রাজশাহীতে কমেছে তরমুজের ক্রেতা। তাই দামও নেমেছে ১৫ টাকা কেজিতে। অথচ গত দু’সপ্তাহ আগেও এই তরমুজ রাজশাহীর বাজারে আকারভেদে বিক্রি হয়েছে ৩৫ থেকে ৫০ টাকা কেজি। দোকান ঘরে মজুত করে বিক্রি করতে না পারায় এখন হতাশ রাজশাহীর তরমুজ ব্যবসায়ীরা।
Advertisement
বুধবার (১৮ মে) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রাজশাহীর শালবাগান, সাহেব বাজার, লক্ষ্মীপুর, তালাইমারিসহ কয়েকটি বাজার ঘুরে এমনই তথ্য মিলেছে।
রাজশাহীর তরমুজের আড়তদারেরা বলছেন, গত কয়েকদিনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের (ঝড়-বৃষ্টি) কারণে প্লাবিত হয়েছে বরিশাল, খুলনা ও পটুয়াখালীর মতো নিম্নাঞ্চলগুলো। বৃষ্টির জলাবদ্ধতায় তরমুজ ক্ষেতে পানি জমায় এক প্রকার বাধ্য হয়ে কৃষকদের তুলতে হয়েছে মাঠের তরমুজ। এতে বাজারে তরমুজের যোগান বেড়েছে। তরমুজের যোগান বাড়ায় দামও কমেছে তুলনামূলকভাবে।
এদিকে নগরীর পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা জানান ভিন্ন কথা। তাদের ভাষ্য, রোজার সময় প্রচণ্ড গরম থাকায় মানুষের মধ্যে তরমুজ কেনার চাহিদা অনেক বেশি ছিল। কিন্তু ঈদের দিন থেকে বেশ কিছুদিন রাজশাহীতে টানা বৃষ্টির কারণে গরম কমে যায়। প্রকৃতিতে স্বাবাভিক আবহাওয়া বিরাজ করায় কিছুটা তরমুজের চাহিদা কমে। আবার এখন বাজারে মৌসুমী ফল আম ওঠা শুরু হয়েছে। এখন অন্যান্য ফলের সরবরাহ বেশি থাকায় তরমুজের দাম ও চাহিদা দুটোই কমেছে।
Advertisement
সাহেব বাজারের ব্যবসায়ী মো. ফাইটার হোসেন বলছেন, বৃষ্টির কারণে তরমুজের স্বাদ ও ভেতরের রং তেমন আর নেই। তবে আমাদের বরেন্দ্র অঞ্চলের বিশেষ করে নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জ এলাকার তরমুজের স্বাদটা এখনো অনেক ভালো আছে। তারপরও কেউ নিতে চাচ্ছে না।
শালবাগান বাজারের আরেক তুরমুজ ব্যবসায়ী মিন্ট হোসেন দাম কমার বিষয়ে বলেন, এখন বাজারে মৌসুমী ফল লিচু এবং আম ওঠা শুরু হয়েছে। এখন অন্যান্য ফলের সরবরাহ বেশি থাকায় তরমুজের দাম ও চাহিদা দুটোই নেই বললেই চলে। ১৪০০ টাকা তরমুজের মণ কিনে সেই তরমুজ এখন বিক্রি করতে হচ্ছে ১৫ টাকা থেকে ২৫ টাকা কেজিতে। রোজার পর থেকে এখন পর্যন্ত তরমুজ বিক্রি করে প্রায় ৫০ হাজার টাকা লস। দোকানে থাকা মালগুলো বিক্রি করতে পারলেই প্রাণে বাঁচি।
তিনি বলেন, মজার ব্যাপার হলো, আগে টাকা অগ্রীম দেওয়ার পরও আড়তদার কিংবা চাষিদের কাছ থেকে মাল (তরমুজ) পেতাম না। আর এখন চাষিরাই উল্টো ট্রাকভাড়া করে শত শত কিলোমিটার অতিক্রম করে আমাদের কাছে তরমুজ নিয়ে আসছে বিক্রির জন্য। কিন্তু এখন তরমুজ নেওয়া বিপদ। কারণ বিক্রি করাই দায় হয়ে পড়েছে।
রাজশাহীর কয়েকটি বাজারে তরমুজের বর্তমান দাম জানতে গিয়ে দেখা গেছে, কালো বা জাপানি, বাংলালিংক, খুলনার জাগুয়ার জাতের বড় তরমুজগুলো বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ টাকায়। অপরদিকে সব জাতের ছোট তরমুজ বিক্রি হচ্ছে ১৫ টাকা কেজিতে। তবে যেসব তরমুজের ভেতরের বর্ণ হলুদ সেগুলো বিক্রি হচ্ছে ওজনভেদে ২০ থেকে ২৫ টাকা। এমনকি রাজশাহীর বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় ভ্যানে করে মাইকিং করে ১৫ থেকে ২০ টাকা কেজি দরে তরমুজ বিক্রি করছেন অনেক খুচরা বিক্রেতা।
