ভ্রমণ

সাজেক ভ্যালি: মেঘের রাজ্যে ভ্রমণ

মাজহারুল ইসলাম শামীম

Advertisement

চিন্তা করুন তো, আপনি এখন ১৮০০ ফুট উঁচুতে দাঁড়িয়ে আছেন! আপনার অনুভূতি কেমন হতে পারে? এমনই এক স্থান পার্বত্য খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলার সাজেক ভ্যালি। যার চারপাশে শুধু মেঘের খেলা। মনে হয় যেন পৃথিবী ছেড়ে মেঘের দেশে চলে এসেছি। মাঝে মাঝে খুব কাছে এসে মেঘগুলো ছুঁয়ে দিয়ে শিহরণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। বাস্তবে এমনই হয়। চারপাশে সবুজ পাহাড়ের সমারোহ। ঠান্ডা বাতাস, পাহাড়ি মানুষ, হঠাৎ বৃষ্টি, হঠাৎ রৌদ। এ যেন প্রাকৃতির এক লীলাখেলা। আপনিও সাজেক ভ্যালি গেলে প্রকৃতির মায়ায় পড়ে যাবেন।

ফেনী থেকে আমরা ১৩ জন সকাল ৭টায় যাত্রা শুরু করি। উদ্দেশ্য সাজেক। যে সাজেকের গল্প এতদিন শুধু লোকমুখে শুনে এসেছি। এবার সেই স্বপ্ন সত্য হওয়ার পালা। বাস আমাদের সকাল সাড়ে ১০টায় নামিয়ে দেয় ‘দীঘিনালা’। সেখানে নেমে যেতে যেতে সকালের সাজেক ভ্যালির চান্দের গাড়ি ছাড়ার সময় শেষ হয়ে গেল। আমাদের বিকেলের গাড়িতে যেতে হবে। সাজেকে সকাল এবং বিকেলে চান্দের গাড়ি যায়।

সবাই মিলে একটি চান্দের গাড়ি ভাড়া করলাম ২ দিনের জন্য। দুপুরে যখন গাড়ি ছাড়ার সময় হলো; তখন সবাই গাড়িতে উঠে গেলাম। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ এবং পাহাড়ে সবুজের সমারোহ দেখে মুহূর্তে হারিয়ে গেলাম অন্য জগতে। উঁচু-নিচু পাহাড়ের মাঝে সাপের মতো আঁকাবাঁকা রাস্তায় গাড়ি সামনে এগিয়ে যেতে লাগলো। এ দুর্গম এলাকায়ও পাহাড়ের মাঝে গাড়ি চলাচলের জন্যে রাস্তা তৈরি করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।

Advertisement

চলতে চলতে দু’পাশে চোখে পড়ল পাহাড়িদের বাড়ি-ঘর। ছোট ছোট বাচ্চারা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে ছিল চকলেটের জন্যে। আমরা পৌঁছলাম ‘মাসালং বাজার’ আর্মি ক্যাম্পে। এখানে এসে সবগুলো গাড়ি জমা হয়। সাজেক ভ্যালি যেতে কয়েকটি সেনাবাহিনী এবং বিজিবির চেকপোস্ট পড়ে। সেগুলোতে চেক করে গাড়ি ছেড়ে দেওয়া হয়। তারপর আবার যাত্রা শুরু। দীঘিনালা থেকে সাজেক পৌঁছতে প্রায় ৩ ঘণ্টা ৩০ মিনিটের মতো সময় লাগলো।

আমরা আগে সাজেকে কোনো আবাসিক হোটেল ভাড়া করিনি। তাই এবার ঝামেলায় পড়তে হলো। সাজেক পৌঁছে হোটেল খুঁজতে লাগলাম। সাধারণত সাজেকের প্রায় প্রতিটি হোটেল বা রিসোর্ট আগে থেকে বুকিং করা থাকে। তারপরও একটু সময় নিয়ে খোঁজার পর পেয়ে গেলাম। একটি রিসোর্টের ৪টি রুম খালি আছে। সেগুলো বুকিং দিলাম। ১ রাত ২ দিনের জন্য।

সেখানে পৌঁছে ফ্রেশ হলাম। সেখানকার পানি কেমন যেন! সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার পরও মনে হচ্ছিল হাতে বোধহয় আরও সাবান রয়ে গেছে। পাহাড়ে পানির খুুবই সংকট। এক বিন্দু পানিও অপচয় করা যাবে না। কেননা এ পানি খুব কষ্ট করে আনা হয়। যা হোক, সন্ধ্যার নাস্তা শেষ করে রিসোর্টের বারান্দায় গিয়ে বসলাম। চারপাশের অন্ধকারে পাহাড়ের কয়েকটি ঘরে আলো! চারপাশ অন্ধকার আর ঠান্ডা বাতাস। এত সুন্দর আবহাওয়া আমার কল্পনারও অতীত। সাজেকের প্রায় সব রিসোর্ট থেকেই এ সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। যতদূর চোখ যায় শুধু দিগন্ত বিস্তৃত সারি সারি পাহাড় আর অন্ধকারে কয়েকটি আলো। এ দৃশ্য আজীবন দেখলেও স্বাদ মিটবে না!

