রোহিঙ্গা সমস্যার পাঁচ বছর প্রায় শেষ হতে চলছে, আর কিছুদিন পর তা ছয় বছরে পদার্পণ করবে। অনেক সময় গড়িয়ে গেলেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে প্রক্রিয়া প্রায় স্থবির হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে ক্যাম্পগুলোতে প্রতিবছর প্রায় ৩০ হাজার শিশুর জন্ম হয়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ত্রাণ, মানবিক কার্যক্রম এবং এ সম্পর্কিত সব বিষয়ের উপর এর প্রভাব পড়ছে। রোহিঙ্গা সমস্যা একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা এবং এই সমস্যা সমাধান বাংলাদেশের একার পক্ষে কখনো সম্ভব না। রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনেক আলোচনা হয়েছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে, এত কিছুর পরও এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হয়নি।
Advertisement
বর্তমানে জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তথা সারা বিশ্বের মনোযোগ রাশিয়া এবং ইউক্রেন যুদ্ধের দিকে কেন্দ্রীভূত রয়েছে। চলমান এই বৈশ্বিক সংকটের আড়ালে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ রোহিঙ্গা সমস্যা কিছুটা হলেও পেছনে পড়ে যাচ্ছে। রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধে এ পর্যন্ত ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ৬১ লাখের বেশি শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে৷ ইউএস এবং পশ্চিমা বিশ্ব উদার হাতে ইউক্রেনকে সামরিক, মানবিক ও অন্যান্য সহায়তা প্রদান করছে। ই ইউ ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের জন্য মানবিক কার্যক্রম ও আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ইউক্রেনীয়রা ইউরোপীয় এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এই মানবিক ইস্যুতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে।
ত্রাণ সহায়তার একটা বড় অংশ এই সমস্যা সমাধানে ব্যবহার হলে এর প্রভাব পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের উদ্বাস্তু সমস্যা মোকাবেলায় প্রদত্ত সাহায্যের উপর চাপ ফেলতে পারে। যুদ্ধের কারণে সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি হলে মানবিক সাহায্য কার্যক্রম পরিচালনা ব্যয় বেড়ে যাবে। রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় ২০২১ সালে জয়েন্ট রেসপন্স প্লানের হিসাবে রোহিঙ্গার জন্য ৯৪৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তার প্রয়োজন ছিল, এর বিপরীতে পাওয়া গেছে ৬৭৪ মিলিয়ন ডলার যা প্রয়োজনের তুলনায় ২৮ ভাগ কম৷
২০২০ সালের পর থেকে এই সহায়তার পরিমাণ গড়ে ৭০ ভাগের বেশি পাওয়া যাচ্ছে না৷ ইউরোপে শরণার্থী বেড়ে যাওয়ায় রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের দিকে তাদের মনোযোগ কমে যেতেই পারে। এর সুদূর প্রসারী প্রভাব যেন বাংলাদেশে আশ্রিত ১১ লাখ রোহিঙ্গার উপর না পড়ে এজন্য আমাদেরকে সচেষ্ট থাকতে হবে। প্রতিনিয়ত এই সংকটের বিষয়ে আলোকপাতের মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশকে কূটনৈতিক যোগাযোগ বাড়াতে হবে এবং সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন ফোরামে তা শক্তভাবে তুলে ধরে এই ইস্যুটিকে চলমান রাখতে হবে।
Advertisement
কক্সবাজারের ওপর চাপ কমাতে বাংলাদেশ সরকার ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় এ পর্যন্ত প্রায় ২০ হাজার রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নেওয়া হয়েছে। আরও ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে সেখানে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। প্রথমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের বিরোধিতা করলেও জাতিসংঘের সঙ্গে চুক্তির পর এখন সেখানে বিদেশি অর্থায়ন শুরু হয়েছে।
