মতামত

‘দুটি পাকা বেল, সরিষার তেল’ আর এবার রসুন

তেল নিয়ে তেলেসমাতির মধ্যে মুখ বন্ধ করে ছিলাম। কারণ কোনদিকে কি বলবো আর তার কি অর্থ দাঁড়াবে কে জানে। সয়াবিন তেল এখন দেশের প্রধান ভোজ্যতেল। এই ভোজ্যতেল বাজারে না পাওয়া গেলে অস্থিরতা সৃষ্টি হবে সেটাও স্বাভাবিক। বাংলাদেশের সাধারণ ভোক্তা জনগণ যে অসাধু ব্যবসায়ী ও মজুতদারদের হাতে জিম্মি সেটাও প্রমাণিত। বলতে গেলে বাজারের ওপর এবং সিন্ডিকেটের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ শূন্যের কোঠায়। এসবই ঠিক কথা।

Advertisement

এখন প্রায়ই খবর পাওয়া যাচ্ছে এখান ওখান থেকে সয়াবিন তেল উদ্ধারের। তার মানে সয়াবিন তেল বাজারে ছিল ঠিকই। কিন্তু সেটা ছিল কারও না কারও গুদামে। দাম আর বাড়ানোর লোভে মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলছিল এই পিশাচগুলো। তেলের পর বাড়ছে পেঁয়াজ এবং রসুনের দাম। এগুলো সবই নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য।

কখনও তেল, কখনও পেঁয়াজ, কখনও আদা রসুন, কখনও বেগুন নিয়ে এই যে তাদের মশকরা এটা আর কতদিন দেশের ভোক্তাদের সহ্য করতে হবে সেটা হলো প্রশ্ন। একটু কিছু হলেই এরা বলে যে, বিশ্ববাজারে তেলের দাম, পাশের দেশে পেঁয়াজ, রসুনের দাম বা যে কোনো পণ্যের দাম বাড়ানোতেই নাকি দেশে সংকট।

এই অজুহাতটা যেন তারা দিতে না পারে সেজন্য কিন্তু সরকারের এবং জনগণেরও আরও কিছু করণীয় আছে। সয়াবিন তেল নিয়ে তেলেসমাতি চলায় আমার মতো অনেকেই সরিষার তেলের প্রতি ঝুঁকেছেন। আমার মনে পড়ছে ছোটবেলায় শোনা যোগীন্দ্রনাথ সরকারের কবিতার কথা। সেই যে ভুলোমনা ছেলেটিকে মা বাজার থেকে আনতে পাঠিয়েছিলেন-দাদখানি চাল, মুসুরির ডাল, চিনি-পাতা দৈ,দু’টা পাকা বেল, সরিষার তেল, ডিমভরা কৈ।

Advertisement

মনে পড়ে ছোটবেলায় আমরা ঘরে ঘরে সরিষার তেলই ব্যবহার করতাম। শুধু রান্নায় নয়, সরিষার তেলের ভেষজ গুণও তো রয়েছে। প্রবাদ ছিল ‘নাকে তেল, কানে তেল, তার বাড়ি না বদ্যি গেল’। তার মানে গোসলের আগে নাকে কানে সরিষার তেল এক ফোঁটা করে দিয়ে নিলে আর ঠান্ডা লাগার ভয় থাকে না।

শীতকালে গোসলের আগে বুকে পিঠে সরিষার তেল মালিশ করারও রেওয়াজ ছিল। সর্দি লাগলে সরিষার তেল আর রসুন খেলে সেরে যেত। গায়ে ব্যথা হলে সরিষার তেলে রসুনের কোয়া গরম করে সেই তেল গায়ে মালিশ করলে ব্যথা সেরে যেত। আর চুলে নারিকেল তেল এবং সরিষার খেল ব্যবহার করলে চুল হতো ঘন কালো। সরিষার খৈল গবাদি পশুর খাদ্য হিসেবেও ব্যবহৃত হতো।

ষাট ও সত্তরের দশকে আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক বুদ্ধির ফাঁদে পড়ে এদেশে সয়াবিন তেল আমদানি শুরু হয়। একশ্রেণির পুষ্টিবিদ ও চিকিৎসকও আন্তর্জাতিক প্রচারের ফাঁদে পা দিয়ে সয়াবিনের গুণগান করতে থাকেন। যার ফলে আমাদের দেশীয় সরিষা তার মর্যাদা হারায়। চাহিদা ও বিক্রি কম হওয়ায় উৎপাদনও কমতে থাকে।

আমদানিনির্ভর পণ্য নিয়ে ব্যবসায়ীদের হাডুডু খেলা দেখে এখন মনে হয় সময় এসেছে আমাদের দেশীয় পণ্যগুলোর সুদিন ফিরিয়ে আনার। একসময় আমাদের দেশে তিল, তিসি, পেঁয়াজ, হলুদ, রসুন ইত্যাদির অনেক চাষ হতো। ‘আর কটা দিন সবুর করো রসুন বুনেছি’র আশ্বাস তো প্রাচীন ছড়াতেই পেয়েছি।