রাতে আমি আর বন্ধু তানজিম ফারুক খাবার খেতে গেলাম। খাবারের সাথে আছে বাঁশের চা এবং বাঁশের বিরিয়ানি। খাবার শেষ করে আবার রিসোর্টে এসে বারান্দায় বসলাম। কিন্তু সাজেকে বিদ্যুতেরও সংকট আছে। সেখানে কিছু নির্দিষ্ট সময়ে বিদ্যুৎ থাকে। বাকি সময়ে জেনারেটর দিয়ে চলতে হয়। রাত ১১টায় ঘুমানোর জন্য রুমে গেলাম। আমি যখন রাত ১টার দিকে জানালা খুললাম; তখন প্রচণ্ড বাতাসে জানালা বন্ধ করতে পারছি না। মাঝে মাঝে বৃষ্টির ফোটা। অথচ তখন শীতকাল। তারপরও বৃষ্টি।

Advertisement

পরদিন ভোর সাড়ে ৫টায় আমি আর বন্ধু তানজিম বের হলাম সকালের দৃশ্য দেখার জন্য। ভোর ৪টা থেকে মেঘের খেলা শুরু হয়। আমরা যখন বের হলাম তখন চারদিকে সাদা সাদা মেঘের দল ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন পুরো বাংলাদেশ মেঘ ঘিরে ফেলেছে। অথচ সাজেকে আসার সময় দেখলাম কত পাহাড়। মেঘের খেলা দেখতে দেখতে আমরা পার্কের, লুসাই পাড়ার এবং রাখাইন পাড়ার কিছু ছবি তুললাম। আমাদের দু’জনেরও কিছু ছবি তুলে রাখলাম। এরপর চলে এলাম রুমে। তখন সময় সকাল সাড়ে ৭টা। এবার বাকি সদস্যরা ঘুম থেকে উঠলো।

ফ্রেশ হয়ে বাহির হলাম সকালের নাস্তা শেষ করে একেবারে হ্যালিপ্যাডের উদ্দেশ্যে। আকাশের রং তখন ধীরে ধীরে আরও উজ্জ্বল হচ্ছে। মনে হচ্ছে মেঘ যেন আমাদের দিকে ভেসে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিকট আকাশের নির্দিষ্ট একটি অংশ অধিকতর উজ্জ্বল হয়ে উঠতে লাগলো। হাজার হাজার বছরের পুরোনো সেই সূর্য! এত কাছ থেকে জীবনের এই প্রথম দেখলাম!

হ্যালিপ্যাড থেকে সূর্যোদয় দেখার পর আমরা রওনা হলাম সাজেক ভ্যালির সর্বোচ্চ চূড়া–‘কংলাক পাহাড়ে’। এর উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৮০০ ফুট উপরে। পাহাড়ে চড়ার ট্রেইল মোটামুটি সহজ। যদিও ৩০-৪০ মিনিটের মতো লাগে। এত উঁচু পাহাড়ের মধ্যেও মানুষের বসবাস। এখানে কয়েকশ বছর ধরে (তাদের ভাষ্যমতে) বসবাস করে আসছে ‘লুসাই’ আর ‘ত্রিপুরা’ উপজাতি। স্থানীয় এক ত্রিপুরা দোকানদারের সঙ্গে অনেকক্ষণ আলাপ করলাম। কাছ থেকে দেখলাম তাদের জীবনযাপন, পরিবেশ, সংস্কৃতি! সবাই তখন ছবি তোলায় ব্যস্ত। আমি একা একা পুরো পাড়া ঘুরে দেখলাম।

এ পাড়ার অর্ধেক হিন্দু আর অর্ধেক খ্রিষ্টান। সেখানে একটি গীর্জা আর কবরস্থান আছে। কংলাক পাহাড় থেকে মেঘের আসল খেলা দেখা যায়। যেখানে হিমেল বাতাস আর মিষ্টি রোদ। একপাশে একটি পুলিশ ক্যাম্প। সেখান থেকে ভারতের মিজোরাম রাজ্যের পাহাড়গুলো স্পষ্ট দেখা যায়। কংলাকে উঠতে পারলে একদম তরতাজা মেঘের স্পর্শ পাবেন। সাজেকের থেকেও বেশি বাতাস এখানে। চোখের সামনে দিয়ে মেঘগুলো শীতল হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিল আমাদের! সাজেক যাওয়ার পথে রিসাং ঝরনা, আলুটিলা গুহা, তারেং সবই পড়ে। কেউ ইচ্ছা করলে এগুলো দেখতে পারেন। আমরা আগে একবার এসব জায়গা ঘুরে দেখলাম। তাই আর নামলাম না।

এবার আমাদের ভাড়া করা গাড়ি করে নেমে যাওয়ার পালা। সবাই তাদের ব্যাগ গুছিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লাম।সেনাবাহিনীর চেক পোস্ট আছে সাজেকে। সেখান থেকে চেক শেষে সকালে খাগড়াছড়ি শহরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলাম। এখানে বলে রাখা ভালো, সাজেক থেকে নামার জন্যও সকাল-বিকেলের দুটি সময় নির্দিষ্ট। নির্দিষ্ট সময়ের আগে-পরে কাউকে নামতে দেওয়া হয় না। আমরা নামতে শুরু করলাম শহরের উদ্দেশে। সব গাড়ি থেকে তাদের চকলেট এবং টাকা ছুঁড়ে মারা হয়। তারা সেগুলো নিয়ে নেয় রাস্তা থেকে। এসব দৃশ্য অসাধারণ। ভোলার মতো নয়।

অবশেষে মনে হলো, চলে আসার দুঃখটা বিচ্ছেদের অনুভূতির মতো। তবুও সার্থক হলো ভ্রমণের একটি বড় স্বপ্ন। লেখক: শিক্ষার্থী, তৃতীয় বর্ষ, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ফেনী সরকারি কলেজ।

এসইউ/এএসএম