শঙ্কাটা ছিল করোনার সময়। করোনার আক্রমণে গোটা বিশ্ব যখন থমকে দাঁড়ায়, তখন স্থবিরতা নেমে এসেছিল অর্থনীতিতেও। স্থবির না হয়ে অবশ্য উপায় ছিল না। মাসের পর মাস বিশ্বের অধিকাংশ দেশ লকডাউনে ছিল। ফলে বন্ধ ছিল সবকিছুই। স্বাস্থ্যখাতে, টিকা উৎপাদন ও বিতরণে বিপুল ব্যয় হয়েছে।
Advertisement
আশঙ্কা করা হচ্ছিল, করোনার এই স্থবিরতা বিশ্বকে বড় ধরনের অর্থনৈতিক মন্দার দিকে নিয়ে যাবে। তবে যতটা আশঙ্কা করা হয়েছিল, বিশ্ব অর্থনীতি করোনার ধাক্কা সামলে উঠেছে তারচেয়েও দ্রুতগতিতে। এখনও করোনার প্রভাব থেকে বিশ্ব অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
গোটা বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশও করোনার প্রভাব থেকে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে এগিয়ে আছে ভালোভাবেই। বরং করোনা মোকাবেলায় বাংলাদেশের দূরদর্শিতা প্রশংসিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মহলেও।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, বিশ্ব এখন আরো বড় অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। দুঃখটা হলো, প্রকৃতি সৃষ্ট দুর্যোগ আমরা সাফল্যের সঙ্গে সামাল দিতে পারলেও মানুষের লাগানো যুদ্ধ আমরা থামাতে পারছি না। আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতি এখন ভয়ঙ্কর এক সময়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
Advertisement
কে আগে আক্রমণ করেছে, কার দোষ বেশি ইত্যাদি নিয়ে অনেক বিশ্লেষণ হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তিনমাস ধরে বিশ্ব একটি যুদ্ধ পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে। ঠুঁটো জগন্নাথ জাতিসংঘ যুদ্ধ বন্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি।
গোটা বিশ্ব এখন এমনভাবে সংযুক্ত বিশ্বের যে প্রান্তেই যুদ্ধ বা অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হোক, কোনো না কোনো মাত্রায় তার প্রভাব পড়ে বিশ্বের সব প্রান্তে। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়ে একদম প্রান্তে থাকা গরিব মানুষগুলো। যেমন ধরুন, যুদ্ধ হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে, কিন্তু সেই বাংলাদেশও এক কঠিন সঙ্কটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব যুদ্ধক্ষেত্রে যতটা পড়েছে, অন্যান্য ক্ষেত্রে তারচেয়ে কম পড়েনি। বিশেষ করে বাজারে প্রভাব পড়েছে সবচেয়ে বেশি। জ্বালানি তেল, ভোজ্য তেল, খাদ্যপণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থায় যে লণ্ডভণ্ড পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, সাম্প্রতিক ইতিহাসে তার কোনো নজির নেই। সব দেশই নিজ নিজ ঘর সামলাতে ব্যস্ত। তাই টান পড়েছে সরবরাহে। ফলে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে।
বাংলাদেশে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে কারণে ও অকারণে। মজুদদারদের দৌরাত্ম্য, ব্যবসায়ীদের অস্বাভাবিক লাভের লোভের কারণেও জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে অতীতে। এ ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা, অব্যবস্থাপনাও অনেকাংশে দায়ী। তবে বর্তমানে বাজারে যে অস্থিরতা, তারজন্য সরকারের দায় যতটা, অসহায়ত্ব তারচেয়ে বেশি।
Advertisement
আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এসন আমাদের এমন জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে, সরকারের ব্যর্থতার ওপর দায় চাপিয়ে পার পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদরাও ভবিষ্যতে আরো বড় সঙ্কটের আশঙ্কা করছেন। জাতিসংঘ মহাসচিবও খাদ্যসঙ্কটের আশঙ্কা করছেন। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ এবং মোকাবেলায় আমাদের সবাইকে, মানে বিশ্বের সবাইকে কৌশলী হতে হবে।
ব্যাপারটা এমন নয় যে, বাংলাদেশই শুধু সঙ্কটে পড়েছে, আমরাই বুঝছি, আর কেউ বুঝছে না। সঙ্কট মোকাবেলায় নানামুখি চেষ্টা চলছে। জাতিসংঘ মহাসচিবের আমন্ত্রণে গত শুক্রবার রাতে খাদ্য, জ্বালানি ও অর্থসংক্রান্ত ‘গ্লোবাল ক্রাইসিস রেসপন্স গ্রুপের (জিসিআরজি)’ প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বৈঠকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সঙ্কট মোকাবেলায় নানা প্রস্তাব দিয়েছেন। মোদ্দা কথাটা শেখ হাসিনা বলে দিয়েছেন সহজ করে, ‘আমাদের অবশ্যই বিশ্বব্যাপী সংহতি জোরদার করতে হবে এবং একটি সুসমন্বিত প্রতিক্রিয়া গ্রহণ করতে হবে।’
আরেকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব দিয়েছেন শেখ হাসিনা, ‘বৈশ্বিক লজিস্টিক এবং সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যবস্থায় ব্যাঘাত তাৎক্ষণিকভাবে মোকাবেলা করতে হবে। বৈশ্বিক সংহতি জোরদার করা ছাড়া আসলে এই সঙ্কট উত্তরণের কোনো সুযোগ নেই। অপ্রয়োজনে যাতে কেউ নিত্যপণ্য রপ্তানি বন্ধ করতে না পারে বা যাতে কেউ অতিরিক্ত আমদানি করে স্টক করতে না পারে; সেদিকে নজর দিতে হবে।
মুক্তবাজার অর্থনীতির দোহাই দিয়ে যাতে বৈশ্বিক বৈষম্য আরো বাড়ানো না হয়। করোনার টিকার জন্য গড়ে তোলা কোভ্যাক্সের মত জাতিসংঘের নেতৃত্বে একটি ভার্চুয়াল খাদ্যব্যাংক গড়ে তোলা যেতে পারে। জাতিসংঘ মহাসচিব যে খাদ্যসঙ্কটের আশঙ্কা করছেন, তা থেকে বিশ্বের গরীব মানুষকে বাঁচাতে এর কোনো বিকল্প নেই। এই ব্যাংক খুঁজে দেখবে, কোথায় খাদ্যের সঙ্কট আছে, আর কোথায় অতিরিক্ত খাদ্য আছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সরাসরি প্রভাব যেমন আছে, শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তান সঙ্কটের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবও পড়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। সবকিছুর দাম বাড়লেও শেয়ারবাজারে দাম শুধু কমছে। কোনো সরাসরি প্রভাব না থাকলেও বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে যেন আতঙ্ক ভর করেছে। কিছু আতঙ্ক আছে আমাদের বানানো। ডলারের সঙ্কট আর মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব মোকাবেলায় নানামুখী উদ্যোগও নিচ্ছে সরকার।
এরইমধ্যে সরকারি কর্মচারিদের বিদেশ যাওয়া বন্ধ করা হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণে সতর্ক হচ্ছে সরকার। গত সপ্তাহে একটি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী সবাইকে মিতব্যয়ী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু সমস্যা হলো, আমরা কারো পরামর্শ শুনতে চাই না। সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী যখন দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় কম খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন, আরো অনেকের মত আমিও ফারুক খানকে ব্যঙ্গ করে ‘কম খান’ বলেছি।
গত রমজানে শেখ হাসিনা যখন ইফতার সামগ্রীতে উচ্চমূল্যের বেগুনের বদলে মিষ্টি কুমড়া ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছিলেন, তখনও আমরা সর্বোচ্চ সৃজনশীলতা প্রয়োগ করে ট্রল করেছি। প্রধানমন্ত্রীর মিতব্যয়ী হওয়ার পরামর্শ নিয়েও আমাদের মাথাব্যথার কমতি নেই। স্বাভাবিক সময়ে নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আমিও সরকারের সমালোচনা করি। কিন্তু এখন পরিস্থিতি সত্যি ভিন্ন।
এখন আর শুধু সরকারের ব্যর্থতার সমালোচনা করে পেট ভরবে না। আমরা আন্দোলন করে সরকার বদলে ফেলতে পারবো, কিন্তু পরিস্থিতি বদলাতে পারবো না। কারণ পরিস্থিতির ওপর বর্তমান সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে, আরো বাড়তে পারে। তাই এই মুহূর্তে শুধু আমাদের নয়, গোটা বিশ্বকেই মিতব্যয়ী হতে হবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়ানো। কিন্তু আমদানি-রপ্তানির হিসেবে ডলারের রিজার্ভে টান পড়ছে। এখনও রপ্তানি বাড়ছে, রেমিট্যান্সও আসছে। তাই এক্ষুণি কোনো সঙ্কটের আশঙ্কা নেই। কিন্তু ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। তাই নিত্যপণ্যে শুল্ক কমিয়ে বিলাস পণ্যে শুল্ক বাড়াতে হবে। শুল্ক পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে হবে, প্রয়োজনে অতি বিলাসপণ্য আমদানি বন্ধ করে দিতে হবে।
করোনার সময় যেমন আমরা নাক ভাসিয়ে মৌলিক চাহিদা মিটিয়ে বেঁচে থাকতে শিখেছি, সেই শিক্ষাটা আবার প্রয়োগ করতে হবে। আমার অর্থ আছে, আমি যা ইচ্ছা তাই করতে পারবো; এই ভাবনা থেকে বেরিয়ে সামগ্রিকভাবে ভাবতে হবে। সঙ্কটে ভয় পেলে চলবে না, মোকাবেলা করতে হবে সাহসের সাথে। বেঁচে থাকতে হবে সবাইকে নিয়ে। ২২ মে, ২০২২
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/জিকেএস