Advertisement

এই যে নতুন করে আবার পেঁয়াজ এবং রসুন নিয়ে ফাজলামি শুরু করেছে সিন্ডিকেট তার উপযুক্ত জবাব হলো নিজের দেশেই জরুরি খাদ্য পণ্যের চাষ করা। যেসব খাদ্যপণ্য না হলে আমাদের চলে না সেগুলো থেকে আমদানিনির্ভরতা কমাতে হবে। প্রয়োজনে সেসব পণ্য দেশেই উৎপাদন করতে হবে। আর সেসব কৃষিপণ্য সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় সংগ্রহ করে ভোক্তাদের কাছে বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে আর মধ্যস্বত্বভোগীদের কবলে পড়ে থাকতে হবে না কৃষকদের। আমাদের কৃষকদেরও সুদিন ফিরবে তাহলে।

আরেকটি বিষয়। এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য পণ্যের উৎপাদনে দরকার আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির বহুল ব্যবহার। চীনের কৃষিক্ষেত্রে বর্তমানে ড্রোন প্রযুক্তি ও আবহাওয়া সহনশীল স্থানে কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহার চলছে। ফলে সব মৌসুমেই কৃষিকাজ সম্ভব হচ্ছে। সেচও করা হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তিতে।

আমাদের দেশে প্রকৃতির কয়েকটি বরদান রয়েছে। বৃষ্টি, সূর্যের আলো এবং পলি। বন্যা আমাদের সমস্যা বলে বিবেচিত হয়। কিন্তু নিয়ন্ত্রিত বন্যার মাধ্যমে মাঠকে পলিসমৃদ্ধ করাও সম্ভব। সোলার পাওয়ারের মাধ্যমে বিদুৎ উৎপাদন বাড়লে ডিজেলের ওপর চাপ কমে যাবে। সেচ যন্ত্র চালাতে ডিজেলের প্রয়োজন হবে না। সোলার পাওয়ারের মাধ্যমে উৎপাদিত বিদ্যুতে চালানো যাবে সেচ ও ট্র্যাক্টর।

বৃষ্টির পানি যদি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে আর সেচের জন্য ভাবতে হবে না। ডিপ টিউবওয়েলেরও প্রয়োজন হবে না। কারণ ডিপ টিউবওয়েলের অতিরিক্ত ব্যবহার আমাদের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর কমিয়ে দিচ্ছে, আর্সেনিকের বিপদও ডেকে আনছে।

কৃষিক্ষেত্রে দরকার আধুনিক প্রযুক্তিতে জৈবসারের ব্যবহার বাড়ানো, দরকার নদী ড্রেজিং। আমাদের এখন দরকার সবুজ কৃষি এবং সেই সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়। মাঠভরা হলুদ সরিষা আমাদের সয়াবিনের ওপর আমদানিনির্ভরতা থেকে মুক্তি দিতে পারে। পাশাপাশি কুসুম ফুল, তিল, তিসি, বাদাম ইত্যাদি তেলের চাষ বাড়াতে হবে।

নতুনভাবে সূর্যমুখীর চাষ করে সূর্যমুখী বীজের তেলের উৎপাদনও বাড়ানো যেতে পারে। আর দরকার দেশীয় পেঁয়াজ ও রসুনের হাইব্রিড ফলন। ফলে পেঁয়াজ-রসুন নিয়ে কয়েকদিন পর পরই দুষ্ট-খেল বন্ধ হবে। কয়েক মাস আগেও কিন্তু গুদামে পেঁয়াজ পচার খবর মিডিয়ায় এসেছে। মজুতদাররা পেঁয়াজের দাম কমানোর জন্য গুদামে মজুত করে রেখে দাম আসমানে চড়িয়েছিল। তাদের অনেকের পেঁয়াজ গুদামেই পচেছে। তবুও শিক্ষা হয়নি অসাধুদের।

এখন আবার পেঁয়াজ-রসুন নিয়ে ছলচাতুরি শুরু হয়েছে। আমার সব আশা ভরসা এদেশের মেহনতি কৃষক শ্রমিককে ঘিরে। এই অসাধু মজুতদারদের হাত থেকে ভোক্তা জনগণকে মুক্তি দিতে পারবে কৃষক শ্রমিকই। তাই কৃষকদের সঠিক নির্দেশনা দানের মাধ্যমে জরুরি ভোগ্যপণ্যের ওপর আমদানিনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে দেশকে। রান্নাঘরে যখন শান্তি থাকবে তখন সারাদেশে অশান্তির খুব একটা আশংকাও থাকবে না।

লেখক: কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/ফারুক/এএসএম