Advertisement
বিক্রেতারা জানান, এসব তরমুজ দেড় থেকে দুই সপ্তাহ আগেই বাজারে বিক্রি হতো ৩৫ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে। তবে যোগান বাড়ায় এবং বৃষ্টির কারণে পচনের ভয়ে এসব অল্প দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। অন্যথায় লাভ তো দূরের কথা, ব্যবসার আসল টাকা তোলাই কঠিন হয়ে যাবে।
রাজশাহীর শালবাগান এলাকায় জাগো নিউজের সঙ্গে কথা হয় খুলনার তরমুজচাষি দ্বিজেন্দ্রনাথ সরকারের। তিনি রাজশাহীর আড়তে তিন হাজার পিস তরমুজ নিয়ে এসেছেন খুলনার কয়রা থেকে। তবে এখানে মৌসুমী ফল আম ও লিচুর চাহিদা বাড়ায় কমেছে তরমুজের ক্রেতা। আর তাই তরমুজ নিয়ে রীতিমতো বিপাকেই পড়েছেন এই চাষি।
জানতে চাইলে দ্বিজেন্দ্রনাথ বলেন, দু’তিন সপ্তাহ আগে ক্ষেতে গিয়ে তরমুজ কেনার জন্য অগ্রীম টাকা দিয়ে আসতো বরেন্দ্র অঞ্চলের আড়তদার ও বড় বড় ফল ব্যবাসায়ীরা। কিন্তু দাম কমায় ক্রেতারা খুলনায় আসছে না। এ কারণে নিজেই তরমুজ নিয়ে এসেছি বিক্রির জন্য। কিন্তু তরমুজ নিয়ে বিপাকে পড়েছি। জেলায় জেলায় ঘুরেও তরমুজ কেনার ক্রেতা পাচ্ছি না।
কয়রা উপজেলার পাঁয়গাছা পাতড়াবুনিয়া এলাকায় ৭ বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করেছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ। বিঘাপ্রতি হাজার দশেক টাকা খরচ হয়েছে। আশা করেছিলেন আড়াই লাখ টাকার তরমুজ বিক্রি করবেন। বিধি বাম। এখন ৭ বিঘায় এক লাখ টাকা তুলতে হিমশিম খাচ্ছেন।
জাগো নিউজকে তিনি জানান, ঘরের ধান বিক্রি করে ট্রাকভাড়া করে প্রায় তিনশ মণ তরমুজ নিয়ে এসেছেন রাজশাহীতে। আশানুরূপ দাম ও ক্রেতা না পাওয়ায় চোখে-মুখে বিষণ্নতার ছাপ তার।
তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চাষিদের মার দিয়েছে ব্যবসায়ীরা। পরে ব্যবসায়ীরাও মার খেয়েছে। যারা ৫-৭ টন মাল কিনেছিল তারা বিক্রি করতে না পেরে ধরা খেয়েছে। খুলনায় সব ধরনের তরমুজের দাম এখন অনেক কমে গেছে। রোজার মধ্যে বরিশালের যে তরমুজ ৫০০ টাকা বিক্রি হয়েছে, এখন তা ২০০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে না। খুলনার কিছু তরমুজ ঈদের আগে ৪০০ টাকার ওপরে বিক্রি হয়েছে। সেই তরমুজ এখন ১৫০ থেকে ১৭০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। সামনে মৌসুমে তরমুজ চাষ কমে যাবে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর তথ্য কেন্দ্রের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক মো. আব্দুল্লাহ হিল কাফী বলেন, রাজশাহীর বাজারে বর্তমানে বিভিন্ন গুটি জাতের আম ও লিচু পাওয়া যাচ্ছে। আর কয়েকদিনের মধ্যে বাজারে আসবে রসালো মিষ্টি গোপালভোগ আম। এরইমধ্যেই চাষিরা গোপালভোগ, কাঁচামিঠা ও বিভিন্ন গুটি আম বিক্রি করছে বাজারে। তাছাড়া সপ্তাহ দুয়েক হয়েছে রাজশাহীর বিভিন্ন বাজারে লিচু পাওয়া যাচ্ছে। আর তাই এখন তরমুজ খাওয়ার প্রবণতা মানুষের নেই। এ কারণেই তরমুজের দাম ১৫ থেকে ২০ টাকা কেজিতে নেমেছে।
এফএ/এমএস