ড্রয়িং রুমের সোফায় বিষণ্ণ বদনে গা এলিয়ে বসে আছেন সিতারা পারভীন। হাতে তার পারিবারিক অ্যালবাম। অ্যালবামে সিতারা পারভীনের দেড় মাস থেকে চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত বিভিন্ন ভঙ্গিমার সাদা কালো ও রঙিন ছবি সংরক্ষিত রয়েছে। অ্যালবামের পাতা উল্টাতে উল্টাতে সিতারা পারভীন মনে মনে বললেন,
Advertisement
: হায়! এই আমি কি সেই আমি? কোথায় আমার সেই মরাল গ্রীবা; যার প্রশংসায় মুখে ফেনা তুলে ফেলতো ময়মনসিংহের মনু। আহা! কোথায় আমার সেই মেঘরঙ দীঘল কালো চুল, যা কায়দাপাড়ার সেলিম ভাইকে পরিণত করেছিল দ্বিতীয় জীবনানন্দ দাশে।
ওহো! আমি তো এখনো তেমন গাঢ় করেই কাজল আঁকি চোখে; কিন্তু কোথায় আমার সেই বিজলী কটাক্ষ? যার চমকে হৃৎস্পন্দন বেড়ে যেতো যশোরের বাবলু ভাইয়ের। হা! মেদ নিষ্ঠুরের মতো সবকিছু গ্রাস করে ফেলেছে; মেদ সবকিছুকে সমান্তরালে উপনীত করেছে। উফ! অসহ্য এ অবস্থা থেকে আমি মুক্তি পেতে চাই। চাই, চাই।
‘মুক্তি পাওয়ার উদ্দেশ্যে সিতারা পারভীন প্রথমেই গেলেন ‘মেদ-ভুঁড়িনাশক’ প্রতিষ্ঠানে। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তার উদ্দেশে বললেন,: আশানুরূপ ফল পাবো তো ... : পাবেন মানে? আপনাকে হুবহু শ্রীদেবী বানিয়ে দেবো। ছয় ঘণ্টায় ছয় সেন্টিমিটার ঝরে যাবে।
Advertisement
: কী ঝরবে!: মেদ-চর্বি।: শুধু চর্বিই ঝরবে, না কি অন্য কিছুও? : বুঝতে পারলাম না।
: দেখছেন তো চুলের কী অবস্থা। একেবারে পাতলা হয়ে গেছে। যদি চর্বির সঙ্গে চুলও ঝরতে শুরু করে, বিপদে পড়ে যাব। : ম্যাম, আমাদের অ্যাকশন শুধু চর্বির বিরুদ্ধে।কিন্তু ‘অ্যাকশন’ ‘রি-অ্যাকশন’ করল। হঠাৎ বিদ্যুতের ভোল্টেজ বেড়ে যাওয়ায় পেটে বাধা ভুঁড়িনাশক ইলেকট্রিক বেল্টের প্রচণ্ড শক খেয়ে জ্ঞান হারালেন সিতারা পারভীন। তলপেটের মারাত্মক প্রদাহ নিয়ে অনেকদিন নগরীর একটা ক্লিনিকে শয্যাশায়ী থাকতে হলো তাকে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির এহেন আচরণে গভীর মনোকষ্ট নিয়ে অতঃপর হেকিমি চিকিৎসার দিকে ঝুঁকলেন সিতারা। সিতারা পারভীন তার সমস্যা বলার পর হেকিম সাহেব বললেন,
: আর বলতে হবে না। বুঝতে পেরেছি। এলেম আয়ত্ত করার পর ছত্রিশ বছর ধরে মোটাকে চিকন, চিকনকে মোটা করার কর্মে নিয়োজিত রয়েছি। আজ পর্যন্ত বিফল হওয়ার কোনো রেকর্ড নেই। আর আমি যে ওষুধ আপনাকে দেব, তা দেশীয় গাছ-গাছড়া আর লতাপাতার খাটি নির্যাস। ভেজাল কিংবা কেমিক্যালের কোনো সংমিশ্রণ নেই এতে। শুধু চর্বি না, শরীরের যাবতীয় মুশকিল থেকেও আপনাকে আসান করবে আমার এই দাওয়াই।
‘মুশকিল আসানকারী’ বটিকা খেয়ে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলেন সিতারা পারভীন। বাথরুম আর লবণ-গুড়ের শরবত হয়ে উঠলো তার রাত্রি-দিনের আরাধনা। বস্তুগত চিকিৎসায় চরম অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের পর সিতারা পারভীন অলৌকিক চিকিৎসার প্রতি আকৃষ্ট হলেন। ডিগ্রির ভারে ভারাক্রান্ত, পদবির আক্রমণে জর্জরিত, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এক জ্যোতিষীর শরণাপন্ন হলেন তিনি। জ্যোতিষী তাকে বললেন-
Advertisement
: বিলম্বে ফললাভ দুরাশায় পর্যবসিত হয়। অনেক দেরি করে ফেলেছেন। আপনার বৃহস্পতি রাহুগ্রস্ত। সর্বক্ষেত্রে শনির কর্তৃত্ব। মুক্তির উপায় হিসেবে ডান হাতের চার আঙুলে গোমেদ, ফিরোজা, রক্ত প্রবাল ও রুবি ধারণ করতে হবে। আপনাকে একটা ইনফরমেশন দিচ্ছি- এগুলো সংগ্রহের জন্য দূরে কোথাও যেতে হবে না; আমার কাছেই পাবেন। বাংলাদেশে একমাত্র আমিই ক্লায়েন্টদের কাছে খাঁটি রত্ন ও পাথর সরবরাহ করি।
জ্যোতিষীর দেওয়া পাথরে সিতারা পারভীনের ডান হাতের চার আঙুল সজ্জিত হলো। পরম বিশ্বাসে ভিন্ন রঙের, ভিন্ন গুণের আংটি চতুষ্টয় আঙুলে বয়ে বেড়ালেন তিনি বেশ কিছুদিন। কিন্তু অচিরেই মোহভঙ্গ হলো তার। ক্রমশ স্ফীত হয়ে ওঠা আঙুল থেকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আংটিগুলো খুলতে না পেরে কামারের দোকানে গিয়ে সেগুলো ভাঙতে হলো। আংটি ভাঙার যন্ত্রণা ও আশাভঙ্গের বেদনায় সিতারা পারভীন যখন গভীর হতাশায় নিমজ্জিত, তখন গৃহকর্মে সহায়তাকরী তরুণী সহাস্যে বললো,
: আফা, ছোড মুহে একখান কতা কইতাম চাই।: কী কথা? : আমি আর ফুলির মা রাইত-দিন যে কামগুলান করি, শুইয়া-বইসা না থাইকা হেই কামগুলান আফনে করা শুরু করুইন; দেখবাইন, কয়েকদিনের মধ্যেই গায়ে-গতরে কেমুন ‘ছিলিম’ অইয়া উডতাছুইন।
লেখক: সাংবাদিক, রম্যলেখক। basantabilas2021@gmail.com
এইচআর/জিকেএস