জাপান ভাসানচরের রোহিঙ্গাদের সহায়তায় দুই মিলিয়ন মার্কিন ডলার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এর মধ্যে ইউএনএইচসিআর ও ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামকে এক মিলিয়ন ডলার করে সহায়তা দেওয়া হবে । ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের সহায়তার লক্ষে ২০২১ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ সরকার এবং জাতিসংঘের মধ্যে সম্পাদিত সমঝোতা স্মারকের আলোকে এই সহায়তা দিচ্ছে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় বাংলাদেশ সরকারের আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে নেয়া উদ্যোগর প্রশংসা করেছে জাপান।
রোহিঙ্গাদের বড় অংশ এখনো কক্সবাজারে রয়ে গেছেন। তাই কক্সবাজারের স্থানীয় জনগোষ্ঠীসহ সেখানকার রোহিঙ্গাদেরকেও সহায়তা করা দরকার। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করার বিষয়ে জাপান আগ্রহ প্রকাশ করেছে। সংকটের দীর্ঘমেয়াদি সমাধান শুধু বাংলাদেশের জন্য নয় বরং এ অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
মিয়ানমার আসিয়ানের সদস্য, রোহিঙ্গারা সমস্যা মিয়ানমারের সমস্যা। আসিয়ান দেশগুলোর সাথে মিয়ানমারের সম্পর্ক উষ্ণ ও হৃদ্যতাপূর্ণ, দেশগুলোর মধ্যে সুদৃঢ় অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে এবং বর্তমান পরিস্থিতিতেও তা অব্যাহত রয়েছে। সামরিক সরকারের ক্ষমতা গ্রহনের পর মিয়ানমারের পরিস্থিতি অশান্ত হলে ও মিয়ানমারে বৈদেশিক বিনিয়োগ থেমে নেই।
Advertisement
মিয়ানমারে বিনিয়োগকারী প্রথম সারির দেশগুলো হলো- সিঙ্গাপুর, চীন, থাইল্যান্ড, মার্সাল দ্বীপপুঞ্জ, হংকং, সাউথ কোরিয়া, ইউ কে, মালয়েশিয়া, ব্রুনাই, ভিয়েতনাম এবং ভারত। ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম দিকে পরিস্থিতি কিছুটা অবনতি হলেও চীন, জাপান, সাউথ কোরিয়া এবং সিঙ্গাপুরের বিনিয়োগ অব্যাহত থাকায় তারা পরিস্থিতি সামলে নিয়েছে। সেই সময় মিয়ানমারে চীন শীর্ষ বিনিয়োগকারী ছিল এবং এর পাশাপাশি একটি জাপানি কোম্পানি থেকে ৫১৬.৪ মিলিয়ন ডলার, সিঙ্গাপুরের চারটি বিনিয়োগ থেকে ৪৪২.২ মিলিয়ন ডলার, দুটি থাই উদ্যোগ থেকে ৭৫.৫ মিলিয়ন ডলার এবং দক্ষিণ কোরিয়ার পাঁচটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে ৬৬.১ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হয়েছিল।
এই দেশগুলো মিয়ানমারের অর্থনীতির উপর আন্তর্জাতিক চাপ থাকার পর ও অর্থনীতিকে সচল রেখেছে। আসিয়ান দেশগুলো রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এবং চলমান মানবিক সংকট মোকাবেলায় আরও জোরালো ভূমিকা নিতে পারে কারণ ব্যবসায়ীক স্বার্থের কারণে এই দেশগুলোর সাথে মিয়ানমারকে সুসম্পর্ক রাখতেই হবে। এই দেশগুলো মিয়ানমার সরকার এবং রাখাইনের রাজনৈতিক দল এবং জনগণ কে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে পুনরায় তাদের নিজেদের বাসভূমে গ্রহণ করার মত সহনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করার উদ্যোগ নিতে পারে। রোহিঙ্গা সমস্যার পাঁচ বছর অতিক্রম হতে চলল, অদ্যাবধি এই ধরনের উদ্যোগের কথা জানা যায় নাই।
আসিয়ান আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলোর আইন প্রণেতাদের একটি গোষ্ঠীর দ্বারা তৈরি করা একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে নেতৃত্বের অভাব এবং আরাকানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাত্রা উপলব্ধি করতে অক্ষমতার কারণে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সংকটের কার্যকরভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে ব্যর্থ হয়েছে আসিয়ান। এর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর কারণে আসিয়ান কার্যকরী ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেনি।
২৪ এপ্রিল ২০২১ তারিখে অনুষ্ঠিত আসিয়ান রাষ্ট্র প্রধানদের বৈঠকে চেয়ারম্যানের বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয় যে আসিয়ান রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি মোকাবেলায় মিয়ানমারের অব্যাহত প্রচেষ্টার গুরুত্বের ওপর জোর দেয়, যার মধ্যে রয়েছে স্বেচ্ছায়, নিরাপদ এবং মর্যাদাপূর্ণ পদ্ধতিতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা। রাখাইন রাজ্য থেকে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া কার্যকরভাবে সহজতর করতে পারে এমন সম্ভাব্য ক্ষেত্রগুলি চিহ্নিত করে রাখাইন রাজ্যের উদ্ভুত পরিস্থিতির মূল কারণকে মোকাবেলা করার প্রচেষ্টার গুরুত্বের ওপর আরও জোর দেন। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারকে রাজি করানোর জন্য আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সক্রিয় সহায়তা আশা করে।
