বিশেষ প্রতিবেদন

কলকাতায় আটকা ১৫ নাবিকের দেশে ফেরা নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা

কলকাতা বন্দরে দুর্ঘটনাকবলিত জাহাজ ‘এমভি মেরিন ট্রাস্ট-০১’ এর ১৫ বাংলাদেশি নাবিকের দেশে ফেরা নিয়ে অনিশ্চয়তা এখনো কাটেনি। প্রায় দুই মাস ধরে আটকে আছেন তারা। নাবিকদের দেশে ফেরার বিষয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য দিতে পারছেন না বাংলাদেশ নৌপরিবহন অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর কর্মকর্তারা। তবে ক্ষতিপূরণ নিয়ে সমঝোতা না হওয়া ও নাবিকরা একসঙ্গে সবাই দেশে ফিরতে চাওয়াও বিলম্বের কারণ বলছেন কেউ কেউ।

Advertisement

গত ২৯ এপ্রিল সন্ধ্যায় জাহাজটির মালিকপক্ষ আটকেপড়া নাবিকদের ৭-৮ দিনের মধ্যে দেশে ফিরিয়ে আনার আশ্বাস দেন। এরপর পেরিয়েছে আরও তিন সপ্তাহ। এখনো এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিদ্যমান ‘প্রটোকল অন ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রানজিট অ্যান্ড ট্রেড’র (পিআইডব্লিউটিটি) আওতায় কোস্টাল শিপিং চুক্তির মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে কনটেইনারবাহী জাহাজ চলাচল করছে।

জানা যায়, গত ২০ মার্চ ১৫ জন নাবিক চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ‘এমভি মেরিন ট্রাস্ট-০১’ জাহাজ নিয়ে কলকাতায় রওয়ানা দেন। সেখানে তারা ২৩ মার্চ পৌঁছান। ২৪ মার্চ সকাল ৯টায় কলকাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি বন্দরের ৫ নম্বর লটে পণ্যবাহী কন্টেইনার তোলা শেষে একপাশে কাত হয়ে উল্টে যায় জাহাজটি। এসময় নাবিকেরা দ্রুত জাহাজ থেকে নেমে পড়েন। জাহাজটিতে ২০ ফুটের ১২০টি ও ৪০ ফুটের ৪৫টি কনটেইনার ছিল। লোড কন্টেইনারগুলোর ওজন ছিল তিন হাজার ৮৯ মেট্রিক টন। ২৫ মার্চ কলকাতা থেকে জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছানোর কথা ছিল।

Advertisement

২৮ এপ্রিল বিকেলে ওই ১৫ নাবিক সাড়ে তিন মিনিটের একটি ভিডিওবার্তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপলোড করেন। ভিডিওবার্তায় তারা দেশে ফেরার আকুতি জানান।

দুর্ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জাহাজের প্রধান প্রকৌশলী ফাহিম ফয়সাল জানান, কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের মেরিন ক্লাব হোটেলে (সি-ম্যান হোস্টেল) রেখেছে। সেখানে তাদের পাসপোর্টও নিয়ে নেওয়া হয়েছে। দীর্ঘ এক মাস ধরে তারা অবরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ১৫ নাবিকের আকুতির এই ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর নড়েচড়ে বসেছে দুই দেশের প্রশাসন। এরপর তাদের দেশে ফেরানোর বিষয়ে যথাযথ সহযোগিতার অনুরোধ জানিয়ে ভারতীয় নৌপরিবহন অধিদপ্তরকে চিঠিও দেয় বাংলাদেশের নৌপরিবহন অধিদপ্তর।

এ বিষয়ে গত ২৯ এপ্রিল নৌ-বাণিজ্য দপ্তরের প্রিন্সিপাল অফিসার ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, কলকাতা বন্দরে আটকেপড়া ১৫ বাংলাদেশি নাবিককে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে নৌপরিবহন অধিদপ্তর কাজ করছে। এরই মধ্যে জাহাজটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা জাহাজের মালিকপক্ষকে নাবিকদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বলেছি।

Advertisement

এ বিষয়ে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএমওএ) সভাপতি ক্যাপ্টেন মো. আনাম চৌধুরী শুক্রবার (২০ মে) দুপুরে জাগো নিউজকে বলেন, ভারত-বাংলাদেশ নৌ প্রটোকলের মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারতের নির্দিষ্ট কয়েকটি বন্দর ও রুটে ইনল্যান্ড কোস্টাল ভ্যাসেলগুলো চলাচল করে। কয়েকটি কার্গো ও কন্টেইনার জাহাজও রয়েছে। কলকাতা বন্দরে দুর্ঘটনায় পড়া কন্টেইনার জাহাজ ‘এমভি মেরিন ট্রাস্ট-০১’ তাদের মধ্যে একটি।

তিনি বলেন, ভারত-বাংলাদেশ নৌ প্রটোকলের মাধ্যমে চলা নৌযানগুলো ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম কমপ্লায়েন্সের মধ্যে চলে না। তাদের ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম-নীতির শিথিলতা আছে। তারপরও এসব জাহাজে যে মানের মাস্টার ক্যাপ্টেন প্রয়োজন, তারচেয়ে কম মানের মাস্টার ক্যাপ্টেন দিয়ে চালানো হচ্ছে।

