০২১-২২) অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। যদিও রাজস্ব বোর্ডের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ পর্যন্ত আদায় হয়েছে দুই লাখ চার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব, যা লক্ষ্যমাত্রার ৬২ শতাংশ। ফলে বাকি তিন মাসে লক্ষ্যমাত্রার শতভাগ অর্জন নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এ বাস্তবতায়ও আগামী অর্থবছরে তিন লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করতে চায় এনবিআর, যা চলতি বছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১২ দশমিক ১২ শতাংশ বেশি।

জানা যায়, নতুন অর্থবছরে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) থেকে এক লাখ ৩৬ হাজার ৯শ কোটি টাকা আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। আয়কর ও ভ্রমণ কর খাতে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ২২ হাজার ১০০ কোটি টাকা। কাস্টমস বা আমদানি শুল্ক বাবদ আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা। নতুন এসব লক্ষ্যমাত্রা, চলমান লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ভ্যাটে ৬ দশমিক ২২ শতাংশ, আয়করে ১৬ দশমিক ৭৬ ও কাস্টমসে ১৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ বেশি।

Advertisement

তবে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনযোগ্য বলে মনে করছেন এনবিআর সদস্য (মূসক) আব্দুল মান্নান শিকদার। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত নয়। কোন খাত থেকে কত টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা যায় সে বিষয়ে কাজ করছি। তবে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনযোগ্য।

যদিও রাজস্ব আদায়ের এই লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবসম্মত নয় বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। ঢাকায় জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, রাজস্ব বোর্ড নিজেও জানে তাদের প্রস্তাবটা একটু উচ্চ লক্ষ্যমাত্রার। কয়েক বছর ধরেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হচ্ছে না। তারপরও বড় টার্গেট (লক্ষ্যমাত্রা) দিচ্ছে পরিকল্পনার জন্য। কিন্তু রাজস্ব আদায়ে যদি নতুন মেকানিজম (কৌশল) না হয় তাহলে এত বড় লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হবে না।

তিনি বলেন, এ বছরও যেমন বলা হচ্ছে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে, শেষে হয়তো ৭০-৭২ শতাংশ আদায় হবে। আসছে বাজেটে লক্ষ্যমাত্রা আরও বড়, নতুন কোনো কৌশল দেখাতে না পারলে চলতি অর্থবছরের মতোই অবস্থা হবে। কাজেই জিডিপির যে প্রবৃদ্ধি এখন হচ্ছে, মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধি দেখছি। এটাকে (প্রবৃদ্ধি) কর আদায়ের ক্ষেত্রে আনার ব্যাপারে রাজস্ব বোর্ডের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা দরকার। তা না হলে এটা কেবল একটা লক্ষ্যমাত্রাই থেকে যাবে।

আগামী অর্থবছরেও কালোটাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রাখা হতে পারে। এখন নির্দিষ্টহারে কর দিয়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ ও জমি-ফ্ল্যাট কিনে নগদ কালোটাকা সাদা করার সুযোগ আছে। আগামী ৩০ জুন শেষ হচ্ছে (যদি আর বাড়ানো না হয়) এ সুযোগ। যদিও চলতি অর্থবছর অপ্রদর্শিত অর্থ (কালোটাকা) বিনিয়োগে তেমন সাড়া মেলেনি। গত বছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৬৯৪ জন কালোটাকা সাদা করেছেন। এর মধ্যে ৫৫৮ জন ফ্ল্যাট ও জমির মালিক কালোটাকায় কেনা সম্পদ দেখিয়েছেন। ১২৩ জন করদাতা তাদের নগদ টাকা কিংবা সঞ্চয়পত্র ও এফডিআরের টাকা সাদা করেছেন। এছাড়া কালোটাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছেন মাত্র ১৩ জন।

Advertisement

আগামী ৯ জুন ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট জাতীয় সংসদে উত্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ মুস্তফা কামাল। দেশের ৫১তম, আওয়ামী লীগ সরকারের ২২তম এই বাজেটে গুরুত্ব পাচ্ছে দেশের অবকাঠামো, সামাজিক সুরক্ষা, কৃষি ও কর্মসংস্থান। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জানিয়েছেন, বাজেটে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে ৩ শতাংশ হারে প্রণোদনা দেওয়া হবে, যা বর্তমানে আড়াই শতাংশ রয়েছে। প্রতিবন্ধীদের ভাতা ৭৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার টাকা ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় সব ধরনের ভাতাভোগীর সংখ্যা বাড়ানো হবে।

বর্তমানে করপোরেট করের হার লিস্টেড ও ননলিস্টেড কোম্পানির জন্য যথাক্রমে ২২ দশমিক ৫ শতাংশ ও ৩০ শতাংশ রয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের তুলনায় বেশি বলে ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন। করোনা-পরবর্তী সময় ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য এখনো আপন গতিতে পৌঁছাতে পারেনি। এ অবস্থায় উচ্চ করপোরেট করহার বড় বাধার সৃষ্টি করছে বলে ব্যবসায়ীরা প্রাক বাজেট আলোচনায় জানিয়েছেন। এমন বাস্তবতায় আগামী বাজেটে করপোরেট করহার ২ দশমিক ৫ শতাংশ কমানো হতে পারে বলে রাজস্ব বোর্ড সূত্রে জানা গেছে।

এসএম/কেএসআর/এএসএ/এএসএম