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া প্রস্তাব এবং কফি আনান কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন হলে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়নের সাথে সাথে রোহিঙ্গাদের প্রতি তাদের মনোভাবের পরিবর্তন হতে বাধ্য। জাপানের সাথে মিয়ানমারের ঐতিহাসিক হৃদ্যতা এবং অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। জাপান বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের সহায়তা প্রদান করছে। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য পরিবেশ তৈরিতে জাপান গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।
বাংলাদেশ জাপানের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে অগ্রণী, সক্রিয় ও অর্থবহ ভূমিকা আশা করে। আসিয়ান ভুক্ত দেশগুলোর মানবিক কার্যক্রম পরিচালনার সক্ষমতা রয়েছে এবং এর সদস্য দেশগুলো রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ইস্যুতে আরও সক্রিয় ভূমিকা রাখলে সংকটের সমাধান আলোর মুখ দেখবে বলে আশা করা যায়।
বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক ভাবে এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছে, পরবর্তীতে চীনের সহায়তায় উদ্যোগ নেয়া হলেও এই পাঁচ বছরে অগ্রগতি প্রায় নেই বললেই চলে। এখন সময় এসেছে অন্য সুযোগগুলো কাজে লাগিয়ে দ্রুত এই সমস্যার সমাধানের পথ খোঁজা। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া গতিশীল করতে মিয়ানমার সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা, মিয়ানমারের জনগণ, মিয়ানমার ও আরাকানের স্থানীয় রাজনৈতিক দল, বৌদ্ধ সংগঠনগুলো, সুশীল সমাজসহ সবার মনোভাব ইতিবাচক হওয়া অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এই উদ্দেশ্য সামনে রেখে জাপান, আসিয়ান দেশগুলোর সক্রিয় ভুমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
জাপান ও আসিয়ান দেশগুলো রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় আর্থিক ও মানবিক সহায়তা বাড়াতে পারে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে মিয়ানমার সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মনোভাবের পরিবর্তনে অবদান রাখতে পারে। সামাজিকভাবে রোহিঙ্গাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য মিয়ানমার ও আরাকানের স্থানীয় রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও বৌদ্ধ সংগঠনগুলোকে সাথে নিয়ে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে পারে। এসবের পাশাপাশি মিয়ানমার সংবিধানে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বিষয়ক ইস্যু বিবেচনায় নিয়ে সরকারের সংবিধানে পরিবর্তন আনার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে পারে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গা সমস্যার দ্রুত সমাধান অত্যন্ত জরুরি এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শেষ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এই ইস্যুকে আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সজীব ও সচল রাখতে হবে। বাংলাদেশের দুই বড় প্রতিবেশি দেশ ভারত ও চীনের পাশাপাশি জাপান ও আসিয়ান দেশগুলো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আরও সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করলে প্রত্যাবাসনে প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে বলে আশা করা যায়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও এই সমস্যাকে গুরুত্ব দিয়ে তা সমাধানের জন্য এগিয়ে আসতে হবে এবং চলমান প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যার সম্মানজনক ও শান্তিপূর্ণ সমাধান সবার কাম্য তাই আমাদেরকে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে এবং সুযোগগুলো কাজে লাগাতে হবে।
লেখক: মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক।
এইচআর