বিএমএমওএ সভাপতি বলেন, ভারত-বাংলাদেশ নৌ প্রটোকলের মাধ্যমে চলাচল করা ইনল্যান্ড কোস্টাল ভেসেলের ওয়ার্কার্সদের আলাদা সংগঠন আছে। তারা আমাদের মার্চেন্ট মেরিন অফিসারদের সংগঠনভুক্ত নয়। তারপরও ‘এমভি মেরিন ট্রাস্ট-০১’ জাহাজে আমার এক স্টাফের ছেলে কর্মরত ছিলেন। ওর জন্য আমি কাজ করছি। আমরা ডিজি শিপিংয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। জাহাজ মালিকপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। আমি প্রথমে আইটিএফকে (ইন্টারন্যাশনাল ট্রান্সপোর্ট ওয়ার্কার্স ফেডারেশন) সংযুক্ত করেছি। আইটিএল ওখানে নাবিকদের বিষয়ে খোঁজখবর রাখছে।

‘কলকাতা পোর্ট অথরিটি জাহাজের সিনিয়র চারজনকে রেখে অন্যদের দেশে পাঠানোর একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু পরে জাহাজের সব নাবিকই একসঙ্গে আসার জন্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে একটি চিঠি দিয়েছেন। এতে নতুন করে বিপত্তি তৈরি হয়েছে। এখন দুই দেশের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে কথাবার্তা চলছে। তবে কখন দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে সেটা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না।’

ক্যাপ্টেন মো. আনাম চৌধুরী অভিযোগ করেন বলেন, ইনল্যান্ড কোস্টাল ভেসেল ওয়ার্কার্সদের কিছু সংগঠন আছে। তারা ওয়ার্কার্সদের কাছ থেকে চাঁদা নেয়, কিন্তু কাজ করে না।

এ বিষয়ে ইনল্যান্ড ওয়াটার ভেসেল ওয়ার্কার্সদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন’র সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী আশিকুল ইসলাম পটল শনিবার (২১ মে) জাগো নিউজকে বলেন, কলকাতায় আটকেপড়া নাবিকদের দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। মূলত জাহাজটি কাত হয়ে পড়ার কারণে কলকাতা বন্দরের ভৌত কাঠামোর কিছু ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিপূরণের বিষয় নিয়ে জাহাজের মালিকপক্ষ ও কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষের মধ্যে এখনো কোনো সমঝোতা হয়নি। তাছাড়া ওই জাহাজের নাবিকরা সবাই একসঙ্গে দেশে আসছে চাইছেন, যে কারণে তাদের দেশে ফেরা বিলম্বিত হচ্ছে।

তবে কবে তারা দেশে ফিরতে পারেন সে বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেননি তিনি।

আশিকুল ইসলাম পটল বলেন, আটকেপড়া নাবিকদের দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে জাহাজের মালিকপক্ষের গাফিলতি রয়েছে। জাহাজের মালিক বর্তমানে দেশের বাইরে রয়েছেন। সাহিকুল ইসলাম নামে একজন পরিচালক রয়েছেন। তার সঙ্গে আমার একবার কথা হয়েছে। ওই ভদ্রলোক আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগই করেননি।

তিনি আরও বলেন, আটকেপড়া নাবিকরা প্রথমে খাবার-দাবার নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। তারা বর্তমানে কলকাতা বোটক্লাবে রয়েছেন।

নৌপরিবহন অধিদপ্তরের চিফ ইঞ্জিনিয়ার অ্যান্ড শিপ সার্ভেয়ার মো. মনজুরুল কবীর জাগো নিউজকে বলেন, কলকাতা বন্দরে দুর্ঘটনাকবলিত ‘এমভি মেরিন ট্রাস্ট-০১’ এর নাবিকদের দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে ভারতীয় নৌপরিবহন অধিদপ্তরকে চিঠি দিয়েছি। তাছাড়া আমাদের নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ভারতে বাংলাদেশ হাইকমিশন, বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশনকে চিঠি দিয়েছে। এখন বিষয়টি আমাদের পর্যায়ে নেই। দুই দেশের উচ্চপর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে কলকাতায় আটকেপড়া নাবিকদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। আটকেপড়া নাবিকরা দেশে কখন ফিরতে পারেন সে বিষয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য।

তিনি বলেন, ভারত-বাংলাদেশ নৌ প্রটোকল চুক্তির আওতায় কন্টেইনার জাহাজ খুবই কম চলে। এর মধ্যে ১৪টির মতো অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এখন ৩-৪টির মতো কন্টেইনার জাহাজ চলাচল করছে। তার মধ্যে ‘এমভি মেরিন ট্রাস্ট-০১’ একটি। এই চুক্তির আওতায় একটি জাহাজ বাংলাদেশ থেকে ভারত যেতে কিংবা ভারত থেকে আসতে দুই দেশের অনুমতি লাগে। চুক্তি মেনেই জাহাজগুলো চলাচল করছে।

এ বিষয়ে কথা বলতে ‘এমভি মেরিন ট্রাস্ট-০১’ এর মালিকপ্রতিষ্ঠান মেরিন ট্রাস্ট লিমিটেডের পরিচালক ক্যাপ্টেন সাহিকুল ইসলাম ২৯ এপ্রিল জাগো নিউজকে বলেছিলেন, কোনো জাহাজ দুর্ঘটনায় পড়লে সংশ্লিষ্ট বন্দরেরও কিছু দায়বদ্ধতা, নিয়মকানুন রয়েছে। আইনি জটিলতা কাটিয়ে নাবিকদের দেশে ফেরাতে ৭-৮ দিন লাগতে পারে।

ইএ/এএসএ/জিকেএস